দুই বন্ধু BIBM এ ব্যাংকিং এর উপর উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছে, চাকুরীও মোটামুটি ঠিকঠাক, সামনে অল্প কয়েকদিনের জন্য পড়াশুনার ব্যাস্ততা বা চাকুরীর প্যাড়াহীন অবসর। এক বন্ধুর উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার কোন সাহস-সুযোগ-সুবিধা বা কোনটাই নাই, তাই সে চাটুকার বা কেরানী গোছের একটা চাকুরী জুটিয়ে কোন মতে জীবন ধারন করে যাচ্ছে।
দুই বন্ধুর শেষ পরীক্ষা শেষে তিন বন্ধু একত্রে হল কেরানী বন্ধুর অফিসের পাশ ঘেঁসে থাকা ঢাকা শহরের ইট-পাথরের বস্তির মাঝে এক চিমটি ক্ষণিক সুখের টলমলে জলের কিত্রিম লেক ধানমণ্ডি লেকের পাশে। এটা-সেটা খাওয়া, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মেয়েদের চোখে চোখ রাখা না রাখায় ব্যাঞ্জনার মাঝে একজন বলে বসলো চল আমরা “আমাদের সামনের দুই দিনের ছুটিটা আমাদের “আন্ডারওয়ার” বন্ধুর কাছে সিলেটে কাটিয়ে আসি?
“আন্ডারওয়ার” বন্ধু? সেই গল্পটা বলে আর নিজের ইমেজের বারোটা বাজাতে চাইনা, তাই উহ্যই রাখলাম। কিন্তু টাকা? চাকুরীতে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা দুই বন্ধু অপারগ তাই কেরানী বন্ধুই ওদেরকে ধার দিতে চাইলো, শর্ত প্রথম মাসের স্যালারি পেয়েই যেন ধার শোধ করে দেয়। তারাও রাজী আর তাৎক্ষণিক ওঠ-পড় আর চল।
কোন মতে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়েই তিন বন্ধু কমলাপুরে। সিলেটের বন্ধুকে ফোন করে ওর বিশাল প্রায় রাজপ্রসাদসম বাংলোর সন্ধান পাওয়া গেল! তার নামে থাকা ফ্রি? ওয়াও গ্রেট। আর ওর বাসাতেই যেহেতু থাকবো নিশ্চয়ই ওই শালা দুই-এক বেলা খাওয়াবে? ঠিক আছে তাহলে দেখাই যাক না কি হয় আর কিভাবে হয়?
সেভাবেই শুরু হল ভ্রমণ আর যেহেতু এর আগে কখনো সিলেটে যাওয়া হয়নি তাই শুধু চা বাগান দেখার আকুলতাই আমাদের পেয়ে বসেছিল অমোঘ ব্যাকুলতায়! ট্রেন চলছে আমাদের তিন বন্ধুর আতলামিও চলছে... সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম থেকে বর্তমান দিন পর্যন্ত মজার মজার সব কথা আর এক জন আর একজনকে পচানো, এটা আমাদের এক নিয়মিত আর অনির্ধারিত রীতি! কয়েক বন্ধু এক জায়গায় হলেই একে অন্যকে জালানো বা পচানো।
সে সব বাদ, এবার তবে সিলেটের কথাই বলি। আমরা ট্রেনের ছুটে চলার মাঝে তেমন কিছুই দেখছিনা, না মেঘ না আকাশ না সবুজ বা নদী না ঢেউ! আমারা শুধু চেয়ে আছি কখন দেখবো সবুজ চা গাছের ঢেউ, আছড়ে পড়া সবুজ যেন মেশে মাটির সাথে! আর উপরে ছায়া ঘেরা বড় বড় গাছের আচ্ছাদন। মাঝে মাথার সিঁথির মত সোজা কোথাও এঁকেবেঁকে চলা মাটির মেঠো পথ। কোথাও মাঝারী টিলার বুক চিড়ে বেড়িয়ে আশা সুখের কান্না বা মৃদু ঝর্ণাসম কোন টলমলে জলের বয়ে চলা। কোথাও উপজাতীয় নারী পুরুষের দল বেঁধে ছুটে চলা জীবনকে যাপনের কাছে সমর্পণে!
এইসব ভাবতে-ভাবতে আর কল্পনার জাল বুনতে বুনতেই হঠাৎ চোখে পড়লো দূর দুরান্তে সবুজের ঢেউ আর ভাবনার সাথে মিশে যাওয়া গাছের ছায়া! দেখতে দেখতেই আমরা পৌঁছে গেলাম কুলাউরা রেল স্টেশনে। সেখানে একটু অমৃত আনারস খেতে-খেতেই ট্রেন ছেড়ে দিল, এবার শুধু মুগ্ধতা আর মুগ্ধতা, যেন গিলে খাই পুরো প্রকৃতিকেই! মনে হল যেন ঝাঁপ দেই ওই চলন্ত ট্রেন থেকেই বিসৃত সবুজ সমুদ্রের উঁচু-নিচু সবুজ ঢেউ খেলানো প্রান্তরে!
একটু পরেই সারা পৃথিবীকে অন্ধকার করে দিয়ে যেন কোন রূপ কথার অন্ধকার আর রোমাঞ্চে প্রবেশ করলাম! আসলে লাউয়াছরা সংরক্ষিত বনের বুক চিড়ে তৈরি করা রেললাইন! দুই পাশে খাড়া পাহাড় উঠে গেছে উঁচুতে অনেক উঁচুতে, ঘন বন, অন্ধকার জঙ্গল আর গাঁ ছমছমে শীতলতা! সব কিছু মিলে যেন প্রথম পাওয়া অপার্থিবতা এই পৃথিবীতে।
তিন বন্ধুই স্তব্ধ পুরোপুরি, সৌন্দর্য আর সার্থকতার সম্মিলনে! এরপর সিলেট পৌঁছানো পর্যন্ত আর কিছুই দেখতে চাইনি শুধু চোখ বুজে ওই সুখের রেশটুকু রেখে দিতে চেয়েছিলাম আবারো কোন অপার্থিব সৌন্দর্য দেখার আগ পর্যন্ত! কিন্তু না চোখ আর মন কি আর তা মানে? মানে না। এরা দুজন তো লোভী দারুণ লোভী, ভীষণ-ভীষণ লোভী! তাই সেই লোভের লালসাকে আর সংবরণ না করে আবারো চোখ মেললাম। আর চোখ মেলে জানালার ধারে মাথাটাকে এলিয়ে দিয়ে নিতে থাকলাম বুক ভরা নির্মল নিঃশ্বাস আর অবারিত সবুজের আস্বাদন।
নিল আকাশ-সাদা মেঘ-সবুজ চা বাগান আর ট্রেনের অবিরাম ছুটে চলা সাথে রোদের লুকোচুরি খেলা। এই মেঘ, এই রোদ্দুর আর এই ছায়া ঘেরা বাগান। এসবের ভিতর দিয়েই আমরা শ্রীমঙ্গল এবং আরও অন্যান্য নান্দনিক সব রেলস্টেশন পেরিয়ে চলে এলাম অনেক প্রার্থিত সিলেট রেল স্টেশনে একদম ভর দুপুরে।
সেখানে আমাদের আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ৮ বছরের পুরনো কিন্তু ৪ বছর দেখা না হওয়া পরিচিত বন্ধুর অপরিচিত মুখচ্ছবি!
কুয়াশার বায়না আর রোদের অবাধ্যতা (পরের গল্প)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:০৯