আচ্ছা ক্যাসপার কে? কি হয় আমার? রক্তের কেউ কি? নাকি কোন আত্মীয়? নাকি কোন প্রতিবেশী যার বা যাদের সাথে অনেক দিনের ওঠা-বসা এবং সেই খাতিরে কাছাকাছি হয়ে যাওয়ায় জড়িয়ে যাওয়া কিছুটা মায়ার বাঁধনে!
না ক্যাসপার আমার এমন কেউ নয়! কিন্তু ক্যাসপার আমার কাছে এর চেয়েও অনেক বড় কিছু, অনেক উৎসাহ ও একটি প্রেরনার নাম, ক্যাসপার আমার কাছে একটি অনন্ত আর অমর স্বপ্নের নাম। ক্যাসপার আমার আর একটি বাবার নাম!
বুঝতেছিনা ক্যাসপারকে নিয়ে আমি কেন লিখছি? আর ক্যাসপারকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কেনই বা আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বারে-বারে। ক্যাসপার কে? যে নাড়া দিয়ে গেছে আমাকে, আমার চেতনা ও সত্তাকে! শুধু আমাকে নয়, আমার মত এমন হাজারো-লাখো নিয়মিত ফেসবুক ও বিভিন্ন ভ্রমন গ্রুপের সাথে সংযুক্ত ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন ও মা-বাবাকে। সর্বোপরি ক্যাসপার আমার কাছে এক চিরন্তত্ন দুঃখ, অনন্ত কষ্ট আর বিধাতার কাছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় আক্ষেপের নাম!
ক্যাসপার এর যে ছবিটা সর্ব প্রথম আমার চোখে পড়ে এবং এখনো চোখে লেগে আছে, সেটা হল কোন এক খুব সম্ভবত মফস্বলের নির্জন রেল ষ্টেশনের ফাঁকা প্লাটফর্মে বাবা আর ছেলে একই ভঙ্গিতে ব্যাকপ্যাক মাথায় দিতে চিন্তিত মুখে শুয়ে আছে। ওটা এখনো ক্যাসপারের দেখা ছবি গুলোর মধ্যে আমার কাছে সেরা ছবি। হয়তো প্রথম দেখে ভালো লেগে যাওয়ার রেশটা অমলিন থেকে গেছে। হ্যাঁ ক্যাসপারের এর চেয়েও অনেক-অনেক ভালো ও নান্দনিক ছবি আছে আমি নিশ্চিত। তবুও ওটাই আমার কাছে ওর সেরা ছবি হিসেবে ছিল-আছে আর থাকবেও।
ছবিটা দেখার পরে নিজের কাছে প্রথম প্রশ্ন ছিল এটা কি মেকি? মানে বাবা কি ছেলেকে আর নিজেকে একই ভাবে উপস্থাপন করার জন্যই এমনটি করেছে? এভাবে পোজ দিয়েছে? নাকি ওরা ওই স্টেশনে অনেক অনেক সময় ধরে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত? অনেকক্ষণ দেখার পরে ওদের ক্লান্তই মনে হল। আর সেই ক্লান্তি দূর করতেই নির্জন প্রকৃতির ঘেরা এক নান্দনিক রেল স্টেশনে ওদের আরামের বিশ্রাম নেয়া।
সে যাই হোক বাপ-বেটার ওই ছবিটা আমার মনে গেঁথে গেল আর চোখে আটকে রইলো। আর আমারও যেহেতু ঠিক ওই বয়সি বা কাছাকাছি বয়সের একটি ছেলে আছে, তাই কিছু মানসিক মিথস্ক্রিয়া ও বাবা ছেলের মায়া-মমতা মাখা মুখচ্ছবি আমাকে আপ্লুত করলো। তাই তাৎক্ষণিক অপু ভাইকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালাম।
যেহেতু মাঝে-মধ্যে পাহাড়-টাহাড়ে যাই, একটু-আধটু ঘোরাঘুরি করি আর সেই ছবি-টবি আছে সেহেতু অপু ভাই সেটা গ্রহণ করেছিলেন। আর এর পর থেকেই অপু ভাইয়ের বিভিন্ন ভ্রমণ পোস্ট, এই পাহাড়-পর্বত-খাল-বিল-নদী-নালা-বন-জঙ্গল এর ছবি-কথা ও সবচেয়ে নান্দনিক ক্যাসপারের উজ্জ্বল ও প্রানোচ্ছল বিভিন্ন ভ্রমনের ছবিগুলো চোখে পড়তো, যা আমাকে প্রকৃতি দেখার চেয়েও বেশী মুগ্ধ ও বিমোহিত করতো। আমি চেয়ে-চেয়ে দেখতাম আর ক্যাসপারের জায়গায় আমার ছেলেকে আর অপু ভাইয়ের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে হারিয়ে যেতাম সেই সব জায়গায়। যেন ক্যাসপার আর অপু ভাই নয়, আমি আর আমার ছেলেটা!
তো ক্যাসপার আর তার বাবার ছবি দেখে দেখে আমিও আমার ছেলেকে সাথে নিয়ে কোন এক পাহাড়-জঙ্গল বা সমুদ্রে যাবার রঙিন জাল বুনতে-বুনতে একদিন অনেক-অনেক সাহস নিয়ে আমার বৌকে বলেই ফেললাম আমার একটি একান্ত আর নতুন সৃষ্টি হওয়া বাসনার কথা!
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে বৌকে এতটুকু কথা বলার জন্য অনেক অনেক সাহসের কি দরকার আছে? তবে কি আমি আমার বৌকে খুব ভঁয় পাই! না সে ভঁয়-টয় আমি পাইনা। কিন্তু আমার বৌ বেশ কড়া ভাষায় আর সত্যিকারের অনুনয় নিয়ে আমাকে বলে দিয়েছে...
“এই পাহাড়-বন-জঙ্গল আর সাগর-নদী-নালা ঘুরে-ঘুরে তুমি আমার কাছ থেকে নিজেকে অনেক-অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছ, দয়াকরে কখনো আমার ছেলেটাকে এভাবে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিওনা প্লিজ!”
তো সেই থেকে আমি কোথাও গেলেও ছেলেকে নিয়ে আর এইসব ভাবনা ভাবতাম না।
কিন্তু ক্যাসপার আর অপু ভাই আমাকে আবার ওই ভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে, করতো নিয়মিত তাদের ছবি ও কথাগল্প দেখে-পড়ে আর উপভোগ করে করে। দেখতাম ক্যাসপার বাবার পিছনে পিছনে কিভাবে দৌড়াচ্ছে, দেখতাম আর একা-একাই হেসে উঠতাম। এই ক্ষেত্রে বিশেষ করে মনে পড়ে নিঝুম দ্বীপে অপু ভাইয়ের পিছনে ক্যাসপারের ছুটে চলার ছবিটার কথা। ইস কি নান্দনিক!
আর যে ছবিটার কথা খুব-খুব মনে পড়ে সেটা মেঘাচ্ছন্ন বিছানাকান্দিতে ক্যাসপারের হাতে ছাতা ধরে থাকা, যার ক্যাপশনে আছে “মেঘ দেখে তুই করিস না ভঁয়, হাতে তোর ছাতা আছে” এই রকম বোধয়! বোধয় এই জন্য যে ক্যাসপারের ছবি ও তার ক্যাপশন গুলো দেখে সঠিক বর্ণনা দেবার মত সাহস এখনো ফিরে পাইনি।
এইসব ছবি-কথা-গল্প আর অন্যদের কমেন্ট পড়তে পড়তেই কখন যেন ক্যাসপার আমার অনেক আপন হয়ে গেল, অনেক-অনেক, হ্যাঁ হতে পারে আমার ক্যাসপারের কাছাকাছি বয়সেরই একটি ছেলে আছে বলে, বাবার আদর-মমতা আর ভালোবাসার কিছুটা বোধ তৈরি হয়েছে বলে। কিন্তু সে নাহয় আমার একারই হবে, অন্যদের কেন? অন্য সবাই তো আর আমার মত বাবা হয়নি। সেই মায়াও তো সবার নেই। তাহলে?
এরপ, হঠাৎ করেই একদিন চোখে পড়লো ক্যাসপার অসুস্থ, ওর জন্য সবাই দোয়া করুন, অপু ভাইয়ের নিজের দেয়া পোস্ট ছিল বোধয় ওটা! এই সব পোস্ট আমি সব সময় এড়িয়ে যাই, অতি সন্তর্পণে! কারণ আমি সত্যিকারের বিনোদন ছাড়া অন্য পোস্ট গুলোকে সাধারণত ফলো বা লাইক-কমেন্ট করিনা, কখনোই না। সুতরাং এই পোস্টটিও স্বভাবতই এড়িয়ে গেলাম।
এর দুই বা তিনদিন পরে বোধয় আর একটি পোস্ট চোখে পড়লো হাসপাতালের বিছানায় সম্ভবত হলুদ আর সাদা কোন গেঞ্জি পরে শুয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে ক্যাসপার, খুব অসহায় আর আকুতি নিয়ে, ওকে টেনে ধরে আবারো কোন পাহাড় বা জঙ্গলে নিয়ে মুক্ত করে দেবার জন্য! যেখানে ক্যাপশনে খুব সম্ভবত লেখা ছিল “ক্যাসপারের কোন উন্নতি হচ্ছেনা, ওর জন্য সবাই দোয়া করুন!” কেন জানিনা সেদিনের সেই পোস্টটা আমি এড়িয়ে বা উপেক্ষা করে যেতে পারিনি, আর নিজের অজান্তেই বুকের ভিতর একটা হাতুরি পেটার মত অনুভূতি টের পেলাম! কিন্তু বেশিক্ষণ ওই পোস্টে সময় ব্যয় না করে অন্যত্র চলে গেলাম।
কিন্তু ক্যাসপারের ওই হাসপাতালের বিছানায় সোয়া মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল আমার চোখে কোন কারণ ছাড়াই, সেটা উপেক্ষাই করেছি। হয়তো ঠিক তার পরদিন, অপু ভাইয়ের কোন বন্ধু অনেক-অনেক আর অনেক অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্যাসপারকে সহযোগিতা জন্য একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। আর ঠিক সেই পোস্ট শেয়ার হওয়া থেকেই মূলত শুরু হল ক্যাসপারকে নিয়ে ফেসবুক ও ভ্রমন সম্পর্কিত পেজ গুলোতে শত-হাজার-লাখ মানুষের দোয়া আর ভালোবাসা। ক্যাসপারের সাথে সবার জড়িয়ে যাওয়া, বেঁধে ফেলা এক অলেখা আর অদেখা বাঁধনে! ভালোবাসা-মায়া-আদরের আর আবেগের বাঁধনে।
সব মানুষ যে যেভাবে পেরেছে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বা অন্তত চেষ্টা করেছে। আর ক্যাসপার অল্প পরিচিত থেকে খ্যাত হতে শুরু করলো, সবাই ক্যাসপারকে চিনতে লাগলো আর জান-প্রান দিয়ে ভালোবাসা দিতে লাগলো, যে যেভাবে পারলো। কিন্তু ক্যাসপার? ক্যাসপার ওর মতই সময় গুনতে থাকলো হাসপাতালের করুন-কষ্টের আর বিষাদ মাখা বেদনার বিছানায়! কাৎরাতে লাগলো ওর কষ্ট গুলোর কাতরতায়!
ক্যাসপার ঢাকায় এলো, মানুষ যেন ওকে একবার দেখার জন্য যে কোন কিছু করতে পারে, এমন মেসেজও আছে আমার ইনবক্সে! কিন্তু হাসপাতাল ও ওর আপন জনেরা ওর ভালোর জন্য আর বেশী জটলা যেন না হয় সেই জন্য ওর সুচিকিৎসার সুবিধার্থে সব কিছু থেকে দূরে রাখা হল। দুই দিন? হ্যাঁ দুই দিন-ই বোধয়! এর মাঝে ক্যাসপার আরও অনেক অনেক মানুষের মনের মনি কোঠায় ঠাই করে নিয়েছে, দোয়ায়-ভালোবাসায় আর সত্যিকারের আবেগের আদরে।
ক্যাসপার তো দেখি খ্যাত থেকে বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে, এই ফেসবুক আর মানুষের মমতার কল্যান আর আশীর্বাদে! তবে কি ফেসবুক শুধু দুরেই টানেনা, কাছেও এনে দেয় অনেক অজানাকে? আপন করে দেয় অনেক অচেনাকে? ভালোবাসতেও শেখায় অনেক না দেখাকে? হ্যাঁ তাই-ই তো! ক্যাসপার তো সেটাই দেখাল।
কিন্তু না উপরওয়ালা নাকি যা করেন ভালোর জন্যই করেন! উপরওয়ালার কাছে বড় জানতে ইচ্ছে করছে কি এমন ভালোর জন্য তুমি ক্যাসপারকে আমাদের মাঝ থেকে আরে আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম ওর বাবা-মার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলে? হ্যাঁ ক্যাসপার চলে গেছে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে-স্তব্ধ করে দিয়ে, আর ছিন্ন করে প্রার্থনার সকল শেকল, ভালোবাসার সবটুকু বাঁধণ! করে গেছে ক্ষত-বিক্ষত লক্ষ্য-লক্ষ্য মানুষের মন।
তোর কি এতই স্বাদ ছিল খ্যাত হবার? কেন তুই খ্যাত হতে গেলি? না ফেরার দেশে গিয়ে তুই শুধু খ্যাত না, তুই আজ বিখ্যাত! কি দরকার ছিল তোর বিখ্যাত হবার? কি দরকার ছিল এতো-এতো মানুষের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার, কি দরকার ছিল আমাদের সবার এতো-এতো প্রিয় হয়ে ওঠার?
তুই সাধারনই থাকতি, তোর বাবা আর মায়ের কাছে, আমাদের না হয় নাই চেনাতি নিজেকে, নাই হতি আমাদের এতো এতো আপনজন! থাকতি তোর ছোট্ট পৃথিবীর, একমাত্র বাংলাদেশের কাছে সদা সত্য ও উচ্ছল হয়ে।
কিন্তু না তুই চলে গেলি, ওপারে আর কভু না ফেরারদের দেশে, করে গেলি নিজেকে বিখ্যাত, হয়ে গেলি অমর! কিন্তু আমরা তোর অমরত্ত চাইনি, আমরা সাধারন ও স্বাভাবিক তোকে চেয়েছিলাম আমাদের মাঝে সব সময়ের জন্য।
তুই বুঝলিনা! তবুও জানি তুই থাকবি সব সময় আমাদের সকলের মাঝে সকল ভ্রমণে, পাহাড়ে-পর্বতে-জলে-জঙ্গলে-বনে-বাদাড়ে-সমুদ্রে-ঢেউয়ে সকল রোমাঞ্চে আর কষ্টের অ্যাডভেঞ্চারে হয়ে আমাদের আদরের, অনেক অনেক আর অনেক আদরের ছোট্ট ক্যাসপার হয়ে, অমলিন আর অনন্ত সময়ের জন্য স্থির!
ভালো থাকিস, যেখানেই থাকিস... হয়ে
অমর ক্যাসপার, আমাদের ক্ষুদে ট্রেকার............
উৎসর্গঃ ক্যাসপারের নির্মল মুখচ্ছবি আর ওর অমরত্তকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:২৩