মানালি পৌছাতে প্রায় সন্ধা, বিয়াস নদীর গাঁ ঘেঁসে আর পাহাড়ের পা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে... রাতের আকাশের তারাদের অভিবাদন, খণ্ড চাঁদের আলোকিত আমন্ত্রণ আর দূরের শ্বেত শুভ্র পাহাড় চুড়াদের নিমন্ত্রন.... মানালিতে স্বাগতম।
ঝমঝম শব্দে লোহার ব্রিজ পেরিয়ে মানালি শহরে ঢুকে পড়লাম। আলোয়-আলোয় আলোকিত সারা মল চত্তর, রাস্তা-ঘাট, গাছপালা, বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, যেন পুরো শহর সেজেছে বিয়ের সাঁজে! আসলেই তাই... মানালিতে বছরের প্রথমটা এমনই... বর্ণময়, বর্ণিল, বাঁধনহারা, বাঁধভাঙা...! উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা, মায়া আর মাদকতা, আবেগ আর আকুলতায় ভরা, ঝকঝকে-তকতকে, রঙে-রঙে রঙিন আর লোকে-লোকে লোকারণ্য প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি কোন...!
নেই কারোই কোন ব্যাস্ততা! নেই দ্রুত হাটার কার্যকারিতা, নেই হাক-ডাকের বালাই, এ যেন স্বপ্নের এক অলসপুরী! আমাদের গাড়ি সরু পীচ ঢালা রাস্তা ধরে আর পাহাড়ের বাঁকে-বাঁকে, এঁকেবেঁকে উপরের দিগে উঠছে... আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছেনা, মনে হচ্ছে নেমে হেটেই যাই! কিন্তু পথ যে চিনিনা... গাড়ি চলছে তো চলছেই... থামার কোনো লক্ষণই নাই!
সবাই নামার জন্য অস্থির, আর কতক্ষণ? “এই সামনেই” ড্রাইভারের উত্তর, কিন্তু পথ যেন শেষই হতে চায়না... কতক্ষণই বা ৫ বা ৭ মিনিট! তাই যেন অনন্তকাল! “আমাদের হোটেল? “হবে সেখানেই, যার পরে আর রাস্তা নাই!” “যে জায়গা থেকে আর কোথাও যাওয়া যায়না!” “যার পরে আর গাড়ি যায়না!” “প্রত্যন্ত এলাকায়, যার পরে আর কিছুই নাই!” এই সব উল্টা-পাল্টা মন্তব্য করছিলাম, আমি... সারাদিনের ক্লান্তির অবসন্নতায়! আমার কথা শুনে ড্রাইভার একটু মন খারাপই করলো! আর অন্যরাও আমাকে বকতে লাগলো, থামাতে চাইলো!
তবে হ্যাঁ... গাড়ি থামলো, একদম পথের শেষেই... একেবারেই প্রান্তরে... যার পরে আসলেই আর যাবার জায়গা, রাস্তা বা সামনে নেই কোনোই গন্তব্য...! সুতরাং এবার আমি আবারো সরব হলাম, আগের মন্তব্য গুলো সঠিক ছিল বলে......!!
হোটেলে ঢুকে গেলাম, হুড়মুড় করে, কোনো দিকেই না তাকিয়ে, ক্লান্তিতে ক্লিষ্ট হয়ে, স্নান করে শান্ত হতে, ঘণ্টা খানেক পরে নিচে নেমে এলাম, সবাই... একে-একে, এবারই প্রথম হোটেলের পাশে বরফ দেখলাম! মনটা খুশিতে নেচে উঠলো... সিমলাতে প্রথম বরফ দেখার মতই! কিছুটা আশ্বস্ত হলাম, যাক তবে বরফের আসে-পাশেই আছি! দু-একটা করে ছবি সবাই তুললাম। তখন জানিনা যে আমরা চারিদিকে বরফের স্তূপ আর বরফে ঢাকা এক স্বপ্ন কুটিরেই রাত কাটাবো!
হেটে-হেটে নেমে গেলাম ম্যলের দিকে কিছুক্ষণ আগেই উপরে উঠার রাস্তা ধরে, কিন্তু দেখতে পারিনি তেমন কিছুই শুধু পথে বিভিন্ন ঢং আর আকৃতির ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র কুটিরের আবছা সৌন্দর্য ছাড়া, চারিদিকে যে কুয়াশায় জড়ানো... মেঘে মোড়ানো... বরফে হারানো... নিয়ন বাতির অনুজ্জল আলোতে নেভানো...!!
মল চত্তরে কিছুক্ষণের উম্মত্ততা শেষে, গরম-গরম রসগোল্লায় মন ভরে, আস্ত মুরগীর গ্রিল, নান বা সেই জাতীয় রুটি, আর সাথে সামান্ন পানীয়!! নিয়ে মানালির বিখ্যাত উইন্টার ফেস্টিভ্যাল এর বর্ণিলতার উষ্ণতা! গাঁয়ে মেখে ফেরার পথে, অন্ধকারে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন কিছু উদ্ধার করতে, করতে রুমে ফেরা আর খেয়ে দেয়ে ডাবল কম্বলের নিচে উষ্ণতার খোঁজে হারিয়ে যাওয়া... কে? কখন? ঘুমিয়ে পড়েছি কেউ জানিনা......!
ঘুম ভেঙে, চোখ কচলে, বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি... সারাদিন কি করবো এই সব ভাবতে... ভাবতে জানালার অনেক ভারী পর্দা সরাতেই......... হা......... হয়ে গেলাম...... শরীরের প্রতিটি রোম জেগে উঠলো! স্তম্ভিত হয়ে ভুলে গেলাম পিছনের সব... সব... সব কিছুই... এক নিমিষেই...! এতো পুরোই স্বপ্নপুরী! এতদিন ধরে সিনেমায় যেমন দেখেছি... হলিউড, বলিউড এর... যতদূর চোখ যায় শুধু সাদা... আর সাদা... নরম বরফে মোড়ানো চারিদিক... পাইনের কালো গাছ... আর সাদার সুভ্রতায় মোড়ানো পাতা...! কাছের পাহাড়, দুরের পাহাড় সব... সবই বরফে জড়ানো... সাদায় মোড়ানো... বারান্দায় বরফ! রেলিংএ বরফ! জানালায় বরফ! বরফ আর বরফ যেন বরফের জন্মভূমি... বরফের একাকার চারিদিক...!
সবাই মিলে শতেক ছবি তো তুললামই! কিছুক্ষণ পরে পর্যাপ্ত গরম কাপড় পরে নেমে এলাম হোটেলের নিচে... এবার সবাই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ প্রায়! আরে এযে অনেক নাম শোনা হাদিম্বা টেম্পলের পাশেই আমরা! যেন সুজারল্যানডের আবহ! দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত স্তরে, স্তরে উঠে যাওয়া বরফ পাহাড়! যেখানেই একটু সমতল, সেখানেই একটি রঙিন কুটির! হাজার রঙের বর্ণিলতায় সাজানো! যার যে রঙ ইচ্ছে মতন! বাড়ির ছাদ গুলো সব তুষারে ঢাকা! গাড়ি গুলো সব তুষারে জড়ানো! প্রতিটি কুটিরের প্রবেশ মুখে যেন তুষারের দেয়াল! তুষারের গেট!
পত্রহীন আপেলের গাছে-গাছে তুষারের ঝুলে থাকা! সেও এক অপার্থিব সম্মোহন! ওখানেই কাটিয়ে দিলাম একটি বেলা... তুষার মেখে, তুষার ছুঁড়ে, তুষারে হেটে, বরফে শুয়ে, স্লাইডিং করে, লাফিয়ে-দাপিয়ে, বরফ নিয়ে মারামারি করে, উদ্দাম উদযাপন করে, আপেলের গাছে ঝুলে... পাইনের বনে হারিয়ে গিয়ে... জমাট বাঁধা তুষার কেটে-কেটে যতদূর পারি হেটে-হেটে সেই অপার রূপ-রস-গন্ধ, তাড়িয়ে-তাড়িয়ে উপভোগ করে। গত রাতের অপূর্ণতার আফসোসে... পুড়ে পুড়ে পূর্ণতার প্রাপ্তিতে......... বরফের শ্বেত সুভ্রতায় হারিয়ে গিয়ে......... আবার জীপে উঠে............
এবার...... সোলাং ভ্যালীতে...... স্বপ্নের সীমানায়... আকাশের নীলিমায়......স্বর্গের কাছাকাছি...... অন্য গল্পে......!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৯:২৮