প্ল্যানছিল ফেরার সময় বগালেক থেকে ঝিরিপথ হয়ে ফিরবো, ততক্ষণে যারা নতুন (প্রথম পাহাড়ে এসেছে) তারাও পরিশ্রমের সাথে খাপ খাইয়ে নেবে, কিন্তু হায়... সবাই যে এভাবে ভেঙ্গে পড়বে তা কি ভেবেছিলাম? ভাবিনি।
সুতরাং, আগের রাতে গাইডের সাথে সবাই বসে ভোট দিলাম, ঝিরিপথ বনাম গাড়িপথ! এতে তেরো জনের ভোটে আমি আর একজন বিপুল ভোটে পরাজিত হলাম! তাই ঠিক হল গাড়ি পথেই রুমা বাজার যাব। বেশ মন খারাপ করে ঘুমোতে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই প্রস্তুত এবং প্রফুল্ল কিন্তু আমার মাথায় এডভেঞ্চারের নেশা! এই গাড়ি পথকেই কিভাবে এডভেঞ্চার বানানো যায়! এই ভাবতে-ভাবতেই গাড়ির কাছে গেলাম আর শুনছি আমাদের ড্রাইভার বেশ অশ্লীল সব শব্দ ব্যাবহার করছেন, প্রতিটি বাক্যের আগে ও পরে!
একটু অবাক লাগলো? ভোঁর বেলায় তো সবার মন মেজাজ সাধারনত ভাল ও খোশ মেজাজে থাকে, কিন্তু এর সমস্যা কি? কাছে যেয়ে কথা বলতে শুরু করাতেই বুঝেগেলাম, ইনি সকাল-সকালই মহুয়ার নেশায় মত্ত! ব্যাস, সাথে-সাথে আমার মাথায়ও দারুন দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল। গাড়ি ছাড়ুক, আমিও এডভেঞ্চার শুরু করবো! রক্ত আবার চঞ্চল হল, আমি আবার নেশাতুর হলাম, আমার এডভেঞ্চারের নেশায়!
গাড়ি চলতে শুরু করলো, কিছুদূর আসার পরে, সবাইকে নামতে হবে, একটা রিস্কি সাকো পেরতে হবে, সবাই নামতে শুরু করলো, আমি নামলামনা! তাই দেখে ড্রাইভার আমার উদ্দেশ্যে অত্যন্ত কর্কশ গলায় বলে উঠলো...
“ওঁই হালায়, নামে না ক্যারে? মইরবার চায়!”
“তুমি যা চালাও? ভ্যান গাড়ির নাহান, প্যানপ্যান কইরা! যাও, ভ্যান চালাও গিয়া!”
আমার ক্ষেপীয়ে তোলা উত্তর।
আমার কথা শোনা মাত্র, হেল্পার দাঁতে দাঁত কেটে, আমাকে ইশারা করলো, ড্রাইভার কে না খ্যাপাতে, তাতে ও ভীষণ স্পিডে ও রিস্কি চালাবে!
“আরে আমি তো ওইটাই চাই!”
এবার ড্রাইভার, আমার কাছে এসে বলল “আমি চালামু, আমার নাহান, তুই পারবি, ছাদে যাইতে?”
পারলে কি হইব? আমার উত্তর।
“আমার তিনডা এক্সিডেন্টের রেকর্ড আছে, এই রুমা বাজার আর বগালেকে, দুইডা মরছে! তারপর থেইকা স্পিড কমাইয়া চালাই”,
“ তুই পারলে ছাদে যা, আমি চালামু, দেহি কেমন পারছ, মা-বাপ কইয়া, থামাইয়া, নিচে নাইমা খেঁচায় ঢুকবি”।
পারলে কি দিবি? আমার উত্তর,
“তুই যদি রুমা বাজার তরিত, ছাদে যাইতে পারস? তো, তর ভাড়া লাগবনা, যা।
নাহ, আমি যদি যাইতে পারি তুই আমারে ৫০০ টাকা দিবি, তর ভাড়া তরে দিয়া দিমু, রাজি?
আমার জিজ্ঞাসা?
“হ, ঠিক আছে, ওঠ ছাদে......” ড্রাইভারের উত্তর।
ব্যাস...... শুরু হল, এডভেঞ্চার আর উম্মত্ত ড্রাইভ, আমিও প্রস্তুত আমার সকল নিরাপত্তা সরঞ্জাম আর দোয়া কালাম নিয়ে। আর এর আগেও যে, তিনবার চাঁদের গাড়ির ছাদে করেই রুমা থেকে বগালেক গিয়েছি সেই অভিজ্ঞতা সাথে নিয়ে! আমার আগের অভিজ্ঞতার কথা বলিনি, তাতে ও রাজি হবেনা ভেবে, আর আমার ৫০০ টাকা রোজগারের চিন্তা করে, যা আমার পরবর্তী ভ্রমনের জন্য প্রথম সঞ্চয় হিসেবে জমা হবে ভ্রমন বাজেটে!
এরপরে, সে এমন স্পিডে চালালো এবং প্রায় সেই সমান স্পিডেই বাক নেয়া শুরু করলো, যে চরম শক্ত সামরথ দুই-তিন জন বমি করতে লাগলো, বিভিন্ন গাছের ডাল-লতা-পাতা-বাসের চিকন ও ধারাল কঞ্চি আমাকে ক্ষণে-ক্ষণে ছোবল মারতে লাগলো। আমার গাল-মাথা-ঘাড়-গলা-হাত মোট কথা শরীরের যে টুকু উন্মুক্ত ছিল সব জায়গায় চাবুকের ফলা বসে গেল, তীব্র বাতাসে চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগলো, ঝরঝর করে, নিশ্বাস নিতেও কিছুটা কষ্ট শুরুহল, বাতাসের তীব্রতা আর গাড়ির প্রচণ্ড গতির কারনে।
আর প্রতিটা বাঁক যেন ছিল, এক-একটা মরণ ফাঁদ! কারন, বাঁকের কাছে এসেই, সে গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে বাঁকটা নেবার চেষ্টা করে! এতে করে যেটা হয়, গাড়ি কাঁত হয়ে যায় অনেকখানি আর যখন উপরে ওঠে, গাড়ি এতটা খাড়া হয়ে যায় যে, ধরে থাকাও মুশকিল! আর যখন, নিচে নামে, তখন ছিটকে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা!
এভাবেই চলে এলাম রুমা বাজার! বেশ কিছুটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে! পুরো এডভেঞ্চারে এবারই প্রথম ঔষধ-পত্র বের করতে হল, কিছুটা শুশ্রশার জন্য। ভাড়া দেয়া শেষ, নগদ ৫০০ টাকা! এডভেঞ্চার-সাহস আর চরম ঝুঁকির পুরস্কার! তবে স্বীকার করছি যে, এই এডভেঞ্চারে নিজেকে রক্ষা আর চ্যলেঞ্জে জয়ের নেশার স্বার্থে, পাহাড়কে উপভোগ করতে পারিনি একটুও! এই এডভেঞ্চারের তৃপ্তি জয়ী হওয়া আর অতৃপ্তি পাহাড়কে উপভোগ ও আলিঙ্গন করতে না পারা!
সুতরাং...... এবার তবে পাহাড়কে আলিঙ্গনের পালা, রুমা থেকে বাসের টিকেট কাঁটা হল, দের ঘণ্টা পরে বাস ছাড়বে, তো চল এই ৪ কিমি আমরা হেটে যাই? প্রস্তাবে অনেকেই নিমরাজি, কিন্তু কেউই তেমন আপত্তি করেনি, তাই হেটেই চলে এলাম বাস স্ট্যান্ডে, পাহাড়দের দেখতে, দেখতে...
বাস ছাড়তে আরও একঘণ্টা দেরি, চলে গেলাম ব্রিজ পেরিয়ে এক পাহাড়ের ঝিরিঝিরি গাছের ছায়ায় এক ঘণ্টার জন্য নিজেকে, নিজের মত করে পাহাড়কে, একা ও নির্জনে নিশ্চুপ ভাবে নিজের করে নিতে। কি দ্রুততায় যে একঘণ্টা কেটে গেল, বুঝতে পারলাম না!
বাসে উঠবো, এমন সময় মনে হল, আরে পাহাড় দেখা তো শেষ হয়নি! এখনো তো সুযোগ আছে! যেই ভাবা, সেই কাজ, নির্ধারিত সিট একজন সিট ছাড়া যাত্রীকে দিয়ে, উঠে পরলাম ছাদে! এবার সত্যিই আনন্দ, পাহাড় কে এতো নিজের করে, এভাবে উজাড় করে পাওয়ার ও দেখার আনন্দ, আমার চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়, ছোট-বড়-মাঝারি বিভিন্ন আকৃতির ও ধরনের পাহাড় আমার চারপাশ ঘিরে, সে এক অনন্য আনন্দ, শুধুমাত্র সত্যিকারের পাহাড় প্রেমীই এই ভালোলাগা অনুধাবন করতে পারবেন.........
পরামর্শঃ আপনিই যদি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম এবং সবার জন্য নির্ভরশীল ব্যাক্তি হন? তবে, এমন এডভেঞ্চার না করাই বাস্তবসম্মত।
মন তো চায়না যেতে....তবুও যেতে হয়... জীবন ও প্রয়োজনের মায়ায়... আবার আসব ফিরে সেই ভরসায়......
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৯:২৪