বন্ধুরা, অনলাইন পত্রিকা বিডি টুয়েন্টি-ফোর লাইভে গতকাল প্রকাশিত আমার গল্প ‘চতুর্থ অষ্টপ্রহরে যা হয়’ । বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম ।
প্রকাশিত গল্পের লিঙ্কঃ এখানে ক্লিক করুন ।
চতুর্থ অষ্টপ্রহরে যা হয়
…প্রায়ই ঘটনাটি ঘটে। যেমন আজও ঘটল।
রহমান সাহেবের স্ত্রী তাঁর সাথে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। এবার কিন্তু তিনি সিরিয়াস। আর রহমান সাহেবের ঘরে ফিরে আসবেন না। সারাদিন গাধার মত খাটুনি, তারপর আবার একটু উনিশ-বিশ হলেই ছোটে কর্তার মুখ। মানুষের তো নয়ই, যেন বাঁদরের মুখ। যেই মুখে গ্রহন, সেই মুখে বর্জন।
এ সংসারে হামিদার সামান্য পরিমাণ অধিকার নেই। মানুষজন গর্ব করে বলে ‘আমার সংসার’ ! তিনি কখনো এই কথাটি বলতে পারেননি। কেমন যেন কথাটি বলতে গেলে কোথায় আটকে যায় তাঁর। ঐ যে কাজের বুয়া রহিমা আছে না, এ সংসারে ঠিক তাঁর মতই যেন হামিদার আবস্থান। এতদিন দুই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি এ সংসারে খুঁটি গেড়ে থেকেছেন। রহমান সাহবের সব অত্যাচার তিনি মুখ বুজে মেনে নিয়েছেন। আর না ! তাঁর দুই ছেলেই এখন পড়াশুনার জন্য বাইরে থাকে । এখন আর হামিদার কোন পিছুটান নেই । যে খুঁটি এতদিন তিনি অনিচ্ছায় গেথে বসেছিলেন, আজ তা উপড়ে ফেলতে হামিদা মরিয়া হয়ে উঠেছেন । কেন অযথা তিনি এ সব সহ্য করবেন! ভেবেছে কী লোকটা! তাঁর যাবার কোন জায়গা নেই? যা খুশি তিনি বলে যাবেন আর হামিদা ঘরের কোনে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে যাবে? অসম্ভব! যদি একান্ত আত্মীয়স্বজনের কাছে তাঁর একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই না হয় তবে এতবড় পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ঠিকই তাঁর জায়গা হয়ে যাবে । লোকটার স্বভাব দিনদিন হয়ে যাচ্ছে পশুর মত । একজন শিক্ষিত মানুষের মুখের ভাষা এই হতে পারে! আজ কী একটা বিশ্রী গালি দিয়ে বসল! ভাবে হামিদা । রহমান সাহেবের গালির কথা মনে করতেই হামিদার গালভর্তি একগাদা থুথু এসে জমা হল । হামিদা শব্দ করে সামনে থুথু ফেললেন।
রহমান সাহেব রাগে কাঁপছেন। তিনি একটু আগে তাঁর স্ত্রীকে যে গালিটি দিয়েছেন তাতে তিনি সন্তুষ্ট না। তার অন্য একটা ইচ্ছা করছে। ঐ যে তাদের পাশের বাড়ির রতন, রিক্সা চালায়। যে রহমান সাহেবকে ডাকে ‘রোমান ছার’ বলে। আর রহমান সাহেব প্রতিদিন একবার করে তাকে উচ্চারণ শেখান তিনি রোমান ছার না, রহমান তাঁর নাম ; সেই রতন। যে রাগের মাথায় তাঁর স্ত্রীকে দেয় বেদম মার, আর ওর স্ত্রী’টা মার খেয়ে চৌদ্দ পুরুষের বিলাপ তোলে। সেই মার মারতে ইচ্ছে করছে হামিদাকে। যেন এখনি দৌড়ে গিয়ে ধরেন হামিদার চুলের গুছি। তারপর সেই মহিষ পেটানো মার। রাখালেরা যেমন বিশৃঙ্খল মহিষকে উন্মাতালের মত মারে। এলোপাথাড়ি ঘুসি আর লাথি। তারপর রতনের বউয়ের মত হামিদা যখন আত্মবিলাপে কেঁকিয়ে উঠে বলবে, ‘বাবা রে, মা রে, গেছি রে, আমারে মাইরা হালাইলরে, ও আল্লাগো!’ ঠিক তখনই তিনি শান্ত হবেন।
হামিদা একটা গাধি! না, তাঁর চেয়েও নিকৃষ্ট। রহমান সাহেব মনে মনে বললেন, ‘আমারে ভয় দেখায়। আরে তুই চইল্যা গেলে আমার কী, অ্যাঁ? আমি তো দুইটা দিন বাড়িতে শান্তিতে থাকমু। আবার দুই দিন পর বেহায়ার মত নিজেই আইস্যা পড়বি। যা পারলে থাক গিয়া। দেখি তোর মু্রোদ কত! আর যেন তোরে এই বাড়িত না দেখি।’ কথাগুলো যদিও মনে মনে বললেন রহমান সাহেব তবুও হামিদা বুদ্ধিমান হলে তাঁর মুখভঙ্গি দেখে বুঝে নেয়ার কথা। তিনি আবার মনে মনে বললেন, ‘হামিদা একটা গাধি, ওর বুঝার কথা না।’
হামিদা চলে এলেন বাবার বাড়ি। বাবা মা তো আর বেঁচে নেই, বড় ভাই-ই এ বাড়ির সব।
ভাবী তাকে দেখে সহাস্যে বললেন, ‘কি ব্যাপার! আবার ঝগড়া?’
হামিদা গম্ভীর মুখে বললেন, ‘হু, আর যাব না । একেবারে চলে আসছি ।’
ভাবী প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেন, কী বলে ! একবারে চলে আসছে মানে কি? ডিভোর্স হয়ে যায়নি তো আবার !
তিনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঘটনা কী বল তো?’
‘আমি আর ঐ বাড়ি যাব না। ওকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিতে বলবো।’ অনেকটা জোরালো গলায় বললেন হামিদা।
ভাবী এবার স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন।
তাদের ঝগড়া হয়েছিল সন্ধ্যা বেলা। এখন রাত। মানে ঝগড়ার প্রথম প্রহর।
রহমান সাহেবের খুব ভাল লাগছে। প্রফুল্ল চিত্ত। নির্জনতা কখনো কখনো মানুষের মনে প্রশান্তি ডেকে আনে।
রহমান সাহেব বাড়িতে একা। নিজের মনে তিনি ঘুরছেন, বই পড়ছেন, টি. ভি. দেখছেন, আবার মাঝে মাঝে তিনি গুনগুনিয়ে গানও গাইছেন। তাঁদের সময়কার ভালোবাসার গান, বিরহের গান, আনন্দের গান। আজকালকার গানগুলো আর গান নয়, ওসব বেশিরভাগই আবর্জনা। তিনি বলেন, ‘ডাস্টবিন!’ এখনকার গান শুনলেই তাঁর গা জ্বলে যায় রাগে। রাগ রহমান সাহেবের ব্যাধি। স্কুল শিক্ষকদের মেজাজ এমনি একটু খিটখিটে ধরণেরই হয়।
তিনি গানের প্রথম কলি গাওয়ার পর দ্বিতীয় কলিতে এসে থেমে গেলেন। তাঁর মনে পড়ে গেল প্রথম প্রেমের কথা, কিশোরউত্তীর্ণ নবযৌবনের প্রেম। ঠিক গানের এই কলিটি তাঁর প্রেমিকা কোন এক চিঠিতে তাঁকে লিখে পাঠিয়েছিল। ‘ওগো তুমি এমন কেন………’
কত আর বয়স তখন তাঁদের! এই চৌদ্দ কি পনেরো। রুপালি ছিল তাঁর এক বছরের ছোট। লুকিয়ে লুকিয়ে ওর সাথে দেখা করা, দুজন দুজনকে ভালোবাসার কথা বলা, একটু একটু করে কাছে টেনে নেয়ার ইচ্ছা, ভয়ে ভয়ে রুপালীর হাত ধরা, চিঠির আদানপ্রদান।
‘ওফ কত যে মধুর ছিল সেসব দিনগুলো!’ রহমান সাহেব আফসোস করলেন।
একদিন ঠিক অল্পের জন্য তারা ধরা খেলেন না। সেদিন বৃষ্টির দিন ছিল। ঝুমঝুমানি বৃষ্টিতে দুজন হাত ধরাধরি করে ভিজছেন। সদ্য ফোটা কদম ফুলে তিনি তাঁর প্রিয়াকে প্রেম নিবেদন করছেন। ঠিক এমন সময় কারো কথা শুনে তাঁরা চমকে উঠলেন। তারপর যে যার মত দৌড়ে পালালেন।
এ পর্যায়ে রহমান সাহেব শব্দ করে হেসে ফেললেন । নির্জন বাড়ি তাঁর হাসির প্রতিশব্দ তাঁকে ফিরিয়ে দিল । তারপর যা ঘটেছিলো তাঁর পুরোটাই দুর্ঘটনা । কিশোর প্রেমের ফলাফল যা হয়! এসব তিনি মনে করতে চান না।
কিছুদিন আগে রহমান সাহেব গ্রামের বাড়িতে যাবার পথে বাসস্ট্যান্ডে হঠাৎ দেখা হয়েছিল রুপালীর সাথে। সাথে ওর হাসব্যান্ড ছিল। প্রথম বারে তিনি চিনতে পারেননি। রুপালী পেছন থেকে তাঁকে ডেকে উঠল, ‘আরে রহমান ভাই না!’
রহমান সাহেব ঘুরে তাকালেন। রুপালী তাঁর দিকে এগিয়ে এলো। ওর পিছু পিছু লোকটিও। রহমান সাহেব চিনতে পারছেন না। তিনি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওদের দুজনের দিকে। রুপালী পুনরায় বলল, ‘আমাকে চিনতে পারেননি রহমান ভাই! আমি রুপালী ।’
রুপালী নাম শুনেই রহমান সাহেব একটু যেন চমকে উঠলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘কেমন আছ রুপালী? সেই কত বছর পর দেখা!’
রুপালী প্রশ্নের ধারেকাছে না গিয়ে পাশের লোকটিকে দেখিয়ে বলল, ‘উনি…’
কথাটি বলতে হল না আর, রহমান সাহেব বুঝে গেলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন লোকটির দিকে। বললেন, ‘আমি রহমান!’
লোকটি বলল, ‘আমি…….’
রহমান সাহেব মনে করতে পারছেন না লোকটির নাম।
রুপালী এবার রহমান সাহেবের দিকে ইশারা করে তাঁর হাসব্যান্ডকে বলল, ‘উনি আমাদের রহমান ভাই। খুবই ভাল লোক। ঐ যে তোমাকে বলেছিলাম না!’
খুব আপন ভঙ্গীতে কথাগুলো বলল রুপালী। টানা স্বরে বলে গেল কথাগুলো, যেন জানত একটু পর এ কথাগুলো তাকে বলতে হবে, তাই আগে থেকে প্রিপারেশন নেয়া ছিল। লোকটি মাথা নাড়লেন। কিছু বললেন না। গম্ভীর চেহারা, অনেকটা বেরসিক ধরনের। যেন কিছুতেই তাঁর মাথাব্যাথা নেই। পৃথিবী উল্টে যাক, তাঁর কি!
রহমান সাহেবের মনে তখন প্রশ্ন এসেছিলো, ‘আচ্ছা, রুপালী তাঁর হাসব্যান্ডের সাথে আমাকে নিয়ে কী গল্প করেছিলো? রুপালী কি সব বলে দিয়েছে তাহলে? কই আমি তো স্ত্রীকে কিছুই বলিনি!’
এরপর পূর্ব দিক থেকে একটি বাস চলে এলে দু’জন তড়িঘড়ি করে বাসে উঠে পড়ল। কিছু বলারও প্রয়োজন বোধ করেনি রুপালী, অথবা বলার সময় ছিল না তার। এমন কি পেছনে ফিরে তাকালোও না। হয়ত এমন মুহূর্তে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না। অথচ রহমান সাহেবের কত কথা বলতে ইচ্ছে করেছিল। আরও কিছু সময় রুপালীর সামনে থাকতে ইচ্ছে হয়েছিলো।
রহমান সাহেব একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘জীবন এমনি হয়!’
তিনি মনে মনে ভাবলেন তাঁর সাথে রুপালীর বিয়ে হলে কেমন হত। তাঁর খুব জোরের সাথে মনে হল, তারা অবশ্যই সুখি হতেন।
এভাবেই কেটে যায় রহমান সাহেবের প্রথম চার প্রহর।
সকালে ঘুম থেকে জেগেই প্রতিদিনের অভ্যাসবশত তিনি তাঁর স্ত্রীকে ডাকলেন, ‘হামিদা! হামিদা! আরে কই গেলা!’
তিনি রেগে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর মনে পড়ল হামিদা বাড়িতে নেই। গতকাল ঝগড়া হয়েছিল তাঁদের। তাঁর স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।
তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। ওজু করে নামাজ পড়ে প্রাতঃভ্রমণে বের হলেন। ফিরে আসতে আসতে সাড়ে সাতটা বেজে গেল। তিনি স্কুলে রওনা হবেন আটটার সময়। বাসা থেকে স্কুল একঘণ্টার পথ। নয়টায় থেকে ক্লাস শুরু। ঝামেলা এড়ানোর জন্য তিনি বাইরে হোটেল থেকে নাস্তা নিয়ে এলেন। নাস্তা খেয়ে স্কুলে রওনা হলেন।
স্কুল থেকে ফিরে আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেল। ফেরার পথে তাঁর পছন্দের বড় বড় চিংড়ি মাছ কিনে আনলেন। এরপর নিজে খুব সুন্দর করে রান্না করে তৃপ্তি সহ খেলেন। ছাত্রজীবনে একসময় মেসে থেকে লেখাপড়া করেছিলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা।
বিকেলে বারান্দায় টবে রাখা গাছগুলোতে পানি ঢাললেন। মরা পাতা, অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছেঁটে দিলেন। বিকেলটা মন্দ কাটেনি। তিনি মনে মনে বললেন, ‘ভালোই তো, একার সংসার ।’ প্রথম অষ্টপ্রহর কেটে গেল।
এরপর দ্বিতীয় অষ্টপ্রহরের প্রথম ভাগ শুরু হল। তিনি একই কাজ করলেন। কিন্তু আজ যেন জমাতে পারছেন না প্রেম কাহিনী। তিনি নতুন কোন উপায় ভাবলেন। উপায় বের হল। তিনি আবার বললেন, ‘নিঃসঙ্গতা মন্দ কি!’ এরপর আরও দুটো অষ্টপ্রহর এলো গেলো ।
হামিদার সময় ভালোই কাটছিল। এ বাড়িতে সে কতগুলো নাতি নাতনী পেয়েছে। ওরা যেন হামিদাকে পেয়ে ছায়ার মত ঘিরে ধরল গল্প শোনার জন্য। হামিদাও যেন গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসল ওদের সাথে। ক্লান্তিহীনভাবে গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে সে।
‘তারপর রাজপুত্র কী করলো জানো?’
ওরা একসাথে বলল, ‘কী করলো?’
‘রাজপুত্র পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে…’
কথাটি শেষ না হতেই ভাবী হাসতে হাসতে রুমে ঢুকে বললেন, ‘হামিদা, জামাই আসছে।’
হামিদা প্রথমে একটু চমকে উঠলেন। তারপর যেন একটু লজ্জা পেলেন এবং তারও পরে গম্ভীরস্বরে বললেন, ‘ও আসছে কেন? আমি কিন্তু আর ঐ বাড়ি ফিরে যাব না।’
চতুর্থ অষ্টপ্রহরের প্রথম প্রহর। রহমান সাহেব রিক্সায় করে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। তিনি খুব নিবিড় হয়ে বসেছেন হামিদার পাশে । তার কোলের উপর হামিদার ডান হাতটি তিনি চেপে ধরে আছেন। হামিদা লজ্জা পাচ্ছেন। তিনি মনে মনে বললেন, ‘এই বয়সেও লোকটার পাগলামো গেলো না!’ তিনি ভীতু চোখে আশেপাশে মানুষজনের দিকে তাকাচ্ছেন।
রহমান সাহেব খুব রোমান্স নিয়ে হামিদার হাত ধরে আছেন। মাঝে মাঝে আঙুল দিয়ে আলতো করে ঘসে যাচ্ছেন হামিদার হাতের তালু কিংবা পৃষ্ঠদেশ। যেমন করে একদিন চেপে ধরতেন রুপালীর হাত। রহমান সাহেব মনে মনে বললেন, ‘আহ! জীবনটা মন্দ কী!’
সাইফুল্লাহ সাইফ