somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ অশরীরীর অমরত্ব

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৮:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবি: ওয়েব সাইট

আসিফ মাহমুদ দীর্ঘদিন ধরে একটি জোছনার অপেক্ষায় ছিলেন । সারারাত টেলিস্কোপ হাতে নিয়ে অসহায় হয়ে বসে থাকতেন আকাশের দিকে চোখ তুলে ।
আকাশের মেঘগুলো বড় এলোমেলো করে দিত তাঁকে । জোছনাকে তার কাল রঙের বিশালাকার শাড়ির আঁচলে ঢেকে রাখত ।
মাঝে মাঝে যখন বাতাসে শাড়ির আঁচলটি সরে গিয়ে ভেতরের অনাবৃত রমণীকে তিনি দেখতে পেতেন তখনই তার সমস্ত দেহ জুড়ে এক শিহরণ অনুভব করতেন । তার চেহারায় একটি ক্ষণস্থায়ী বিদ্যুৎ প্রবাহ বয়ে যেত । যেন এই মাত্র তার চোখে আকাশের বিজলী রশ্মির এক ফোঁটা তাকে ছুঁয়ে দিয়ে দূরে কোথাও উধাও হয়ে গেল । তার চোখ ঝলসে দিয়ে চোখের পলকে সে আলোক রমণী অদৃশ্য হয়ে যেত ।

আসিফ মাহমুদ একটি ছবি আঁকবেন । রাতের অনাবৃত জোছনার । যখন আকাশের একটি তারাও থাকবে না, একগুচ্ছ মেঘও নয় । যখন আকাশের উত্তপ্ত যৌবন থাকবে জোছনার শরীর জুড়ে । জোছনার রূপের দ্রুতি নিয়ে আলোকিত হয়ে উঠবে পুরো পৃথিবী । একটি রাতের জোছনাকে তুলে আনবেন তুলির আঁচড়ে । নিজের মনের চিত্রটি রূপ দেবেন রঙের ভাষায় ।
চিত্রশিল্পীর রঙ কথা বলে । শিল্পীর সাথে হাসে-কাঁদে, অনুভুতি বিনিময় করে ।
আসিফ মাহমুদ একটি চিলেকোঠার খুপরিতে থাকেন । খুপরির সামনের বিস্তৃত ছাদ তাঁকে প্রতিরাতে জোছনা দেখাতে ডাকে । তিনি জোছনায় ছবি আঁকার বন্দোবস্ত করেন ।
সব কিছুই যখন ঠিকঠাক করে তিনি ক্যানভাসের উপর রংতুলি স্পর্শ করেন তখনি যেন জোছনা একটু একটু করে নিজেকে লুকাতে শুরু করে তাঁর কালো শাড়ির অন্তরালে । তাঁকে শুধু নিজের ছায়াটুকু দেখায় । মূর্ত হয়ে কখনো ফুটে উঠার সুযোগ দেয় না শিল্পীর বিমূর্ত ছবিতে ।
নিশাচারি ক্ষুদার্ত শিকারির মত রাতভর তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন একটি কাঙ্খিত জোছনার জন্য । তার বহুদিনের অতৃপ্ত শিল্প সত্ত্বা এমন একটি ছবি আঁকতে চায়, যার নিখুঁত শিল্পে এমন একটি ছবি ধরা দেবে, যে ছবিকে তার সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মে স্থান দেয়া যেতে পারে ।
আজ আসিফ মাহমুদের স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে । তার দক্ষ চালনায় রঙ তুলি একের পর এক ধারণ করে চলছে জোছনার বিমূর্ততা । সৃষ্টির আনন্দে তার পুরো শরীর কাঁপছে । আজ তার জীবনের সফল শিল্পের একটি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে ।
হঠাৎ নিজের অসমাপ্ত ক্যানভাসের গভীরে কোথাও যেন তার চোখ আটকে যায় । তিনি চমকে উঠেন ।
যেন এতক্ষণ ধরে তিনি জোছনার নয়, কোন এক মানবীর চিত্র ধারণ করে চলেছেন তার রঙ তুলিতে । যেন তারই হাতে গড়া কোন এক মানবী পুরো দেহে জোছনার রঙ মেখে বসে আছে ।
আসিফ মাহমুদ ছবি আঁকা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ান । তিনি বুঝতে পারছেন না, জোছনা কীভাবে এক নারীমূর্তি ধারণ করল! ব্যাপারটা কেন এতক্ষণ তার চোখে পড়ল না!
কোথাও একটি হাসির শব্দ শুনতে পেলেন তিনি ।
ক্যানভাসে ফিরে তাকাতেই তিনি দ্বিতীয়বারের মত চমকে উঠলেন । তার ক্যানভাসে এবার এক জীবন্ত নারী তার দিকে তাকিয়ে হাসছে । চলচিত্রের পর্দার মত জীবন্ত সে নারী । তাঁর হাসি যেন কোন এক আলোক বর্ণালীর বিচ্ছুরিত ফোয়ারা । মুহূর্তেই আসিফ মাহমুদের বুকের কোথাও যেন একটি নিরবচ্ছিন্ন কম্পন শুরু হল । একটি শীতল প্রবাহ যেন সরীসৃপের মত তার মেরুদণ্ড বেয়ে নিচের দিকে নেমে যেতে শুরু হলো ।
আসিফ মাহমুদ উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কে তুমি?’
একটি ক্ষীণ অথচ তীক্ষ্ণ জবাব, ‘আমি অশরীরী ।’
অশরীরী শব্দটি যেন আসিফ মাহমুদের কানে এসে সাইরেনের মত বেজে চলল অনবরত । তার মাথায় একটি প্রদাহ শুরু হলো ।
আসিফ মাহমুদ একটু সময় নিলেন । নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলেন ।
এমন কী হতে পারে তিনি কল্পনা করছেন? তার সন্ধেহ, তিনি স্বপ্ন দেখছেন । স্বপ্নে অনেক কিছুই সম্ভব । ওসব তিনি বিশ্বাস করেন না ।
এবার একটি উচ্চহাসির শব্দ তরঙ্গিত হয়ে বায়ু মাধ্যমে অনেক দূরে কোথাও একাত্ম হয়ে মিলে গেলো ।
আসিফ মাহমুদ নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘মিথ্যে বলছ । তুমি শুধু আমার কল্পনা । আমি অলৌকিকতায় বিশ্বাস করি না । আমি কল্পনা থেকে ফিরে এলেই তোমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে । তুমি তোমার হাসির মতই উধাও হয়ে যাবে । তোমার অস্তিত্ব অসম্ভব, আমি বিশ্বাস করি না ওসব । অশরীরী বলে কিছু নেই ।’
একটু যেন অভিমানের ভঙ্গীতে মেয়েটি প্রশ্ন করল, ‘তাহলে আমি কে?’
আসিফ মাহমুদ বললেন, ‘তুমি মানবী । আমার কল্পনা, যাকে আমি সৃষ্টি করেছি, লালন করছি । যার ধ্বংসও আমি করতে পারি । এখনি তুমি চলে যাবে ।’
আসিফ মাহমুদ চোখ বন্ধ করলেন । আবার চোখ খোলার আগেই তিনি ধ্বংস করে ফেলবেন তাঁর কল্পনাকে ।
চোখ খোলার আগেই মেয়েটি বলে উঠল, ‘তুমি আমাকে ধ্বংস করতে পারবে না, যতদিন না নিজে ধ্বংস হবে । হ্যাঁ–মানছি, তুমি আমাকে লালন কর, তবে তা শুধু নিজের বাঁচার জন্য । আমি জানি, তুমি যেদিন থেকে তোমার প্রিয়তমাকে হারিয়েছ, সেদিন থেকেই আমাকে লালন করে আসছ । তুমি যতদিন বেঁচে থাকবে আমাকে ততদিন তোমার নিজের ভেতর বাঁচিয়ে রাখবে ।’
আসিফ মাহমুদ চোখ খুললেন । তাকে হতাশ করে দিয়ে মেয়েটি পুনরায় বলল, ‘কী বললাম না, আমাকে ধ্বংস করতে পারবে না, আমি শুধু তোমার কল্পনা নই?’
‘অশরীরীর কোন দৈহিক অস্তিত্ব নেই । অথচ কী অবলীলায় তুমি কথা বলছ, হাসছ, তুমি স্বশরীরী এক জীবন্ত নারীর মত আমার চিত্রে উঠে এসেছ, কিন্তু বলছ অশরীরী!’
‘তোমরা শিল্পীরা অশরীরীদের মানবী ভেবে ভুল কর । মানবীরা কখনো চিত্রে আসে না ।’
‘তুমি ভুল বলছ । পৃথিবীর সব বিখ্যাত চিত্রকর্মই মানবীর আদলে গড়া । কখনো তাতে অশরীরী স্থান পায়নি ।’
‘একটি ছবি বেঁচে থাকে যুগযুগ ধরে । জরা-মৃত্যু কখনো ছুঁতে পারে না ছবিকে; সময় ছবির বয়স বাড়াতে পারে না । অথচ তোমাদের মানবীরা ক’দিন বাঁচে, বল!’
‘চিত্রশিল্পীরা তাদের অমরত্ব দেয় । সেই অমরত্ব নিয়েই তাঁরা বেঁচে থাকে যুগের পর যুগ ।’
‘তোমাদের মানবীরা আমাদের অতীত, আমাদের দীর্ঘজীবনের এক স্বল্প পরিচিতি মানবীররূপ । চিত্রকরের দেয়া অমরত্ব আমাদের জন্য । তোমরা মানবীর যে ছবি আঁক তা অশরীরীদের একটি বেশ মাত্র ।’

আসিফ মাহমুদ এবার ঘুরে তাকান আকাশের জোছনার দিকে । জোছনা আবার নিজেকে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ফেলছে । তার ক্যানভাসের চিত্রের সাথে জোছনার পার্থক্য বেড়ে চলছে ।
অশরীরী একটু যেন ঠোঁটের কোনে সামান্য হানি এনে বলল, ‘কী! ছবি আঁকা বন্ধ করলে যে!’
আসিফ মাহমুদ একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আমি জোছনার ছবি আঁকতে ছেয়েছিলাম, কোন অশরীরীর ছবি নয় ।’
অশরীরী এবার কোমল কণ্ঠে বলল, ‘তোমার প্রতীক্ষিত জোছনাই আমি । ক্যানভাসের মত অন্তদৃষ্টি দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে দেখ ।’

আসিফ মাহমুদ এবার আকাশে চোখ রাখলেন ।
‘কী কোন মিল খুঁজে পাও! জোছনাই আমার আরেকটি সত্ত্বা । এবার আমায় বিমূর্ত অস্তিত্ব থেকে মূর্তে অমরত্ব দাও । আমি মানবের মাঝে অমরত্ব চাই ।’


সাইফুল্লাহ সাইফ
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×