সদরঘাট থেকে লঞ্চটি ছাড়ে ছাড়ে অবস্থায় । লঞ্চের খালাসি একটানা হুইসেল বাজিয়ে যাচ্ছে । সদরঘাটে হাজার হাজার লোকের ব্যস্ততা । লঞ্চে উঠার জন্য একদিকে যাত্রীদের ভিড়, অন্যদিকে লঞ্চে মালামাল উঠানোতে কিছু লোকের ব্যস্ততা । কুলীদের হাঁকডাক, চীৎকার, চেঁচামেচি । পাশে একটি লঞ্চ মাত্র ছেড়ে দিয়েছে । দুটো লঞ্চের একটানা হুইসেলে মাথা ধরে যাবার জোগাড় ।
ছোট্ট একটি কামড়া । দরজার দুই পাশে দুটি জানালা । একটি জানালার খানিকটা অংশ খোলা । সেই খোলা জানালার পাশে বসে উৎসুক দৃষ্টিতে সদরঘাটের চালচিত্র দেখছে অরিত্রি । বিছানার অপর কোণে চিন্তিত মুখে বসে আছে ইরেশ । লঞ্চটা ভালোয় ভালোয় ছাড়লেই হয় ।
সকল চিন্তাকে উপেক্ষা করে দুজনের মনে খেলে যায় আনন্দের ঢেউ । সহস্র বাধা বিপত্তি পার করে তারা আজ একে অপরকে পেয়েছে । অথচ তাদের এই মিলনটি ছিল একটি অনাকাঙ্কিত ঘটনা । ইরেশ ধরেই নিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তার সাথে অরিত্রির বিয়ে হচ্ছে না । কিন্তু তবুও কি করে আজ দুজন এত কাছাকাছি চলে এসেছে, এমনকি বিয়েও করেছে তা ইরেশের চিন্তার বাইরে । অবশ্য এর জন্য কম বেগও পেতে হয়নি তাদের । বিশেষ করে সব ধকল গেছে রিফাতের উপর দিয়ে । বলতে গেলে কৃতিত্বটা পুরো রিফাতের । রিফাত ইরেশের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ।
ঢাকায় বড় হয়েছে ইরেশ, অরিত্রি । তাদের পুরো নেটওয়ার্ক কেবল ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ । ঢাকার যেখানেই তারা থাকুক না কেন, তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে তা খুঁজে বের করা কোন ব্যপারই না । রিফাত দুজনের দায়িত্ব নিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে তার নানা বাড়িতে এদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ।
সবার চিন্তার বাইরে একটি দুর্গম এলাকায় যাচ্ছে ওরা; যাতে কেউ ওদের খুঁজে না পায়; কেউ বাঁধা হতে না পারে । বিকেলে লঞ্চ রওনা হলে, সারারাত চলে পরদিন সকালে পৌঁছাবে । লঞ্চে কেবিনের ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিল রিফাত ।
লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে । দুজনই যেন এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল । ইরেশ এসে কেবিনের জানালা দুটি খুলে দিল । এখনও পুরোপুরি শীত আসেনি । নদীর হিম বাতাস বেশ ভালো লাগছে । কেবিনের সামনে মুখোমুখি দুটি চেয়ার পাতা ।
কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে দুজন চেয়ার দুটিতে বসল । তাদের কাছে এই চির বাস্তবটিকে একটি পরাবাস্তব বলে মনে হয় । কিছুক্ষণ আগেও যারা ছিল প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল, কিছু সময়ের ব্যবধানে তারা এখন স্বামী-স্ত্রী । দুজনের মাঝে একটি লাজুকতা । কেউ কারোর সাথে প্রয়োজনের বাইরে কথা বলতে পারছে না । একজন অন্যজনের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না । আথচ এই তারাই কদিন আগেও চোখা-চুখি খেলত । খেলাটি হল, কে কতক্ষণ কার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে ।
অরিত্রি মুখে সামান্য হাসি এনে ইরেশের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ কত তারিখ ?
ইরেশ হাসিমুখে বলল, আটাশ সেপ্টেম্বর ।
অরিত্রি বিরক্তির সাথে বলল, তাতো আমিও জানি আজ আটাশ সেপ্টেম্বর । কিন্তু বাংলা কত তারিখ ?
ইরেশ বলল , জানি না ।
জান না মানে ? আজ এমন একটি শুভদিন । তার তারিখটাও মনে রাখবেনা ?
তুমিও মনে রাখতে পারতে ?
কে বলল, আমি মনে রাখিনি ? আজ বাংলা ১২ই আশ্বিন ।
তাহলেতো জানই, আমাকে জিজ্ঞেস করলে কেন ?
কারন আমি দেখছিলাম তুমি কতটা সিন্সিয়ার । যার সাথে বাকি জীবনটা কাটাব, মানুষটি কেমন হবে ।
আমাকে কেমন দেখলে ?
শূন্য ।
শূন্য মানে ?
শূন্য মানে, অনুভূতিহীন ।
এতদিন পরীক্ষা করনি ?
দেখ, আজ একটি বিশেষ দিন । তুমি কিন্তু রেগে যাওয়ার মত কথা বলছ । তোমার সাথে আজ আর কোন ঝামেলা করতে চাই না ।
তাইতো, বিশেষ দিনে দেবীকে রাগানো ভারী অন্যায় । হ্যাঁ, আমি মানছি আজকের দিনটিকে বিশেষভাবে মনে রাখার দরকার ছিল ।
দুজন হেসে উঠে । তারপর একটি নীরবতার কাল ছুঁয়ে যায় নীরব প্রকৃতির সাথে ।
কি অদ্ভুত! ইরেশের কাছে অবাক লাগে । তাদের তিন বছরের সম্পর্কের মধ্যে একটি বারও এরকম পরিস্থিতিতে পরতে হয় নি তাকে । সে কোনভাবেই তার লাজুকতা কাটাতে পারছে না । যেন কোন এক আপরিচিত মানব-মানবীর এটাই প্রথম পরিচয়।
নদীতে দিন-রাত্রির অবস্থান বিনিময়ের মুহূর্ত চলছে । বৃত্তাকার টকটকে লাল সূর্যটি নদীর বুকে নিজেকে লুকানোর চেষ্টায় নিয়োজিত । প্রকৃতি যেন লাল রঙের শাড়ি পড়ে আছে । পড়ন্ত বিকেলে নদীর বুকে এক ঝাঁক বালিহাঁস নেমে এলো আকাশ থেকে । সে কি দৃশ্য! এ যেন সত্যিকার অর্থে এক কল্পনা জগত আর বাস্তব জগতের মিলন মুহূর্ত !
অরিত্রি বুঝতে পারল, ইরেশের অস্বস্তির কারন । প্রচণ্ড লাজুক ছেলে ইরেশ । ইরেশের সরলতা লাজুকতাই অরিত্রির এত ভাল লাগে । অরিত্রির মনে হয় ঠিক এরকম একটি জীবনই চেয়েছিল সে । যে জীবন জড়িয়ে থাকবে ইরেশের মত একটি সহজ সরল ছেলেকে ঘিরে । যাকে প্রচণ্ড ভালবাসলেও মনে হয় ভালবাসা পূর্ণ হয় নি ।
অরিত্রি ইরেশের অস্বস্তি কাটানোর জন্যই হঠাৎ টেবিলের উপর রাখা ইরেশের শীতল হাতটি স্পর্শ করল । চমকে উঠে ইরেশ তাকাল অরিত্রির দিকে ।
প্রকৃতি তখন পুরোপুরি বদলে ফেলেছে নিজেকে । আকাশে হাজার তারা আর চাঁদের আলোতে নদীর পানি রূপালী রং ধারণ করে আছে ।
ইরেশও হাতদুটো দিয়ে চেপে ধরল অরিত্রির হাত । অরিত্রির হাতের স্পর্শে ইরেশের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল । এক অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দুজন দুজনের দিকে । এমন দৃষ্টিতে ইতোপূর্বে কেউ কারোর দিকে তাকায় নি । ইচ্ছে করে একে অপরকে আরও কাছে টেনে নেয় । প্রচণ্ড স্পর্ধায় জেগে উঠে ইরেশ । উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে অরিত্রিকে । অরিত্রিও শিহরিত হয় তাতে । ভাললাগার এক অত্রিপ্ত সুখসমুদ্রে তলিয়ে যায় দুজন ।
পাশে দাঁড়ানো কে একজন যেন হঠাৎ খাক দিয়ে উঠে । অরিত্রি পেছনে তাকিয়ে দেখে তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলো দাড়িয়ে দেখছে কয়েকজন লোক । অরিত্রি ইরেশকে বাঁধা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করে নেয় ইরেশের বাহুডোরের মধ্য থেকে । লজ্জা পেয়ে দুজন চলে আসে নিজেদের কেবিনে ।
রাত বারোটা । লঞ্চ চলছে পূর্ণ গতিতে । কেবিনের জানালা খোলা । যতদূর দেখা যায় শুধু নদী আর আকাশের একাত্মতা ।
লঞ্চ মাঝ নদীতে চলছে । এখন কিছুটা শীত বেড়ে গেছে । দরজা জানালা বন্ধ করে দেয় ইরেশ ।
কেবিনের ভেতর ফাঁকা স্থানটুকুতে পায়চারী করতে থাকে সে । অরিত্রি একটানা তার ডাইরিটা লিখে চলছে ডিম লাইটের হলুদ আলোতে । আলোটি যেন তার চারপাশে এক অপার্থিব দ্রুতিতে, তার অস্তিত্বটি ধারণ করে আছে । যাকে অবলম্বন করে, কল্পনার গভীর মনোজগতে হারিয়ে যাওয়া যায় ।
ভালবাসার একটি রঙ আছে । সেটি কেমন ? লাল, কালো, বা পার্থিব জগতের কোন রঙের সাথেই হয়ত তার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না । এটি একটি কল্পনার রঙ । ভালবাসার অনুভূতি দিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে হয় । ভালবাসার রঙ একেক জনের কাছে একেক রঙের মনে হতে পারে ।
ইরেশের মনে হয়, ভালবাসার রঙ বুঝি এমনই হয় । অরিত্রি এই রঙের মাঝে নিজেকে সমর্পণ করে তার ভালবাসার কথাগুলো লিখে চলছে । দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তার চেষ্টার ত্রুটি নেই । লিখা যেন শেষ হয় না ।
অরিত্রির টেবিল থেকে কিছুটা দূরে একটি চেয়ারে এসে বসল ইরেশ । পূর্ণ মনোযোগে লিখে চলা অরিত্রির দিকে তাকিয়ে রইল সে । ডিম লাইটের হলুদ আলোতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে অরিত্রিকে । পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখছে ইরেশ । সৃষ্টিকর্তার নিখুঁত শিল্পকার্যে যেন সৃষ্টি করা হয়েছে অরিত্রিকে ।
ডাইরি লিখার কোন এক মুহূর্তে অরিত্রির নিষ্পাপ চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল এসে পড়ল ডাইরির সাদা পাতায় । তবু অরিত্রি লিখে চলছে । চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীর পায়ে ইরেশ এসে দাড়ায় অরিত্রির সামনে । মনে মনে ইরেশ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে, ‘এই মানুষটি যেন কখনো আমার কারনে কোন কষ্ট না পায় ।’
হঠাৎ ইরেশকে সামনে দেখে অরিত্রি অবাক হয়ে যায় । অরিত্রির সামনের ডাইরিটি বন্ধ করে, ইরেশ তার ডান হাতের দুটো আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে অরিত্রির সিক্ত চোখের পাতা । গভীর মমতায় বুকে টেনে নেয় অরিত্রিকে । ভালবাসার সুখের আবেশ বয়ে চলে এই কপোত-কপোতির মাঝে ।
হঠাৎ কি যেন এক আশঙ্কায় দুজনের হৃদয় কেঁপে উঠল । কিছু বুঝে উঠার আগেই দুজন-দুজন থেকে আপনাআপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে লাগল ।
যখন বুঝতে পারল কি ঘটে চলছে তাদের জীবনে, ইরেশ তখন ছুটে এলো দরজার কাছে । শরীরের সব শক্তি প্রয়োগ করেও দরজাটি খুলতে পারল না, প্রবল জলের চাপে । অরিত্রিও চেষ্টা করে চলল । দিশেহারার মত কয়েকবার জানালা খোলার চেষ্টা করল দুজন কিন্তু ফল শূন্য; অগত্ত জলের ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করল । কিছুক্ষনের মধ্যেই জল বেড়ে বুক পর্যন্ত চলে এলো ।
যখন বুঝতে পারল, জলের কাছে তারা হার মানতে বাধ্য তখন দুজন-দুজনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ।
পরিশিষ্ট
দুদিন পর লঞ্চটি উদ্ধার করতে গিয়ে ডুবুরীরা কেবিনে আটকে থাকা মৃত যুগলবন্দী একজোড়া লাশ দেখতে পেল ।
শীতের দিন বলে, লাশ যুগল অগলিত রইল । মৃত লাশ যুগলকে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না পরস্পর থেকে; বাধ্য হয়ে যুগলবন্দী অবস্থায়ই লাশ তীরে তুলে আনা হল ।
যেন মৃত লাশ যুগল ঘোষণা করে দিল, “আমাদের বন্ধন অবিনশ্বর, প্রলয়ঙ্করী কোন বাঁধাই পারবে না বিচ্ছিন্ন করতে আমাদের এই যুগলবন্ধন ।”
সাইফুল্লাহ সাইফ