ক্যাপশনঃ প্রফেসর ড. অনির্বাণ মোস্তফা, ঘুড়ি উৎসব-১৪২১
এক্সিডেন্টে আহত অবস্থায় গাজী মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া চারুকলার ছাত্র অমিত চিকিৎসার অভাবে মারা গেলো। আমরা ছাত্ররা এ নিয়ে উত্তেজিত অবস্থায় জবাবদিহি চাইতে গাজী মেডিকেলের সামনে গেলাম। একে একে পুরো এলাকা ঘিরে রাখলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। এদিকে লাশ সৎকারের জন্য অমিতকে নিয়ে যাওয়া হলো নিজ গ্রামে।
স্যার ফোন দিয়ে জানালেন ওনি লাশের সাথে যাচ্ছেন অমিতের গ্রামের বাড়িতে, আমরা যেন শান্ত থাকি, কোন ঝামেলা না বাঁধিয়ে বসি! অমিতদের গ্রামের বাড়ির ঘরটা ছিলো খড়ের ঘর। অমিতের মৃত্যুর খবর শুনে ওদের গ্রামের সকলে ওদের বাড়ির দিকে এসে ভিড় করতে থাকে। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে একটা আত্মচিৎকারকে আলাদা করা গেলো সহজেই। অমিতের মায়ের চিৎকার। যেন আকাশ ফেটে কেউ চিৎকার করছে।
লোকমারফতে জানা গেলো অমিতের আরো ১টা ভাই ছিলো। বছর কয়েক আগে সেও বাড়ির পাশের পুকুরে ডুবে মারা গেছে। গরীব পরিবারটির একমাত্র সম্বল বলতে কেবল অমিতই ছিলো! আজ অমিত নেই, বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকুও হারালো আজ! কে দেবে সহায়, এ অসহায় পরিবারকে?
সব শুনে স্যার পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে লাশ সৎকারের আয়োজন চলছে। গ্রামের শশ্মানটি অমিতদের বাসা থেকে বেশ দূরে। লাশ নিয়ে যেতে হবে আরো অন্তত ১ কিলোমিটার দূরে। বাড়ির উঠোন থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শশ্মানে। চারদিকে চারজন কাঁধে নিলো লাশের বহর। তাদের একজন অভি স্যার। এই দীর্ঘ রাস্তা পারি দেয়াতে বাকি তিন পাশের তিনজন কাঁধ পরিবর্তন করলেন ঠিকই, স্যার করলেন না। পুরো রাস্তাতে একটা শব্দও করলেন না! পাহারসমান অনুভূতিগুলো পাথর চাপা দিয়ে নিজের ছাত্রকে নিজ হাতে শুইয়ে দিয়ে এলেন অন্তিম শয়নে!
ক্যাপশনঃ অমিতকে কাঁধে নিয়ে অন্তিম শয়নের পথে অভি স্যার।
২।
গল্লামারি মোড়ে ছাত্রদের সাথে কথাকাটাকাটির জের ধরে পুলিশের সাথে ছাত্রদের ব্যাপক সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। কয়েকজন নিরহ ছাত্রকে পুলিশ মারধর করে। ঘটনা শুনে সেখানে ছুটে যান কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিজ্ঞানের শিক্ষক সৈকত মন্ডল স্যার। পুলিশকে নিজের পরিচয় দিয়ে অবস্থা অনুকূলে আনার চেষ্টা করলেও কর্তব্যরত পুলিশেরা স্যারের মাথায় বাটালি দিয়ে আঘাত করে। পরদিন ক্যাম্পাসে এ নিয়ে ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হয়ে উঠে। খুলনা বিভাগীয় পুলিশ কমিশনার এ সমস্যা সমাধানে ক্যাম্পাসে আসতে চাইলে তার গাড়ি আমরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাঁধা দিই। যে পুলিশেরা আমার শিক্ষকের গায়ে হাত দিতে পারে তাদেরকে এ ক্যাম্পাসে ঢুকতে হবে মাথা নত করে। অভি স্যার একটু পর এলেন, জানতে চাইলেন কি চাও তোমরা?
আমরা সাফ সাফ জানিয়ে দিলাম কমিশনারের গাড়ি ক্যাম্পাসে ঢুকবে না! খুলনা শহরের মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছাত্রকে হ্যারেজ করা চলবে না।
স্যার বললেন, যা চাও, তাই হবে!
পুলিশ কমিশনার গল্লামাড়ি থেকে নেমে হেটে হেটে ক্যাম্পাসে ঢুকলেন। অভিযুক্ত কনস্টেবলরা বহিষ্কার হলেন। খুলনা শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আর কোন ছাত্রকে হ্যারেজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষমা চেয়ে গেলেন কমিশনার!
ক্যাপশনঃ আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রোগ্রামে বক্তব্য রাখছেন স্যার।
৩।
আমাদের নবীন বরনের দিন ছাত্র বিষয়ক পরিচালক হিসেবে বিশেষ অতিথি ছিলেন অভি স্যার। স্যারের কথাগুলো আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শিক্ষা। স্যার অকপটে বলে গেলেন-
‘তোমরা যারা আজ নবীন বরণ পাচ্ছো, মনে রেখো একদিন তোমাদের হাতেই দেশের দায়ীত্বের ভার এসে পড়বে। আর দেশের একজন সুনাগরিক হিসেবে দেশকে পরিচালনার শিক্ষাটা তোমরা এখানে পাবে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের তোমার যা কিছু শিখবে তার ৯০ শতাংশ পাবে সিনিয়ার বড়ভাই ও পরিবেশ থেকে। মাত্র ১০ ভাগ শিক্ষা দিতে পারে তোমার শিক্ষকেরা। তাই বড়দের সম্মান ও ছোটদের সাথে সম্পর্কের সমন্বয় বজায় রেখো, কেননা আগামী চার বছরের অধিকাংশ সময় তোমাদের কাটবে সহপাঠি বন্ধু, সিনিয়ার ও জুনিয়ারদের সাথে। শিক্ষকদের সাথে ক্লাসরুম ছাড়া সময় কাটানো হবে খুব কমই, ফলে তোমার জীবন সম্পর্কে যে শিক্ষা সেটা তাদের কাছ থেকেই পাবে!’
আমি বহুত শিক্ষককে দেখেছি, ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের সিনিয়ারদের কাছে যেতে বারণ করে। স্যার সেখানে অকপটে বলে দিলেন তাদের সান্নিধ্যে থাকতে। বুঝিয়ে দিলেন, জীবন সম্পর্কে শিক্ষাটা যাদের কাছ থেকে সেটা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পরিপার্শ্ব।
ক্যাপশনঃ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের র্যালী শুরুর পূর্বে।
৪।
স্যারের কাছে আমি কোন একাডেমিক শিক্ষা পাইনি।আমি ইলেক্ট্রনিক্স এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের ছাত্র ছিলাম। অধ্যাপক অনির্বাণ মোস্তফা (অভি) স্যার হচ্ছেন আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক। স্যার আমার নিজ ডিসিপ্লিনের শিক্ষক না হওয়ার ফলে কোনদিন ক্লাস করার সুযোগ হয়নি তার। কিন্তু স্যার আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটা সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-বিষয়ক পরিচালক (অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাকে প্রক্টর বলে) ছিলেন বিঁধায় কারণে-অকারণে স্যারের সাথে আমার অনেক আচলোচনা, সমালোচনা ও তর্ক করার সুযোগ হয়েছে। স্যার একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান, নিজের পায়ে নিজে দাড়িয়েছেন, স্রোতে গা ভাসিয়ে দেননি কখোনোই। খুলনা ভার্সিটিকে একটা নতুন জীবন দিয়েছেন তিনি। আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মানুষ হওয়ার শিক্ষা যেকজন শিক্ষক দিয়ে গেছেন অভি স্যার তার মধ্যে অন্যতম। আমার চোখে সে নায়ক, আইডল, সে নেতা, একজন শিক্ষক ও অভিভাবক! ছাত্রদের মনস্তাত্বিক দিকটা বুঝবার যে অসাধারন ক্ষমতা সেটা স্যারের মধ্যে আমি পেয়েছি খুব গভীর ভাবে। খুলনা ছেড়ে আসার আগের দিন আমি আর বন্ধু রাজি স্যারের সাথে দেখা করতে যাই। স্যার অনেকটা সময় দেন আমাদের।আমি স্যারের কাছে দিয়ে স্যারের দোয়া নিয়ে আসি। দেশ সমাজ রাজনীতি, ক্যাম্পাস ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা শেষে বের হওয়ার সময় বলি-
‘স্যার, আমার মাথায় ছুয়ে একটু দোয়া করে দেন’
স্যার আমার মাথা ছুঁয়ে দোয়া দিয়ে কয়েকটা কথা বলেছিলেন। আমি কেঁদে দিয়েছিলাম!
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কজন স্বপ্নবান শিক্ষক আছেন অভি স্যার তার মধ্যে একজন। বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে প্রচন্ড ভাবেন তিনি। অত্যান্ত মেধাবী এ বুদ্ধিজীবি মানুষটি একজন প্রচার বিমুখ মানুষ। স্যারকে নিয়ে লিখলে আহমেদ ছফার মতো আমিও লিখে ফেলতে পারবো একশ চার পৃষ্ঠার কোন বই!
অনেক গল্প জমা আছে যে!
ক্যাপশনঃ স্যার ও তার স্ত্রী প্রফেসর আফরোজা পারভিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৪