চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা সত্যি!
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েও বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। খুব খেয়াল করে কাগজে টাইপ করা কালো কালো অক্ষরে নিজের নামটা দেখছিলাম। না ভুল হয়নি- আমার নামই লেখা।
নিজের অবিশ্বাস্য চোখ জোড়া নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। চোখগুলো ঝাপসা লাগছে। চোখে ঠান্ডা পানি দিয়ে নিজের স্যান্ডু গেঞ্জিটা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আবারো এলাম কাগজটা দেখতে। হ্যা-একটা এপয়েন্টমেন্ট লেটার। তাতে আমার নামই লেখা। বোল্ড হরফে লেখা।
যদিও আহামরি কোন ব্যাপার নয়। খুব সাধারন চাকরি। আমার আটটা-পাঁচটার গল্পের মত সাধারন একটা চাকরি। তবুও আমার অবিশ্বাস্য লাগছিলো।
পুরো এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা খেয়াল করে পড়লাম। জীবনের প্রথম এপয়েন্টমেন্ট লেটার কিনা! সুযোগ সুবিধা আছে বেশ। ট্রান্সপোর্ট সুবিধা, দুপুরের লাঞ্চ, সাথে মাস শেষে পঁচিশ হাজার টাকার মোটাতাজা বান্ডিল আর বছরে দু’বার বোনাস। আর কি চাই!
হ্যা। এইবার ফাওজিয়াকে নিয়ে ঘর বাঁধা যাবে। 'তোকে নিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন আমার অন্তহীন-রাত্রীদিন' স্বপ্ন সত্য হবে। হে হে হে ।
এসব ভাবতে ভাবতে মনটা কেমন থম ধরে এলো। ঠোঁটের এককোণে এক চিলতে বিদ্রুপের হাসি ছাড়া আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না নিজের মাঝে।
চাকুরিটা আমি ঠিকি পেয়েছি। কিন্তু পাওয়া হবেনা ফাওজিয়াকে । কোনদিন না, কোন ভাবেই না!
ঠিক ৮ মাস ১৪ দিন আগে একটা বৃষ্টির দিন ছিলো। স্টুডেন্ট এর বাসা থেকে বের হয়ে আমি বাসায় ফিরবো। দেখি ফাওজু আমার ছাত্রীর বাসার নিচে। একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিতে ভিজছে। আমি অবাক হলাম!
- কি হইসে ? তুমি এইখানে কেন?
- বাবু! আমি চলে এসেছি।
- মানে কি? চলে এসেছো মানে কি?
ফাওজিয়া একটা হাসি দিলো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো -
'হে অজেয় পুরুষ এইবার আমাকে সংসার করো'
রুদ্র গোস্বামী'র 'সংসার' কবিতাটা ওকে আমি একবার পাঠ করে শুনিয়েছিলাম। তারপর থেকে ফাওজিয়া এই কবিতাকে মুখস্ত করে ফেলেছে। আমার দেয়া ৪৭টি কবিতার প্রায় সবকটিই ওর মুখস্ত! অথচ আমার নিজেরই মনে নেই একটা কবিতার পুরোটা!
- পাগলামি কইরো না। যাও বাসায় যাও।
- পাগলামি করছি না। আজ পাত্র দেখতে আসছিলো। আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে। সব ফাইনাল করেছে দুই পক্ষ। সো, আমার কোন উপায় নেই।
- প্লিজ! এমন কইরো না। চলো বাসায় চলো!
সেদিন অনেক ঝগড়াঝাটি শেষে ফাওজিয়াকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে ওর বাসায় ফেরত দিয়ে আসি। আমি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসি।
পরের বৃহস্পতিবার সন্ধায় আমার নাম্বারে একটা ফোন আসে। ফাওজুর বান্ধবি শ্রেয়শ্রীর ফোন।
ফোনটা রেখেই আমি হাপাতে হাপাতে ওর বাসায় পৌছি। আমার ফাওজু সোনা আর নেই!
না কোন সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি। আমার নামে কোন অভিযোগ কোত্থাও লেখা নেই। পৃথিবীর কারো প্রতিই যেন তার কোন অভিযোগ নেই!
সেইসপ্তাহের রবিবারে আমার জ্ঞ্যান ফিরে। দেখি আমি হাসপাতালে। কিছুটা সুস্থ হলে আমার চাচাতো ভাই মুকিম আমাকে নিয়ে চাচার বাসায় চলে আসে । মাস খানেক পর আমার ঠিকানায় একটা চিঠি আসে। চিঠিটা আমাকে পাঠিয়েছে শ্রেয়শ্রী।
আমি হলুদ খাম খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করি-
বাবু,
জগতে যেটুকু ভালো আমি তোমায় বেসেছি তা বোধহয় কখনো আমি নিজেকেও বাসিনি।
যে পৃথিবীতে তুমি নেই, সেই পৃথিবীটা আমার না।
আমি তাই নতুন পৃথিবীর খুঁজে যাচ্ছি। তুমি ভালো থেকো।
আমি ভীষন মনোযোগ দিয়ে চিঠিটা পড়ি। একবার পড়ি-দুইবার পড়ি-বারবার পড়ি।
চিঠিটা শ্রেয়শ্রীকে দিয়ে ফাওজিয়া বলেছিলো আমার বিয়ে হলে তুই এইটা অর্ঘ্যকে দিয়ে দিস। আর শোন, বিয়ের আগে অবশ্যই দিবিনা। চিঠিটা কখনো খুলবিনা!
শ্রেয়শ্রী কথা রেখেছিলো। সেই চিঠি আজও আমার শুন্য মানিব্যাগের পকেটে আছে। আমি আবার চিঠিটা খুলি। শুধুমাত্র একটা চাকরির অভাবে ফাওজিয়াকে আমার পাওয়া হয়নি। অর্থনৈতিক দৈন্যতার কাছে ভালোবাসা জায়গা করে নিতে পারিনি। কাপুরুষের মত আমি বেঁচে আছি আর ভালো থাকার চেষ্টা করছি। পাড়ার দোকানে আট হাজার টাকা বাকি, দৈন্যদশা চরমের পৌছেছে। আমি বাস্তবে ফিরে আসতে চেয়েছি বারবার। কিন্তু কি লাভ এই বেঁচে থেকে? একে কি সত্যিই বাঁচা বলে?
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটার কোন মূল্যই খুঁজে পেলাম না মনে হলো। দিয়াশলাই জ্বেলে সিগারেটে আগুন দিই তারপর এপয়েন্টমেন্ট লেটারটাতে।
সোনালী আগুন জ্বলছে। তবুও দ্বগ্ধ হচ্ছিনা আমি! মনে মনে ভাবছি কেউ একজন এসে যদি একবার বলে, শুধু একবার বলে - 'হে অজেয় পুরুষ এইবার আমাকে সংসার করো'-আমি এই নিভিয়ে দিবো এই আগুন।
কিন্তু না কেউ আসেনি। কেউ না।
কাগজের পুরোটা পুড়ে গেলো। বাতাসে ভস্মগুলো ছুটাছুটি করতে শুরু করলো।
পাশের রুম থেকে গানের শব্দ কানে আসছে। চাচাতো ভাই মুকিম গান ছেড়েছে। অঞ্জন দত্তের গান
- হ্যালো টি ফোরফোর ওয়ানোয়ান থ্রিনাইন, বেলাবোস তুমি পাচ্ছো কি শুনতে?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:২৩