এখন প্রায় মধ্যরাত। একা একা বেড়িয়েছি আজকে। গন্তব্য খুলনা স্টেশন। রেলওয়ের কোন ব্যাস্ত স্টেশন সবসময় আমাকে কাছে টানে। একটা প্লাটফর্মে হাজার মানুষ...হাজারটা গল্প।
এই মধ্যরাতে খুলনা স্টেশনে খুব একটা ব্যাস্ততা নেই...অনেকটাই নীরব। শুন-শান একধরনের নীরবতা কাজ করছে রেলের মানুষদের মধ্যে। ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটার টিক টিক করে ছুটে চলার শব্দটা যেন কানে বাজছে। হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম মিনিটের কাঁটাটা ৪২ থেকে ৪৩তেগিয়ে দাঁড়ালো। আর ঘন্টার কাঁটাটা বেশ অনেক্ষন হল ১১ এর ওপর স্থির। প্লাটফর্মের ঠিক দক্ষিন পাশটাতে বসে আছি। পাশে পুলিশ ফাড়ি।
প্রতিটি ট্রেনের প্রস্থানের মূহুর্তে দু'একজন পুলিশ আমার গন্তব্য জানতে চেয়েছে।
আমাকে দেখে মনেহয় বোঝা যাচ্ছে যে- পকেটে টিকিট নেই!
আমার ডান হাতে মেটাডোর অরবিটের নতুন একটা কলম । এই কলমটা অবশ্য ক্লাসের কোন বন্ধুর কাছ থেকে মেরে দিইনি। একদমই নিজে কিনেছি। আহসানউল্লাহ হলের নিচ তলায় থাকা আলম স্টোর থেকে। আমার দু'পা মোড়ানো শরীরের উপর একটা ডায়রি। বাম হাত দিয়ে ধরে রেখেছি সেটাকে। কিছু একটা লিখার চেষ্টা করছি কলম দিয়ে। যা খুশি লিখছি- ওটা আমার রাজত্ব...এখানে কেউ আক্রমন করতে পারে না,এক আমি ছাড়া। কেননা আমার এই রাজ্যের রাজা আমি, কলমটি সেখানে সেনাপতি আর রাজ্যের বিস্তার প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত।
আজ প্রচন্ড ঠান্ডা। কুয়াশাছন্ন চশমার কাঁচ। ঠোঁটের কোণে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। আগুনটা লাভা বেগে ছুটে আসছে ফিল্টারের দিকে। সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোতে কুন্ডলাকৃতির ধোঁয়াগুলোকে অদ্ভুত লাগছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। হটাৎ মরার মত পড়ে থাকা পাশের ঘুমন্ত লোকটা নড়ে উঠল। ভয় পেয়ে উঠে দাড়ালাম! আপাতত লিখবার চেষ্টা বাদ।
তাহলে কিছুক্ষন হাটি...।। হাটতে হাটতে মনে পড়ছে ঘন্টা তিনেক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা।
চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত মানুষ। একটি পুরোনো চেহেরা। দেখেও না দেখার ভান করলো। 'ভালো আছো?'-জিজ্ঞেস করতেই 'কাকে জিজ্ঞেস করছেন?আমাকে?'- টাইপের একখান ভাব করলো। যেন আগে কখনো পরিচয় হয়নি এই মানুষটির সাথে । যেন পুরোনো কোন গল্প নেই আমাদের।
আমাকে দেখে পাশে থাকা লোকটির হাতে যেন আরো আরো গভীর ভাবে শক্ত করে ধরলো। যেন নিরাপদ দূরত্বে সরে যাওয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ।
সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে দিয়েছে। ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো কেন এমন আচরন? আমি কি তবে কেউই ছিলাম না?
ট্রেন চলছে ... 'জ' নাম্বার বগিটি আমার থেকে সড়ে যাচ্ছে । আমি তাকিয়ে আছি জানলার দিকে ...অপেক্ষায় আছি দু'টি পরিচিত চোখের পরিচিত চাহনীর।
অবশেষে ... করুণ একটা দৃষ্টি নিয়ে একটি চাহনী দেখলাম আমি। মনেহলো হাজার বছরের পুরনো চাহনী...।। চোখ জুড়ে জল...অবলীলায় ঝরে পড়ছে। আমি দৌড়াতে পারতাম ...তবুও স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম।
ট্রেন আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়। আমি হাটতে হাটতে পুলিশ ফাড়ির সামনে থাকা প্লাটফর্মে গিয়ে বসি। নিঃসঙ্গ আমি। আর এই নিঃসঙ্গ আমিকে একা সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে একটা নিঃসঙ্গ চাঁদ। এখনও সেকেন্ডের কাঁটা সেই আগের মতই ছুটে চলেছে। মিনিটের কাঁটাটা ঊনষাট থেকে শূন্যে গিয়ে দাঁড়ালো। আর ঘন্টার কাঁটাটা গিয়ে দাঁড়ালো এগারো থেকে বারোতে।
আজ এখন মধ্যরাত। দূরে একটা হর্ণের তীব্র আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। ডপলারের সূত্রানুসারে সেই আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে আমার কানে । বুঝতে পারলাম ট্রেন আমার দিকে এগিয়ে চলছে ক্রমশ তার ক্ষীপ্ততা নিয়ে!
নকশিকন্ঠ এক্সপ্রেস। একটি মধ্য রাতের ট্রেন।
একটু পরই ছেড়ে যাবে খুলনা স্টেশন থেকে গোয়ালন্দঘাটের উদ্দ্যেশ্যে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৩