রাত ১২:৩৫......
এক হাতে ব্যালকনির গ্রীল ধরে অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে অর্ক আর একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে।আজ সারাদিনের কথা তার যত মনে পড়ছে ততই যেন মাথার ভিতরটা ফাকা হয়ে যাচ্ছে।আজ যে শ্রেয়ার সাথে অর্ক তার ২ বছরের সম্পর্কটা শেষ করে ফেলছে।অনেক বাজে কথাও বলছে।শ্রেয়া কোন প্রতিবাদ করেনি শুধু নীরবে কেঁদেছে।যে মেয়ের একটু হাসির জন্য অর্ক সবকিছু করতে পারত আজ তাকেই কিনা ও কাঁদাল!!
অর্ক আর শ্রেয়ার পরিচয় ২ বছর আগে ভার্সিটির এক অনুষ্ঠানে।অর্ক বরাবরই একটু পাগল পাগল আর এলোমেলো স্বভাবের।মাথা ভর্তি এলোমেলো চুল,চোখে একটা কালো ফ্রেমের চশমা,মুখ ভর্তি দাড়ি আর সদা হাসিখুশি একটা চেহারা।যেকোন আড্ডা মাতিয়ে রাখতে তার কোন জুড়ি নাই।শ্রেয়ার বান্ধবী নিঝুম অর্কর সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দেয়।শ্রেয়ার প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল এই বান্দরটা সুন্দরবন থেকে এখানে আসল কিভাবে?? শ্রেয়া অনেকটা অনিচ্ছা নিয়েই অর্কর সাথে কথা বলল।
অর্ক: হাই
শ্রেয়া: হ্যালো
অর্ক: কেমন আছেন?
শ্রেয়া: এইতো মোটামুটি।আচ্ছা আপনার কি সেলুনে এলার্জি আছে নাকি??
অর্ক: কেন বলুনতো
শ্রেয়া: এত বড় চুল দাড়ি রাখছেন ক্যান? ঢাকা চিড়িয়াখানার লোকজন দেখলে বিপন্ন প্রজাতির বানর ভেবে ধরে নিয়ে যাবে
অর্ক: হাহাহা দারুন বলেছেন।আসলে আমার বন্ধুরা আমার দাড়ি নিয়ে খুব মজা করে।এগুলো কেটে ওদের মজাটা নষ্ট করতে চাই না।আচ্ছা এখন যাই।
শ্রেয়া যেমনটা ভেবেছিল তার থেকে অর্ক একদম আলাদা।এত সরলসোজা হাসিখুশি ছেলে শ্রেয়া খুব কম দেখছে।
এরপর প্রায়ই ক্যাম্পাসে তাদের দেখা হত।টুকটাক কথাও হত। আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে কথা বাড়তে লাগল।খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা অনেকটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল।প্রায়ই দুজনে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে আধাময়লা বেঞ্চটাতে বসে গল্প করত।
অর্কর কিছু বদ অভ্যাস ছিল যেমন আঙ্গুল দিয়ে নাক খোচানো,দাত নিয়ে নখ কামড়ানো ইত্যাদি।এসবের জন্য শ্রেয়া ওকে খুব বকাঝকা করলেও পরে মনে পড়লে খুব হাসি পেত।তবে অর্কর সিগারেট খাওয়ার ব্যাপার টা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারত না।এটা নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া বাঁধত।অনেক কসম দিয়েও কোন লাভ হয়নি।
যত দিন যায় অর্ক বুঝতে পারে ও শ্রেয়াকে ভালোবেসে ফেলছে।কিন্তু শ্রেয়া কি ওকে ভালবাসে? নাকি এটা শুধুই বন্ধুত্ব?? তাছাড়া শ্রেয়া বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে আর অর্কর বাবা সামান্য একটা চাকরী করে।তবুও অর্ক ভালবাসা দিবসে সাতটা গোলাপ ফুল দিয়ে শ্রেয়াকে তার মনের কথা বলে দেয়।
অর্ক: শ্রেয়া তোমাকে একটা কথা বলব কিন্তু ভয় করতেছে
শ্রেয়া: গাধা আমি বাঘ নাকি ভাল্লুক যে ভয় লাগতেছে? বলো কি বলবা
অর্ক: আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলছি
শ্রেয়া: শুনিনাই জোরে বলো
অর্ক: ইয়ে মানে আমি তোমাকে ভালবাসি
শ্রেয়া: গাধা গরু তেলাপোকা টিকটিকি এই একটা কথা বলতে এত দিন লাগালি আর আমার বাবার কাছে বলতে গেলে তো সারা জীবন লাগাবি
অর্ক: আমাকে ভালবাসো তো?
শ্রেয়া: হ্যা রে পাগল তোমাকে অনেকদিন ধরেই বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু মেয়ে তো মুখ ফুটে বলতে পারিনি।
শ্রেয়া শক্ত করে অর্কর হাতটা চেপে ধরল।হঠাত্ খেয়াল করল অর্কর চোখে জল।এর আগে ও কখনও এতটা খুশি হয়নি।শ্রেয়া শক্ত করে অর্ককে জড়িয়ে ধরল।এই পাগলটাকে ছেড়ে ও যে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না।
এরপর ওদের দিনগুলো সপ্নের মত কাটতে লাগল।সারাক্ষন খুনসুটি ঝগড়া অভিমান হাত ধরে অজানা উদ্দেশ্যে হাটতে থাকা, একসাথে বৃষ্টিতে ভেজা।অর্ক খুব অবাক হত এটা ভেবে যে এই মেয়েটা এত অল্পতে খুশি থাকতে পারে! শ্রেয়ার জন্মদিনে অর্ক অনেকদিন ধরে টিউশানি থেকে জমানো টাকা দিয়ে নীল রংয়ের একটা শাড়ি কিনে দেয়।দামটা হয়তো খুব কম কিন্তু ভালবাসার কোন কমতি ছিল না।শ্রেয়া ভীষন খুশি হয়েছিল।ওর যে কাছে এটা পৃথিবীর সবচেয়ে দামি উপহার।
কিছুদিন ধরে অর্কর শরীরটা খুব খারাপ।শ্রেয়াকে একটুও বুঝতে দেয়নি।সামান্য কাশি বলে এড়িয়ে গেছে।কিন্তু যখন দেখলো কাশির সাথে রক্ত পড়ছে তখন খুব ভয় পেয়ে গেল।খুব কাছের বন্ধু নিলয়কে নিয়ে ডাক্তারে কাছে গিয়ে কয়েকটা টেস্ট করে আসল।রিপোর্ট পাওয়ার পর এক নিমেষেই অর্কর সব সপ্ন চুরমার হয়ে গেল।তার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে।রক্তের লিউকোসাইটগুলো আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।যার পরিনতি নিশ্চিত মৃত্যু।
সারারাত নির্ঘুম জেগে ভোররাতে অর্ক সিদ্ধান্ত নিলো ওর এই সল্প জীবনে শ্রেয়াকে জড়ানোর কোন মানে হয় না।শ্রেয়ার মনে ওর জন্য ঘৃনা তৈরি করতে হবে তাতে ওর যতই কষ্ট হোক আর সেটা আগামিকালই।
২ দিন পর.......
লেকের পাড়ে সেই বেঞ্চটাতে অর্ক বসে আছে।আশেপাশের সবকিছু তার পরিচিত শুধু একজন তার পাশে নেই।ওদের ভালবাসার অনেক সুন্দর মুহুর্তগুলোর সাক্ষী এই যায়গাটা।পুরোনো স্মৃতিগুলো যতই মনে পড়ছে অর্কর তত কান্না পাচ্ছে।অর্ক পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে নিল।হঠাত্ পিছনে পরিচিত কন্ঠস্বর
-হারামজাদা এখনও ওটা ছাড়তে পারলি না??
অর্ক অবাক হয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলো শ্রেয়া তার দেয়া নীল শাড়িটা পরে দাড়িয়ে আছে।চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।হয়ত গত ২ রাত ঘুমায়নি।
শ্রেয়া: তুমি কি ভেবেছিলে আমাকে ফাকি দিয়ে এভাবে লুকিয়ে চলে যাবে? তোমার চোখের প্রতিটা ভাষা আমি পড়তে পারি। আমার কাছে লুকিয়ে কোন লাভ নেই
অর্ক: তুমি কিভাবে জানলে?
শ্রেয়া: নিলয়ের কাছ থেকে জোর করে শুনছি।অর্ক আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না।
অর্ক: প্রত্যেক মানুষের হয়ত চাওয়ার একটা সীমা থাকে।আমরা হয়ত একটু বেশী চেয়ে ফেলছি তাই সৃষ্টিকর্তা আমাদের আলাদা করে দিচ্ছেন।
শ্রেয়া: তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকাটা অসম্ভব।প্লিজ অর্ক তোমার পায়ে পড়ি আমাকে সাথে নাও।আমি যে একা একা জীবনের এত বড় পথ পাড়ি দিতে পারবো না।
অর্ক শক্ত করে শ্রেয়াকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে।ও যে পরপারে শ্রেয়াকে ছাড়া শান্তিতে থাকতে পারবে না।
অর্ক আর শ্রেয়ার বাকী কাহিনীটা অসমাপ্তই থাক।হয়ত বিধাতার নিষ্ঠুর নিয়তি থেকে ওরাও ক্ষমা পায়নি।