আমার জন্ম চাদঁপুরেই। ছোটবেলা থেকেই লঞ্চে করে চাদঁপুর-ঢাকা যে কত শতবার আসা যাওয়া করেছি তার কোন সংখ্যা নাই। তাই চাদঁপুরেও যে ঘুরতে যাওয়া যায়, সেটা কখনো আলাদা করে ভেবে দেখা হয়নাই। তাই মুতাসিম ভাই যখন চাদঁপুর ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব করলেন, মাথা দুই দিকে একটা ঝাকিঁ মেরে বুঝতে চেষ্টা করলাম আসলেই কি! শুনলাম প্রায় ৭ জন বিশিষ্ট মানুষ এই ট্যুরে যাচ্ছেন। আমার নিজের দেশ ভ্রমণে ওনারা কতটুকু বিমলানন্দ লাভ করবেন সে বিষয়ে কিছুটা সংশয়ে পড়ে গেলাম। চাঁদপুরে দেখার মত নদী ছাড়া আর কি আছে! নিজের মধ্যে একটা তাগাদা অনুভব করলাম কিভাবে এই ট্যুরটাকে তাদের কাছে সর্বোচ্চ সাফল্যমণ্ডিত করা যায়। উনারা ঢাকায় ফিরে যদি বলেন চাদঁপুর ভাল লাগেনাই তার চেয়ে লজ্জা আর কি হতে পারে!
ঠিক হলো, সকাল সাতটায় আমরা সদরঘাটে উপস্থিত থাকবো। ৭.২০ এর সোনার তরিতে উঠবো। কিন্তু সদরঘাট অঞ্চলের ঐতিহাসিক জ্যামের কথা আন্দায করা কঠিন। ফলাফল লঞ্চ ফেল। অগত্যা আটটার মেঘনা রাণীতে গিয়ে উঠলাম। বিছানার চাদর বিছিয়ে দোতলার সামনের কিছু জায়গা দখল করে আরাম করে বসলাম।
................................................................... লঞ্চে নিজস্বি
বুড়িগঙ্গার কোকাকোলা রঙের পানি সবার ভ্রমণানন্দ খানিকটা ম্লান করে দিল। কিন্তু লঞ্চ যত সামনে এগিয়ে চললো, পানির আসল রঙ ফুটে উঠল। দিনটি ছিল মার্চের ৪ তারিখ। ঢাকা শহর থেকে ইতোমধ্যে শীত পুরোপুরি বিদায় নিয়েছে। কিন্তু বুড়িগঙ্গার দৃশ্য ছিল ভিন্ন। কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল চারপাশ। সূর্য উপরে উঠার সাথে সমানুপাতিক হারে কুয়াশা ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসল। নদীর দুই পাশ পরিষ্কার হয়ে এল। লঞ্চের রেলিং ধরে পানির ছুটে চলা এবং দুই তীরের সৌন্দর্য অবলোকন করার মত অসাধারন মুহুর্ত পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা আছে কিনা জানা নাই।
................................................................. লঞ্চের ছাদে
লঞ্চে থাকতে হবে পাক্কা সাড়া তিনঘন্টা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরাও কিছুটা ক্লান্ত। শুরু করলাম কার্ড খেলা। প্রথমে মুতাসিম ভাই ব্লাফ নামে এক প্রকার খেলার আমদানি করলেন। ভালোই জমলো এটা। কিছুক্ষণ পর শুরু করলাম কলব্রীজ। খেলোয়ারের সংখ্যা ৭ জন হওয়াতে খেলার রুলসগুলো কাস্টমাইজ করে নিলাম। একেবারে জমে উঠল এটা। এমনকি চাঁদপুর থেকে ঢাকা ফেরার সময়ও এই ম্যাচটা অব্যাহত থাকে। সাড়ে এগারোটায় চাঁদপুর লঞ্চ টার্মিনালে এসে পৌছাঁই।
................................................................... চাঁদপুর নৌবন্দর
আমরা অধিকাংশই সকালে বাসা থেকে খেয়ে আসতে পারিনাই। লঞ্চেও ভারি খাবার খাওয়া হয়নাই। তাই তোলপাড় শুরু করা মধ্যপ্রাচ্যকে প্রশমিত করতে ছুটে চললাম ক্যাফে ঝিলে। দু:খের বিষয় হচ্ছে প্রজনন মওসুম হওয়াতে মার্চ-এপ্রিল এই দুইটা মাস ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে সরকার। তাই ইলিশের রাজধানীতে এসেও তাজা ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় সবাইকে।
................................................................... ক্যাফে ঝিলে খাওয়া-দাওয়া
ভরপেট খেয়েদেয়ে ছুটলাম ‘ঠোডার মাথা’-র উদ্দেশ্যে। পদ্মা, মেঘনা এবং ডাকাতিয়া এই তিন নদীর মোহনা এখানেই অবস্থিত। বর্ষাকালে এটার চেহারা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এবং হ্যাঁ অনেক লঞ্চ-জাহাজকে গিলে ফেলার কুখ্যাতি রয়েছে এটার। ‘ঠোডার মাথা’ টা স্থলভাগ থেকে নদীর মধ্যে কিছুটা প্রবৃদ্ধির মত দেখতে। এরকম দেখতে হওয়ার কারন হচ্ছে আশেপাশের স্থলভাগ মেঘনার তান্ডবে ব্যাপকভাবে ক্ষয় হয়ে গেছে। কিন্তু বড় বড় পাথর ফেলার কারনে ‘ঠোডার মাথা’টা অক্ষত আছে।
................................................................. ঠোডার মাথায় পোজ
এখানে দাঁড়ালে আপনি তিনদিকে আদিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি দেখতে পাবেন। বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আছড়ে পড়বে একদম আপনার পায়ে। যেন কোন দৈত্য মাথা নীচু করে করজোড়ে ক্ষমা চাইছে। আর পাবেন তাজা বিশুদ্ধ বাতাস। চাঁদপুরের বাতাস বুক ভরে ভেতরে নিলে আপনার সকল অবসাদ, ক্লান্তি এক লহমায় দূর হয়ে যেতে বাধ্য।
বাংলাদেশ নাকি একটা নদীমাতৃক দেশ। তাই নদীকে আরো কাছ থেকে দেখতে একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া করলাম।
....................................................................... নৌকায় মাস্তি
বিশাল মেঘনার স্বচ্ছ জলরাশি ভেদ করে ছোট্ট নৌকা ছুটে চললো। আমরা আরো একবার হারিয়ে যেতে চাইলাম। কেউ পানিতে পা ভিজিয়ে, কেউ টাইটানিক কায়দায় ছবি তুলে, কেউবা হেড়ে গলায় গান ধরে পুরো মজমা প্রাণবন্ত করে তুলল
.......................................................... মেঘনার স্বচ্ছ জলরাশি
এরপর ছুটলাম অকূলে ভেসে ওঠা চরের পানে। চরটা অস্থায়ী। শীতকালে ভেসে উঠেছিল। সামনের বর্ষায় আবার ডুবে যাবে।
................................................................ মেঘনায় ভেসে ওঠা চর
নদীপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এক মিটারের বেশি হবেনা। চরের কাছে আসা মাত্র লাফিয়ে নৌকা থেকে নেমে পড়লাম। নির্জন চরটাকে বড্ড বেশি আপন মনে হলো। মিফতাহ তো চিরদিন এই চরে থেকে যাওয়ার আকুতি পেশ কররো। সাবিহা আপু এবং মাহাকে দেখলাম তীর বরাবর আনমনা হয়ে হেটেঁ যেতে। যেন প্রাকৃতিক পরিবেশে এসে দার্শনিক একটা মনোভাব জেগে ওঠেছে।
........................................................... এক মিনিটের মাঝি
একসময় ‘যেতে নাহি মন চায় তবু চলে যেতে হয়’ এরকম একটা দোলাচল নিয়ে মেঘনার নাম না জানা সেই চরকে বিদায় জানিয়ে নৌকায় চড়ে বসলাম। সোবহান ভাই অবশ্য বলছিলেন, ‘আবার আসিব ফিরে, এই চরের দুয়ারে......’। নৌকায় করে সরাসরি লঞ্চে গিয়ে উঠলাম। সাড়ে তিনটার সোনার তরী। সকালে যেটা ঢাকায় মিস করেছিলাম। ঢাকা ফিরে আসছি। কিন্তু সবার মন পড়ে আছে মেঘনার চরে। একটু পরে সূর্য ডুবে গেল। সূর্যাস্তের সময়ের চারপাশ সবার বিষণ্ণ মন আরো বিষণ্ণ করে দিল।
.......................................... মুনতাকা আপুর তোলা নদীতে সূর্যাস্তের সময়ের আকাশ
সদরঘাটে পৌঁছে ঢাকার কোলাহলের মধ্যে ফিরে এসে সমাপ্ত হলো একদিনের ঝটিকা চাদঁপুর সফর।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:৩৪