রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুম আমার অনেক পছন্দের একটি জায়গা।ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় থাকা এবং অপেক্ষার প্রহর শেষে তৃপ্তি দুটোই একসাথে দেখা যায় এই ওয়েটিং রুমে। ছোট বাচ্ছাদের কিচিরমিচির, বড়দের সিরিয়াস আড্ডা বা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের খুনসুটি সব দেখা যায়। এই মুহূর্তে আমার ডান পাশে একটি মেয়ে বসে আছে। ঘুটঘুটে কালো কাজল পরা চোখের মেয়েদের প্রতি আমার ফ্যান্টাসি অনেক পুরনো। মেয়েটি একমনে তার গ্যাজেটে কি যেন পড়ে চলেছে। তবে গ্যাজেটে পড়লেও প্রেমে যে পড়বে না এই মেয়ে, তা তার গম্ভীর মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে। তার অপেক্ষা দেখে আমার ট্রেন হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার অপেক্ষায় থাকবে সে। আমি প্ল্যাটফর্মে প্রবেশের পর সে আমার বুকের ভিতর প্রবেশ করবে। আর আমি ওম দিতে দিতে তাকে নিয়ে যাব তার গন্তব্যে। তেমনি অন্য কোনদিন আবার আমার অপেক্ষায় থাকবে। আমি আসবো, নিয়ে যাব তাকে গন্তব্যে। আমার এরকম চিন্তার মাথায় জল পড়ল যখন ট্রেনের হুইস্যাল বুঝিয়ে দিল ট্রেন এসে পড়েছে।
“পাশের সিটের সুন্দরী যাত্রীটি” নামে একটা টার্ম আমি কবি বা লেখকের লেখায় পড়েছি বা বন্ধুদের আড্ডায় শুনেছি। কিন্তু বাস্তবে এটার কোন অস্তিত্ব আছে বলে আমার মনে হয়না। নাহয় সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে ঘুরেও কেন আমি এরকম কোন “পাশের সিটের সুন্দরী যাত্রী” পেলাম না!! আমার সিটের সামনে যে কাপলটি বসে আছে তাদের বয়স জানান দিচ্ছে তারা হানিমুন কাপল নয়। তবে ঘুরতে তারা খুব পছন্দ করে তাদের কথায় বুঝা যাচ্ছে। কাপলের পুরুষটি মনে হয় ওয়াশরুম জনিত সমস্যায় ভুগছেন। বার বার ওয়াশ রুমে যাচ্ছেন আর আসছেন।
ট্রেন কিছুদুর গিয়েই থেমে গেল। ভ্যাকুয়াম বক্স লিক, ট্রেন চাপ পাচ্ছেনা। তাই ট্রেন এগুবে না। প্রায় ১ ঘণ্টা পর সমস্যা সমাধান হল এবং ট্রেন আবার চলা শুরু করল। কাপলের পুরুষটি আবার ওয়াশ রুম থেকে আসলেন। এবার মহিলাটিকে কেন জানি রাগান্বিত মনে হল। ফিসফিস করে বলতে লাগলেন “চেইন টা টান, চেইন টা টান”। ফিসফিস থেকে ব্যাপারটা একটু আওয়াজে চলে গেল। কিন্তু ট্রেনের কোন প্রবলেম আমি দেখিনা। উনাদেরও কোন প্রবলেম দেখিনা। একবার এমনিতেই লেইট হয়েছে ট্রেন। তার উপর আবার চেইন টানলে আবার লেইট। ওদিকে আমার সব শিডিউল করা। একটা মিস হলে সব মিস। তাই আমিই আউটবারসট করলাম- “ম্যাডাম ট্রেনের কোন সমস্যা দেখিনা, আপনাদের কোন সমস্যা দেখিনা, তাহলে আপনি বার বার চেইন কেন টানতে বলছেন?”। এইবার মহিলা ডিরেক্ট অ্যাকশানে চলে গেলেন। উঠে দাঁড়িয়ে সাঁই করে উনার হাজবেনডের প্যান্টের চেইনটা টেনে দিয়ে বল্লেন-“কতবার বলেছি ওয়াশ রুম থেকে বের হয় প্যান্টের চেইন লাগাবা!!!”।
মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি আমি হয়তো একদিন আমার প্রেয়সীকে খুঁজে পাব এই স্টেশন চত্বরে। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করবে। সে ট্রেনের দরজা দিয়ে মাথাটা বের করার আগেই তার এলোচুল বেড়িয়ে পড়বে। এক হাতে আমি তাকে ট্রেন থেকে নামাবো। তার কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাব জীবন জগতে। হয়তো আমার মত স্বপ্ন দেখেছিল বলেই এই চত্বরে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’র দিবা খুঁজে পেয়েছিল অজিতকে। কিংবা ডিডিএলজে এর রাজ পেয়েছিল সিমরানের হাত।
এই স্টেশন অনেক কিছুর সাক্ষী। সাক্ষী প্রিয়কে প্রিয়ার অস্রুশিক্ত বিদায়ের, সাক্ষী বাবা’মার সন্তানকে চোখের জলে বিদায়ের, কিংবা ভালবাসার মানুষকে ‘ভালবাসি তোমায়’ বলতে না পারা গোপন প্রেমিকের বিদায়ের। এই স্টেশনে ফুটেছে অনেক ভালবাসার ফুল।
ভাল থাকুক সেই ভালবাসার ফুলগুলো, ভাল থাকুক মিষ্টি বকুলগুলো!!!!!
বিদ্রঃ গত ৩ দিন পুরো সিলেট চষে বেড়িয়েছি। সিলেট রেল স্টেশন থেকে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসে শ্রীমঙ্গল যাওয়ার সময়
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৮:৫৪