টিউলিপ-ম্যানিয়া - ইতিহাসের প্রথম মূল্য-ধ্বস
মানুষ স্বভাবতই অল্প পুজিঁ আর পরিশ্রমের দ্বারা অধিক উপার্জন আর লাভবান হতে আগ্রহী হয়ে থাকে; আর এই প্রক্ষাপটে প্রথমেই সে যা করে তা হলো নিজের বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা ত্যাগ করে অন্যের মতামতের ভিত্তিতে বিনিয়োগে উসাহী হয়ে ওঠে... এমন কি কোনো ধরনের নতুন ব্যবসায় যদি লাভের পরিমাণ অধিক হয় তবে সেই ব্যবসা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ব্যক্তিবর্গও তাদের সর্বস্ব সেই খাতে বিনিযোগ করে এবং বিচার - বিবেচনা না করেই ক্রয় - বিক্রয় করে সাময়িক লাভের মুখ দেখলে অন্যদেরকেও এতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী করে তোলে এবং যখন মূল্য ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে তখন ভয়াবহ আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুক্ষিণ হতে বাধ্য হয়! পৃথিবীর ইতিহাসে হুজুগে মেতে ব্যবসায় আগমন করা এবং পরবর্তীতে নিঃস্ব হওয়ার এমন ঘটনার পূণরাবৃত্তি ঘটেই চলছে... এমন কি আমদের এই দেশেও ---
টিউলিপ। এক অনিন্দ্য সুন্দর ফুল। ১৫দশ শতকের মাঝামাঝি সময় মধ্য এশিয়ার পামির-হিন্দুকুশ-তিয়েনশান পার্বত্য এলাকা থেকে যা চীন-ইরান-উত্তর আফ্রিকা পথ পেরিয়ে ইউরোপের উত্তরাংশ হয়ে পশ্চিমাদের দৃষ্টিআকর্ষণ করতে সক্ষম হয় এবং প্রাচ্য ও পশ্চাত্যে অন্যতম প্রধান ফুল হিসেবে রাজত্ব করে চলেছে গত উন-বিংশ শতকের শেষ থেকে শুরু করে এই এক-বিংশ শতকেও। সাধারণতঃ পেয়াজ জাতীয় মূল, যাকে বাল্ব বলা হয়, সেখান থেকে বেড়ে ওঠা পদ্ম-জাতীয় এই ফুলের রং-বেরং-এর ১০৯ টি প্রজাতি রয়েছে, যার অধিকাংশই চমৎকার ও দৃষ্টি নন্দন। এক জাতীয় ভাইরাস এই ফুলে আক্রমন করলে এর রং-এর মাত্রা ও বর্ণে ভিন্নতা আসে কিন্তু পরবর্তী কালে তা একই বীজ হতে ফুলের উৎপাদনের সময় বজায় না-ও থাকতে পারে; এবং এই থাকা না থাকার উপর ভিত্তি করেই বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রথম হুজুগে ক্রয় করা ও সেখান থেকে নিঃস্ব হওয়ার ইতিহাসের শুরু...
১৫৯৩ সালে ক্যারলস ক্লুসিস নামক একজন উদ্ভিদতত্ত্ববিদ প্রথম কনস্টান্টিনোপল থেকে এটিকে হল্যান্ডে নিয়ে আসেন ঔষধ বিষয়ক গবেষণার উদ্দেশ্যে; কিন্তু তার কিছু প্রতিবেশী এই ফুলের বর্ণচ্ছটা আর দুর্লভ্যতার কারণে (তখণ এটি প্রথম ডাচদের নিকটে পরিচিতি লাভ করছে) ক্লুসিসের বাগান থেকে কয়েকটি টিউলিপের বাল্ব চুরি করে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে দেয় এবং এর মাধ্যমেই শুরু হয়ে হল্যান্ডে টিউলিপের বাল্বের ক্রয় - বিক্রয়ের ব্যবসা।
টিউলিপের গাছে গ্রীস্মে (মে হতে জুন) ফুল ফোটে এবং তখন টিউলিপের বাল্ব সংগ্রহ করা হয় যা শীতে (সেপ্টেম্বরে হতে ডিসেম্বর) পুনরায় রোপন করা হয় এবং পুনরায় লাগানোর পরই (টিউলিপের গাছে ফুল / বাল্ব আসার আগে) এটি বিক্রি করে দেয়া হয়। ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে ডাচদের মধ্যে এই ব্যবসাটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে মুলত এই ব্যবসার দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের কারণেঃ
১. এটি গাছে থাকা অবস্থায়ই কেবল মৌখিক চুক্তিতে ক্রয় - বিক্রয় করা হতো (আমাদের দেশে রাজশাহী অঞ্চলে আম বাগান যেভাবে ক্রয় - বিক্রয় করা হয়; অনেকটা সেভাবে) এবং
২. এটি শেয়ারের মতো পুনঃ ক্রয় - বিক্রয় করা যেতো (অর্থাৎ বিক্রতা পুনরায় এটি কিনে নিতে পারতো / ক্রেতা এটি নতুন কোনো ক্রেতার নিকট বিক্রি করে দিতে পারতো; অধিক বা স্বল্প মূল্যে)।
১৯৩৬ সালের শেষের দিকে টিউলিপের বাল্বের মূল্য পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে; এবং ডিসেম্বর (১৯৩৬) - জানুয়ারী (১৯৩৭) সালে এর মূল্য এক কথায় আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে, কেবল ক্রেতা আছে বিক্রেতা পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ে। তখন এক একটি টিউলিপের বাল্বের মূল্য বর্তমান বাজার দরে প্রায় ১,২০০ হতে ২,০০০ ডলারে বিক্রি হতে শুরু করলো যার মূল্য পরিশোধ করা হতে লাগলো গিল্ডার্স (স্থানীয় মুদ্রা)-এর পাশাপাশি আসবাবপত্র / কাপড় / স্বর্ন / পনির প্রভৃতির দ্বারা; অথচ তখনও টিউলিপের বাল্ব গাছেই আছে! ব্যবসায়ীরা মাসে প্রায় ৬০,০০০ ডলার (বাংলাদেশী টাকায় হিসেব করলে প্রায় ৫০,০০,০০০) বা এরও বেশি আয় করতে লাগলো; ফলে সকলেই এই ব্যবসায় নেমে পড়লো! এবং মূল্য ক্রমাগত বাড়তেই থাকলো গাছে থাকা টিউলিপের বাল্বের! এভাবে এমন এক সময় এলো যখন ক্রেতা মূল্য পরিশোধের উপায় খোজে পেলো না, কারণ তার নিকট শুধু প্রতিশ্রুতি রয়েছে; ফলে ৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৭ সালে সর্ব্বোচ্চ সীমায় পৌছে পরবর্তী দিন হতে ধ্বসে পড়লো...
আমাদের দেশের বর্তমান শেয়ার বাজারের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই কোনো কিছু নিয়ে অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে কেবল হুজুগে মেতে অসংখ্য মানুষ তাদের সর্বস্ব বিনিয়োগ করেছিলেন; আর যখন মূল্য ক্রমাগত নিম্নমুখী হয়েছে তখন সাময়িক ভুল বুঝতে পেরেও নিজেদের এই সর্বনাশের জন্য অন্যদের দায়ী করে মাতা-মাতি করছে আর নিজ মনে ভাবছে “আমরা কি ভেবে এমনটি করেছিলাম!”
কেবল আমাদের দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রেই এমন হুজুগে মাতা-মাতি করার অভ্যাস দেখা যায় সাধারন লোকদের মধ্যে যারা সংশ্লিষ্ট ব্যবসা সম্পর্কে আগু-পিছু কিছু না জেনে বা বুঝেই শুধু মাত্র লাভের মোটা অংকের লোভে ভাসা-ভাসা তথ্য আর নিজের ভাগ্যের উপর অগাধ আস্থা রেখে বিনিয়োগ করে সর্বসান্ত হয়ে নিজের এবং পরিবারের সকলের জন্য ডেকে আনেন দুর্দশার করাল থাবাকে।
________________________________________________
লেখার সূত্রঃ
1. Clough, S. B. (1968). European Economic History: The Economic Development of Western Civilization. New York: McGraw-Hill.
2. Garber, P. M. (2000). Famous First Bubbles: The Fundamentals of Early Manias. Cambridge Massachusetts: The MIT Press.
3. Kindleberger, C. P. (1978). Manias, Panics, and Crashes: A History of Financial Crisis. New York: John Wiley and Sons.
4. Posthumus, N. W. (1929). The Tulip Mania in Holland in the Years 1636 and 1637. Journal of Economic and Business History, Vol: 1. Pp: 434-466.
5. Smith, Adam. (1776). An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations. New York: Random House.
6. wiki
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন