আমি সেই ছোটবেলা থেকেই দেখেছি কিভাবে ইসলামপন্থী এবং হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদীরা বলপূর্বক আমাদের বাংলাদেশ সত্ত্বাটাকে কেড়ে নিচ্ছে।তারা দিনকে দিন নানা ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠছে। অন্যদিকে তাদের সংখ্যাটা বেড়ে এখন এমন একটা জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে স্বয়ং রাষ্ট্র পর্যন্ত তাদের বেশ ভালোই পরোয়া করে। প্রথমে ইসলামপন্থী মৌলবাদীদের দিয়ে শুরু করছি।তারা সবসময় বাংলাদেশ ৯০% মুসলমানের দেশ বলে বেশ গর্ব বোধ করে। সুতরাং এই বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যতীত আর কিছু চলতে পারে না। এভাবে তারা একটি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের আকাঙ্খাকে ধীরে ধীরে একেবারে সমূলে উতপাটনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা বেশ সফল। এই অংশটাই বাংলাদেশে খুব তীব্রভাবে পাকিস্তানের সমর্থক। সেটা স্রেফ খেলার মাঠে নয়। মননে মগজে সব সময়। কারণ পাকিস্তান একটা মুসলমান রাষ্ট্র। বেশ সফলভাবে সকল ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রায় নিশ্চিহ্ন করে পাকিস্তান আজ ৯৮% মুসলমানের দেশ। ঠিক এই কারণেই তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। শুধু সমর্থন না। তীব্র ভালবাসাও তারা প্রকাশ করেন। এই বিষয়টা উপলব্ধির জন্য বেশি কিছু না, যেকোনো সংবাদ মাধ্যমের পাকিস্তান সম্পর্কিত যেকোনো নিউজের নিচের কমেন্টগুলোর দিকে তাকালেই আমরা তা স্পষ্ট দেখতে পারবো।আমাদের দেশের কোমলমতি শিশুদের সরল মস্তিষ্কককেও তারা তাদের এই চিন্তা দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখে।তাদেরকে ছোট বেলা থেকেই পাকিস্তান সমর্থন করতে শেখানো হয়। এক প্রকার ইচ্ছাকৃতভাবে এবং পরিকল্পিতভাবেই তারা এ কাজটি করে।মাঝে মাঝে ছোট্ট শিশুরা যখন ১৯৭১ সাল নিয়ে প্রশ্ন তুলে তখন তারা সেটাকে স্রেফ একটা মিসটেক বলে খুব সুকৌশলে পুরো যুদ্ধটাকে এড়িয়ে যায়।এড়িয়ে যায় ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ। বিশ্বকাপে ভারত হারলে আর পাকিস্তান জিতলে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ যে পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসায় উতলে উঠে তার নেপথ্যে এই ইসলামপন্থী মৌলবাদী সম্প্রদায়ের পাকিস্তানপন্থী চিন্তা এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পরিবর্তে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বির্নিমানের তীব্র আকাঙ্খাই মূলত দায়ী। এজন্যই মাঝে মাঝে পাকিস্তান জিতলে কিংবা ভারত হারলে তারা এতটাই উতলা হয়ে পড়ে যে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা করে তাদের সেই আনন্দ উদযাপন করতে হয়। তারা এতটাই উতলা হয়ে পড়ে যে “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” বলে তারা ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে তুলে। এতটাই কাঁপিয়ে তুলে যে ইমরান খান নিজেও কনফিউজড হয়ে যান তিনি এই ম্যাচটা ঢাকায় জিতলেন না লাহোরে জিতলেন।এই নিকৃষ্ট সম্প্রদায়টির প্রতি আমার একরাশ থু থু ছাড়া আর কিছুই জানানোর নেই।
এবার আসি দ্বিতীয় বিষয়টিতে। হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদীদের প্রসঙ্গে। ওই মুসলিম সম্প্রদায় ঠিক যে কারণে পাকিস্তান সাপোর্ট করে ঠিক ওই একই অর্থাত ধর্মে মিল থাকার কারণে এই সম্প্রদায়টি বাংলাদেশের হিন্দুদের সব সময় ভারতকে সমর্থন দেয়ার ব্যাপারে উতসাহিত করে তোলে। ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের নানাভাবে সহায়তা করেছিল সেই উপকারের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেই বলছি সীমান্তে যে ভাবে তারা বাংলাদেশীদের মেরেছে এবং মারছে, আমাদের দেশে যেভাবে বলপূর্বক রামপাল চুক্তি বাস্তবায়ন করছে, যেভাবে আমাদের অর্থনীতির বড় একটি অংশ শোষণ করছে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।কিন্তু এই বিষয়গুলো না দেখে হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদীরা মনে করে ভারতই হিন্দুদের জন্য শেষ আশ্রয়স্থল এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর যে নির্যাতন হয় তা একমাত্র ভারতই সমাধান করে দিতে পারে। তাদের এই ভারতপন্থী চিন্তার প্রভাব দেখা যায় খেলায়ও। এজন্য ভারত জিতলে কিংবা পাকিস্তান হারলে সংখ্যালঘুত্বের ভয়ে তারা হামলা করেন না ঠিকই। কিন্তু মনে মনে হামলা করার তীবও বাসনা তাদের কাজ করে। ভারতে সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় আসলে তারা বেশ আনন্দ বোধ করেন। ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা হলে এটাকে মানবতার উপর হামলা না বলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার একটা প্রতিশোধ হিসেবেই তারা দেখেন।
এজন্য ক্রিকেট খেলার পরে এই দুই মৌলবাদী সম্প্রদায়ের হাতে গড়া প্রজন্মের যে উচ্ছাস আমরা দেখি তা যতটুকু না খেলায় জেতার উচ্ছাস তার চেয়েও বেশি ধর্মের উচ্ছাস। কারো কাছে এটা একটা ছোটখাটো ইসলামী বিপ্লব, কারো কাছে একটা ছোটখাটো হিন্দুত্ববাদী বিপ্লব।
তবে সবচেয়ে দু:খের বিষয় হলো বাংলাদেশে বর্তমানে এসব মৌলবাদী গোষ্ঠীর কারণে এমন একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে যারা পাকিস্তানকে ঘৃণা তো দূরের কথা, অনেক বেশি ভালবাসে। আবার আরেকটা গোষ্ঠী ভারতের শোষণের কথা ভুলে ভারতকে ভালবাসে।তারা এটি করে স্রেফ ধর্মের কারণে। খেলার কারণে পছন্দ করে এই সংখ্যাটা গুটি কতক। তাহলে আমাদের বাংলাদেশটা কোথায়? আমাদের বাংলাদেশ কি ক্রমেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে? তাই নয় কি!
লেখক
সৌরভ দাস
ইউনিভার্সিটি অব কাসেল
জার্মানি
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৯ রাত ১২:৪০