দুপুর ভর্তি রোদ । পৌষ আসি আসি করছে। পিঠ চিড়বিড় করা এই রোদের একটা বৈশিষ্ট্য হলো এর মধ্যে বেশিক্ষণ থাকা যায় না, আবার না থেকেও পারা যায় না। উভয় সংকট গায়ে লাগিয়ে হাঁটছি। আপাতত গন্তব্য ফার্মগেট। কেন যাচ্ছি জানি না। হঠাৎ মনে হলো আমার ওখানে থাকা উচিত।
সোনারগাঁ হোটেলের উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে আছি। জ্যামে আটকে আছে গাড়িগুলো। এক জোড়া চোখ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে সামনের বাসের জানালা দিয়ে। হা করা নারীমুখ সবসময় দেখার সৌভাগ্য হয়না। আমি জিভ বের করে ভেংচি কাটলাম। চোয়ালটা আরেকটু বড় হলো। চোখদুটো আরো বড় বড় করে তাকাচ্ছে। আবার ভেংচি কাটলাম। এবার চোখ নামিয়ে নিল। বেচারি লজ্জা পেয়েছে। আরেকবার তাকালেই একটা রাম ভেংচি কাটার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু তার আগেই জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। গাড়ি ছেড়ে দিল। আমি এখানে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়াবো। মানুষ দেখব। সুযোগ হলে ভেংচি কাটব।
আকাশটা কেমন বিষণ্ণ রকম নীল। কোথাও কিছু নেই। সব খা খা করছে। কেমন শান্ত ধীর একটা ভাব। নিচের পৃথিবীটাতে হাজার রকম ব্যস্ততার কিছুই ছুঁতে পারে না ওই জায়গাটা। অথচ আকাশের ব্যস্ততার দিনে সব উলট পালট হয়ে যায়। লণ্ডভণ্ড করে দেয় নিচের পৃথিবী। দুপুরের আকাশ কেমন একটা নির্জীব থাকে। আমার কাছে অবাক লাগে। ভালো লাগে। ঢাকা শহরের দুপুরগুলো খুব রহস্যময় লাগে।
কাঁধে হাত রাখলো কেউ। ঘুরে তাকিয়েই দেখি মাথা ন্যাড়া করা এক মোটা লোক। চোখে বিচ্ছিরি রকম এক কালো চশমা ঝুলিয়ে রাখা। পরনে দামী জামা প্যান্ট সত্ত্বেও কেমন যেন অন্ধ ভিখারির মতন লাগছে। আমি চিনতে পারছিনা।
-কই যাস হালুম?
- এইতো এখানেই। হঠাৎ এদিকে?
সম্বোধন বিহীন কথা বার্তা শুরু করলাম। আমাকে চিনে আমি চিনিনা এমন মানুষদের সাথে হরহামেশাই এটা করতে হয়। পদ্ধতিটা খুব কাজের।
-মানে কি! তুই জানিস না আমি এখানে জব করি।
- মনে ছিলনা। তা কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
- তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? মনে হচ্ছে আমাকে চিনতে পারছিস না!
- আরে চিনব না কেন?
-বাদ দে। ওই দিন নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানে বসিয়ে রেখে কই হাওয়া হয়ে গিয়েছিলি সেটা বল?
এইবার চিনতে পেরেছি ফাহাদ । আমার স্কুল জীবনের একবছরের ক্লাস মেট। অনেক মুটিয়ে গেছে। আমাদের ক্লাসের চিকনদের কাছেও সে চিকন হিসেবে গণ্য হতো। হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়। এবং কাকতালীয়ভাবে ঠিক দুপুরবেলাতেই। ফাহাদ দেখা হলেই খাওয়ায়। ফাহাদকে প্রথমে চিনতে পারিনি কারণ ওর ঘাড় অবধি লম্বা চুল ছিল। হঠাৎ করে ন্যাড়া হলো কেন জিজ্ঞেস করা উচিৎ।
-তুই মাথা কামালি ক্যান? ন্যাড়া ফকিরের মতন দেখাচ্ছে। একটা মহাপুরুষ মহাপুরুষ কিংবা অন্ধ ভিখিরিও হতে পারে ভাব চলে এসেছে! দারুণ।
-আর বলিসনা। শীতকালে মাথার সব চুল পড়ে যায় আমার কোন কিছুতেই কাজ হয় না। তাই ন্যাড়া করে ফেলি। এটাই শান্তি।
- তোর বুদ্ধিটা ভাল। সমস্যা যখন চুলে নাই করে দেয়াই ভাল। চুল নেই সমস্যাও নেই। কই যাচ্ছিলি?
- এখানে একটা রেস্টুরেন্ট আছে ভাল দম বিরিয়ানী পাওয়া যায়। আয় খাব। চল।
আমরা হাঁটছি। ফাহাদ আজকেও খাওয়াবে। রোদে দুজনের ছায়া পড়েছে রাস্তায়। ফাহাদকে গোল আলু মনে হচ্ছে। আমাকে কাঁচামরিচের মতন। শর্ষের তেলটা হলেই একটা ভালো আলু ভর্তা হয়ে যেত। ফাহাদকে কথাটা বলতেই হাসতে হাসতে রাস্তাতেই বসে পড়ল। চোখের কোণে পানি চলে এসেছে ওর....
আমি ওখানেই ওকে রেখে একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লাম । আমাকে ফার্মগেট যেতে হবে। কেন যেতে হবে জানিনা। কিন্তু যেতে হবে। ফাহাদ এখনো হাসছে। ওর চারপাশে মানুষ জমে গেছে। হাসিটা ওর ছোটবেলার একটা রোগ । একবার হাসি উঠলে আর থামেনা। হাসিটা একসময় কান্নায় পরিণত হয়। ব্যাপারটা একই সাথে লজ্জার এবং কষ্টের। একটা ন্যাড়া মাথার লোক রাস্তায় বসে হাসছে ধীরে ধীরে মানুষ বাড়ছে। আমিও ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছি। বন্ধুকে এমন একটা অবস্থায় ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না। উচিৎও না। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। কেন যেতে হবে জানিনা। কেন যেন মনে হচ্ছে খুব একটা বড় বিপদের কাছে যাচ্ছি। কি এক অজানা তাড়নায় ছুটছি জানিনা...