২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর! সামনে আমার এসএসসি পরীক্ষা। প্রায় দেড়মাসের মত একটানা পরীক্ষা চলবে! শত ব্যস্ততা আর পড়াশুনার মাঝেও বাড়িতে চলে এসেছি পরিবারের কাছ থেকে দোয়া নেওয়ার জন্য! অনেকদিন পর বাড়িতে আসার কারণে বাবা-মা, ভাই-বোন সহ সবাই অনেক খুশি। আম্মা খুশিতে আটখানা হয়ে বললেন- 'অনেকদিন পর বাড়িতে আসলি, আবার কবে আসতে পারবি তার তো ঠিক নেই! সুতরাং আর দু'একটা দিন থেকে যা!'
বাবাও মা'র কথার সাথে সম্মতি জানালেন! যদিও তখন থাকার মত কোন পরিবেশ পরিস্থিতি ছিল না, তবুও বাবা-মায়ের কথা ফেলতে পারলাম না। তাছাড়া আসার সময় কিছু গুরুত্বপূর্ন বইও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম, সুতরাং পড়া-শুনার খুব একটা যে সমস্যা হবে তেমন না! তবে সব থেকে বড় সমস্যা ছিল কলেজ কর্তৃপক্ষকে সামলানো! কলেজের নিয়ম কানুন খুবই কড়া! আধুনিক বাংলায় যেটাকে বলা যায়- 'হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না!'
বাবা বললেন- 'কলেজের ব্যাপারটা আমি বুঝবো! তোর যদি থাকলে কোন সমস্যা না হয়, তাহলে তোর মায়ের কথা শুনে আরো কয়েকটা দিন থেকে যা! তাছাড়া আসমানের অবস্থাটাও খুব বেশি ভাল বলে মনে হচ্ছে না! কখন কি হয় না হয় কিচ্ছু বলা যাচ্ছে না! রেডিওতে কিছুক্ষন আগে ৫ নং সতর্ক সংকেত চলতে চলতে হঠাৎ করে ৭ নং মহা-বিপদ সংকেত চলে এসেছে! যদি মরি তাহলে পরিবারের সবাই যেন একসাথেই মরতে পারি আপাতত আল্লাহর কাছে কেবল এই প্রার্থনা কর!'
বুঝতে পারছিলাম, মনে মনে বাবা ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন! সুতরাং বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে এই মূহুর্ত্বে তার পাশে থেকে তাকে সাহস যোগানোটা আমার একান্ত কর্তব্য! আম্মাও দেখলাম অসম্ভব রকমের মুষড়ে পড়েছেন! কথায় আছে না, ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়! আমার বাবা-মায়ের অবস্থাও হয়ে গেছে অনেকটা সেইরকম!
মায়ের কাছে গল্প শুনেছিলাম- ১৯৮৮ সালের প্রবল বন্যার কথা। তখন আম্মার বিয়ের বয়স মাত্র দুইবছর! ১৯৮৬ সালের জুন মাসে বাবা-মায়ের বিয়ে হয়! বিয়ের সময় আম্মা নাকি পিচ্চি একটা মেয়ে ছিলেন। শশুর বাড়িতে এসেও তিনি বউ পুতুল খেলা ছাড়তে পারেননি এই রকম বয়স। আম্মার কাছে সেই বন্যার রাত্রের একটা গল্প শুনে খুবই মজা পেতাম। আম্মা বলতেন- 'সেই রাত্রের ঝড়ে আমাদের ঘরের চাল উড়ে গেলে বাবা নাকি কাঁধে করে আম্মাকে আমার বড় চাচার ঘরে দিয়ে এসেছিলেন।'
৮৮ সালের সেই ঝড়ের কবলে পড়ে আমাদের বড় বড় প্রায় চারটা গরু মারা যায়। এবং ক্ষেতের ফসল সহ আনুসঙ্গিক ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ছিল মাত্রা ছাড়ানো। প্রায় পনের দিনের মত আমাদের পরিবারের সদস্যরা পানি বন্দি হয়ে অসহায় ভাবে জীবন যাপন করতে থাকে। খুদের চালের ভাত জাউ ( জাউটা আসলে কি (?) আমি সেটা সঠিক জানি না) রান্না করে নাকি তারা নিজেদের ক্ষুধা নিবারন করতেন। তাছাড়া শুধু আমাদের পরিবারের সদস্যরাই না, গ্রামের সব গুলো মানুষের মধ্যেই তখন ঐ একই পরিবেশ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।
সে যাহোক, তো সেদিন আসরের নামাজের পরে গ্রামে মাইকিং করে ঘোষণা করা হল; সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে! এমনকি প্রতিটা মসজিদ থেকেও বিপদ সংকেত গুলো বারবার করে ঘোষণা করা হচ্ছিল! আকাশের অবস্থা তখন মেঘাচ্ছন্ন! দমকা বাতাস বয়ে চলেছে, যেটা ঘন্টায় প্রায় ১১০ থেকে ১২০ কিঃ মিটার বেগে উড়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামের উপর দিয়ে। রাত্রে আমরা সবাই একসাথে বসে যৎ-সামান্য কিছু খাওয়া-দাওয়া করলাম! আমাদের বাড়ির অবস্থাটা মোটা-মুটি ভাল ছিল। বিল্ডিং, তবে ঘরের চাল ছিল টিন সেডের (যেটাকে গ্রাম্য ভাষায় এজবেস্টার বলা হয়)। সেজন্য আমরা কেউ আর কোন সাইক্লোন সেন্টার বা ভাল কোন অবস্থানে গেলাম না! যদিও প্রথম দিকে আম্মা কিছুটা খুঁতখুঁত করছিলেন, তবে বাবার চোখ রাঙানিতে সেটা আর বেশিক্ষণ ধোপে টিকলো না। তখন সেটা চাপা গজগজানির মত আমাদের কানের কাছে এসে আছড়ে পড়তে লাগলো! 'এখন কিছু বলছি না, তবে আমার ছেলে মেয়ের কিছু হলে বুড়োটার মজা তখন দেখাবো' গজগজানির ধারা অনেকটাই এই টাইপের। তাছাড়া সত্যি কথা বলতে আম্মা বাদে অতিরিক্ত লোক সমাগমও আমাদের পরিবারের কারোরই ততটা ভাল লাগতো না!
দুপুরের পর বাবা-মা আর আমি তিনজনে মিলে আমাদের ঘরের চারিপাশে মজবুত খোঁটা পুঁতে তার সাথে এবং চালের সাথে শক্ত করে দঁড়ি বাঁধলাম, যেটা আমাদের গ্রাম্য ভাষায় ঘরের কান্সন দেওয়া বলে! যাতে প্রবল ঝড়ের কবলে পড়লেও ঘরের চাল যেন উড়ে যেতে না পারে। সুতরাং খুব একটা যে ভয় ছিল তাও না! রাত্রের খাবার খাওয়ার সময় আমার ছোট ভাই-বোন দু'টোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ভয়ে তাদের দু'জনেরই মুখ শুকনো খটখটে হয়ে গেছে! তাদের মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম, আমার পিচ্চি হাসি-খুশি ভাই-বোন দু'টো কি পরিণামে ভয় পেয়ে গেছে! রাত্রে তারা কিছুই খেল না। কেবল মুখ ভার করে দু'জন আমাদের পাশে বসে আমাদের খাওয়া-দাওয়া পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। সম্ভাবত ওরা ভাবছিল, এই বিপদের দিনে আমাদের মুখে ভাতের গ্রাস উঠছে কিভাবে (?) এই ধরনের কিছু।
তখন ছোট ভাইটার মুখে কেবল মাত্র আধো-আধো বোল ফুঁটতে শুরু করেছে। তবে ভয়ংকর ভয় পেলে স্বাভাবিক ভাবেই বাচ্চারা তোতলাতে শুরু করে। কারণ তারা মানসিক ভাবে এতটাই দূর্বল এবং বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে, তাদের মুখের থেকে ভিতরটা বেশি তোলপাড় করতে থাকে। যার কারণে স্বাভাবিক কথাটাও তারা স্বাভাবিক ভাবে বলতে পারে না, বরং জড়িয়ে পেঁচিয়ে সেটাকে আরো ভয়াবহ করে তোলে। সুতরাং ঐ অবস্থাতেই ছোটভাইটা তোতলাতে তোতলাতে বারবার করে বলছে- 'ভাইয়া, আমরা যদি সবাই মরে যাই তাহলে তারপর আমরা কোথায় যাব? আমরা কি সত্যিই মরে যাব ভাইয়া?'
কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছিলাম না! আসলে আমার নিজেরই তো ভয়ে আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার দশা! তবে বুঝতে পারছিলাম ওদের সাথে এখন আমার স্বাভাবিক ধরনের আচরন করা উচিত। কেননা আমি নিজেই যদি ওদেরকে ভয়ের কথা বলি, তাহলে তো ওরা আরো বেশি ভয় পেয়ে যাবে। হয়তো, তখন তাদের স্বাভাবিক জীবন ধারাটাও বদলে গিয়ে সেটা অ-স্বাভাবিক কোন ব্যাপারে গিয়ে ঠেকবে। কোন রকমে ছোট ভাইটাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে চুপ করিয়ে রাখলাম। কিন্তু একটা চুপ করলে আর একটা শুরু করে। এমনিতে ছোট বোনটার মুখে সারাক্ষণ কথার খই ফোঁটে। তবে আজ সে কেমন যেন অ-স্বাভাবিক ভাবে চুপচাপ হয়ে আছে। দেখলে মনে হচ্ছে যেন, আজকের পর থেকে জীবনে আর সে কখনো কথাই বলবে না। কিংবা সে হয়তো একদম সব কথা ভুলে গেছে। এই মূহুর্ত্বে ধমক-ধামক দিয়ে চুপ করানোর মত পরিবেশও এখন আর নেই। সুতরাং কোন রকমে তাদের মত করেই আমাকে বুঝিয়ে যেতে হচ্ছে। তারপর রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা সবাই এক জায়গায় গোল হয়ে বসে পড়লাম। আম্মা ছোট ভাই-বোন দু'টোকে শুয়ে পড়তে বললেন! কিন্তু তারা শোবে না! আতংকে যেন তারা ঘুমাতেও ভুলে গেছে।
বাবার প্রচুর পান খাওয়ার অভ্যাস ছিল। তিনি পান খেতে খেতে ঝড়ের সময় আমাদের কর্ম পদ্ধতী গুলো ব্যাখ্যা করতে লাগলেন! আমরা সবাই উৎসুক ভাবে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তার বলা কথা গুলো গিলতে লাগলাম। তবে সেগুলো হজম করতে পারছি বলে মনে হল না। ঠিক হল, ঝড়ের সময় যদি আমাদের ঘরের চাল উড়ে যায়, তাহলে বাবা ছোট বোনকে আর মা ছোট ভাইকে কোলে করে নেবেন! আর আমি থাকবো বাবা-মায়ের ঠিক মাঝ খানে! খুব শক্ত করে তাদের আঁচল ধরে রাখবো, যাতে ঝড়ের ঝাপটায় আমি কোন মতেই ছুটে যেতে না পারি! এভাবে অনেকক্ষন ধরে কথা বলতে বলতে দেখলাম, ছোট ভাই-বোন দু'টো পরম নিশ্চিন্তে মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে।
রাত তখন কত হবে? ঐ সাড়ে এগারটা কি বারটা! এতক্ষন পরিবেশ কিছুটা নিস্তব্ধ মেরে ছিল। বুঝতে পারছিলাম, এটা প্রবল ঝড়ের অশনি সংকেত। জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, চারিদিকে কেমন যেন জমাট বাঁধা অন্ধকার বিরাজ করছে। যে অন্ধকারে নিজের হাতের তালু পর্যন্ত দেখা যায় না। এতক্ষণ গুমোট ভাব ধরে থাকার কারণে আতংক ভাব কিছুটা হলেও কেটে গিয়েছিল। ঠিক এমন সময় হঠাৎ করে শুরু হয়ে গেল প্রকৃতির তান্ডব! এক একবার দমকা হাওয়া এসে আছড়ে পড়তে লাগলো আমাদের ঘরের বাইরের দেওয়ালের উপর। যেন একপাল দৈত্য একসাথে মিলে আমাদের ঘরের দেওয়ালে এসে প্রচন্ড ভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। যার আঘাতে মাঝে-মাঝেই ঘরটা আমচকা দুলে-দুলে উঠছে। মনে হচ্ছিল যেন, ঘরটা না ভাঙা পর্যন্ত তারা ঠিক শান্তি পাচ্ছে না।
ঝড়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাইরে তখন প্রচন্ড শব্দ করে মূহুমূহু বজ্রপাত হচ্ছে, আর সেই সাথে সাথে চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি! ছোট থাকতে বইতে 'সূর্য বড় না বাতাস বড়' নামক একটা গল্প পড়েছিলাম। মনে হচ্ছে আজকের গল্পটা হবে 'ঝড় বড় না বজ্রপাত বড়' টাইপের! এরা দু'জনেই যেন আজ নিজেদের শক্তিমত্তার পরিচয় দেওয়ার জন্য এই পৃথিবীকে নিয়ে একটা উন্মত্ত খেলায় মগ্ন হয়ে উঠেছে! প্রবহামান বাতাসের বেগ তখন ঘন্টায় দুই'শ কিঃ মিটারের উপরে অবস্থান করছে। ঘরের মধ্যে আমরা তিনজন মানুষ জবুথবু হয়ে বসে আছি। কিছুক্ষন পরপর আম্মা দেখলাম মুখের উপরে কাপড় চাপা দিয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে উঠছেন! বুঝতে পারলাম তিনি কাঁদছেন! এর মধ্যেই মাঝে- মাঝে বাবা জানলায় মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করে পাশের বাসার চাচা-চাচিদের খবরও নিচ্ছিলেন!
সবাই আতংক গ্রস্ত! ঝড় শুরু হওয়ার ঠিক আধা ঘন্টার মাথায় ঝনঝন করে খুব জোরে একটা শব্দ হল। বুঝলাম আমাদের গোয়াল ঘরের চাল উড়ে গিয়ে ক্ষেতের উপরে আছড়ে পড়েছে। তখন ভয়ে আমার পিলে চমকে যাওয়ার মত অবস্থা! আমাদের গোয়াল ঘর থেকে ক্ষেতের দূরত্ব প্রায় দুই'শ থেকে তিন'শ গজ। এতদূর অবধি একটা ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। আসলে ভয়টা হল, সেই দুপুরের সময় আমাদের বড় ঘরের মত করে গোয়াল ঘরের চালেও কান্সন এঁটে ছিলাম। অথচ ঝড় শুরু হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই যখন সেটা টিকলো না, তখন বসত ঘরের চাল আর কতক্ষন টিকবে (?) এটা নিয়েই মনে ঘোর সন্দেহ দেখা দিল! আমরা তিনজনে তখন উচ্চশব্দে দোয়া কালাম পড়তে লাগলাম!
কিছুক্ষন পরপর গোয়াল ঘর থেকে আমাদের গরু দুইটার ভীত সন্ত্রস্থ অসহায় হাম্বা ডাকের শব্দ আমাদেরকে আরো বেশি বিচলিত করে তুলছিল! বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি গরু গুলোকে এনে বসত ঘরে তুলবেন! নিরীহ প্রাণী হলেও তাদেরও তো আমাদের মত জীবন আছে! সারারাত যদি তারা এভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে তাহলে তারা আর বাঁচবে না। বাবা ভীষণ সাহসী একজন মানুষ ছিলেন! অথচ তার এই সিদ্ধান্তের কথা শুনে আম্মা কান্না থামিয়ে বাবার পায়ে উপরে গিয়ে পড়লেন! তাদের এই অবস্থা দেখে এবার আমার কান্নার পালা। আমি চিৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আমার কান্নার শব্দ শুনে ছোট ভাই-বোন দু'টো হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে কোন কিছু না বুঝেই আমার সাথে মরা কান্না জুড়ে দিল! সম্ভাবত এতক্ষণ তারা ঘুমের মধ্যে কোন দুঃস্বপ্ন দেখছিল , আর নয়তো আমার হঠাৎ এমন কান্না দেখে হয়তো ভাবছিল বিপদ চরমে পৌঁছে গেছে।
আসলে অবস্থাটা তখন আউট অব কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেছে। বাবা-মা আমাদেরকে যতই বুঝাতে চাচ্ছেন, আমাদের আর বুঝ আসছে না। এমন সময় বাইরের দরজার উপর হঠাৎ খটখট আওয়াজ শোনা গেল। আর সেই সাথে সাথে দরজা খোলার জন্য সেজ কাকুর তীব্রো আর্ত্মচিৎকার। বাইরে দমকা হাওয়ার ঝাপ্টা তখন ঘন্টায় ২১০ থেকে ২২০ কিঃ মিটার বেগে বয়ে চলেছে। বাবা দরজা খুলতেই কাকু ঘরে প্রবেশ করলেন। আর সাথে সাথে একরাশ দমকা জোরালো হাওয়া আমাদের রুমের মধ্যে ঢুকে রুমটা আন্দোলিত করে দিল। কাকুর পরনে লুঙ্গী! তবে সেটা মালকোঁচা মারা! কোমরে শক্ত করে গামছার প্যাঁচ দেওয়া। ঢুকেই জানতে চাইলেন, হঠাৎ এমন কান্দা-কাটার কারণ কি?
বাবা কাকুর কাছে স্ব-বিস্তার বর্ননা করলেন! তারপর দু'জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন গরু দু'টোকে খুলে কাকুর গোয়ালে নিয়ে যাবেন! কাকুর গোয়াল ঘরটা এখনো পর্যন্ত বেশ ভাল আছে। তাছাড়া তখন এটা করা ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না! সাথে সাথে আমরা ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। বাবা ছাড়া ঘরের মধ্যে আমরা কিভাবে থাকবো? বিশেষ করে আম্মা তো একদম মুষড়ে পরলেন! তিনি বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও বাবা শুনলেন না। গরু দু'টোকে না বাঁচাতে পারলে তিনি নিজেকে চরম অপরাধী মনে করবেন। তাছাড়া সাথে যখন কাকু আছে, তখন আর কিসের ভয়? বাবার কথা শুনে মনে হচ্ছিল যেন, সাথে কাকু থাকলে তিনি এই মূহুর্ত্বে ভয়াল রাতকেও উপেক্ষা করে লঙ্কা জয় করে আসতে পারবেন। আসলে অনেক সময় এমনটা হয়। প্রচন্ড বিপদের সময় যদি সাথে কোন সাহসী মানুষ পাওয়া যায়, তাহলে নিজের সাহসটাও তখন অনেকাংশে বেড়ে যায়। আমাদেরকে ভালভাবে বুঝিয়ে কাকুকে সাথে নিয়ে বাবা সেই ঝড়ের মধ্যেই বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করতে করতে আমি উঠে জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাদের কর্মকান্ড দেখতে লাগলাম।
বাবারও পরনে লুঙ্গী, সেটা মালকোঁচা দেওয়া! বাবার পা ঠকঠক করে কাঁপছে। কাকুও দেখলাম বাবার মতই ঠকঠক করে কাঁপছেন। দু'জনে কথা বলছেন বেশ অ-স্বাভাবিক কাঁপা কাঁপা স্বরে। তারা প্রথমে গরু দু'টোর দঁড়ি খুললেন। দঁড়ি খোলা টের পেয়ে গরু দু'টো ভীষণ ছোটা-ছুটি করতে লাগলো! তারপর তারা কোন রকমে গরুর দঁড়ি শক্ত করে ধরে কাকুদের গোয়াল ঘরের দিকে চলে গেলেন! হঠাৎ পাশের বাসা থেকে আমার চাচাত ভাই রাজু'র কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। সে আজান দিচ্ছে! আম্মা আমাকেও বললেন আজান দিতে। আমার পরনে তখন একটা থ্রি কোয়ার্টার! ঐ অবস্থাতেই অজু-গোছল ছাড়া দাঁড়িয়ে গেলাম আজান দিতে। আজান দেওয়াও শেষ, এমন সময় বাইরে আবারও হুড়মুড় করে শব্দ হল। আমি জানলার পর্দা ফাঁক করে দেখলাম, আমাদের মাটির তৈরি রান্না ঘরের দেওয়ালটা ধ্বসে পড়েছে।
বাবা বাইরে, অথচ তাকে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভাবত এখনো তাদের গরু বাঁধা শেষ হয়নি। গরু দু'টোও আতংক গ্রস্থ হয়ে এমন ভাবে ছোটা-ছুটি করছিল যে, তাদেরকে ধরে রাখাটাই তখন দ্বায়। আম্মা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন। ঐ অবস্থাতেই তিনি বাইরে যেতে চাইলেন। বাবা বাইরে, তার ভয় লাগছিল; না জানি মানুষটার আবার বড় ধরনের কোন বিপদ ঘটে গেল কিনা। আমি কোন রকমে আম্মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে তার সেই পাগলামী থেকে নিবৃত করে রাখলাম। বাবার জন্য আমার নিজেরই ভীষণ কান্না পাচ্ছিল, কিন্তু কেন জানি না সেদিন আমি একদম অন্যরকম একটা মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। মাত্র পনের-ষোল বছর বয়সের একটা বালক, অথচ আমার কার্যকলাপ দেখে মনেই হচ্ছিল না; আমার বয়স মাত্র পনের বছর। মনে হচ্ছিল যেন, আমি ষাট-সত্তর বছর বয়সের একজন মুরুব্বি ব্যক্তি; যিনি কথা বলার সময়ও বিচার বিবেচনা করে কথা বলবেন।
এর অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই বাবা ফিরে আসলেন। তার কোমরে গামছা দেখতে পেলাম না। জিজ্ঞাসা করতে বললেন- 'গামছা খুলে চোখ-মুখের পানি মুছতে গিয়ে হাত থেকে উড়ে গামছা চলে গেছে।' বুঝতে পারলাম বাইরের অবস্থাটা কি পরিমাণে ভয়াবহ! এভাবে রাত প্রায় দুইটা পর্যন্ত চলল। তারপর শুরু হল প্রলয় কান্ড! সারা গ্রামের মধ্যে তখন খালি মটমট করে শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন ভয়ংকর দর্শন কোন দৈত্য তার তীব্রো আক্রশ মিটাচ্ছে আমাদের এই ছোট্ট গ্রামটার উপর! মাঝে-মাঝে তীব্রো ঝড় আর মূহুমূহু বজ্রপাতের শব্দকে ছাপিয়ে অসহায় মানুষের মূমুর্ষ আর্ত্মনাদ এবং গৃহপালিত জীব-জন্তুরের করুণ আর্ত্মচিৎকারও ভেসে আসছিল আমাদের কানে। কিন্তু ঐ মূহুর্ত্বে বাইরে বেরিয়ে দেখার মত কোন পরিবেশ ছিল না তখন। এই অবস্থায় বাইরে যেতে হলে স্বাক্ষাত মৃত্যুকে সাথে করে নিয়েই বের হতে হবে।
আমাদের চালের উপরেও কিছু গাছের ডাল-পালা ছিল। বুদ্ধিকরে বাবা সেগুলো আগেই কেটে রেখেছিলেন! সেজন্য আমাদের চালের উপরে ডাল-পালার ঝাপটা তুলনামূলক কিছুটা কম ছিল। চোখে একদমই ঘুম নেই! শুধু আমার না! আমার পিচ্চি ভাই-বোন দু'টোরও দেখলাম একই অবস্থা! তারা মায়ের আঁচলের নিচে বসে চোখ পিটপিট করে বাইরে তাকাচ্ছে। ঠিক পাখির বাসায় সদ্য জন্ম নেওয়া ছানা গুলো যেমন মায়ের বুকের ভিতর থেকে চোখ পিটপিট করে বাইরের দৃশ্য দেখতে চায়, তেমন।
আমার ভীষণ হাসি পেল। কিন্তু ঐ মূহুর্ত্বে তখন হাসার মত পরিবেশ ছিল না! অন্য সময় হলে হয়তো দাঁত কেলিয়ে হেসে ফেলতাম! তবে তখন হাসির থেকে সেই দৃশ্যটাই ছিল সব থেকে ভয়ের, সব থেকে আতংকের! বাইরে ঝড়ের গতি তখন কত ছিল জানার উপায় নেই। কাকু আসলে দরজা খোলার সময় যে ঝড়ের একটা ঝাপ্টা এসেছিল, সেটাতেই রেডিও উল্টে পড়ে গিয়ে সেটা একদম অকেজো হয়ে গেছে। বাবা কিছুক্ষন ধরে ঝাকা-ঝাকি করেও যখন সেটা আর বাজাতে পারলেন না, তখন রাগ করে মাটিতে আছাড় দিয়ে তার অবস্থা আরো খারাপ করে ফেলেছেন! এখন সেটা চালু করলে ভিতর থেকে কেবল কূঞঊঈ....... জাতীয় এক ধরনের শব্দ বের হচ্ছে। তার মানে সম্ভাবত সেও ঝড়ের ভয়ে বাঁজতে নারাজ!
ভাঙা রেডিও নিয়ে বাবাকে এমন ঝাঁকা-ঝাঁকি করতে দেখে ছোট বোনটা সেই ভয়ের মধ্যেই হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠলো। বাবা কটমট করে তাকালেন তার দিকে! বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে সে আবারও চুপসে গেল। তবে বাবার তাকানোর ভঙ্গীটা ভয় পাওয়ানোর জন্য হলেও, আমার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছিল; সেই দৃশ্যটার মধ্যে শাষনের থেকে বেশি ছিল করুণ মিনতির চিহ্ন। অর্থাৎ বাবার চোখের ভাষাটা যদি পড়া যেত, তাহলে তার সারমর্মটা হয়তো অনেকটাই এরকম কিছু আসতো- "মা'রে, বিপদের সময় এমন ভাবে হাসতে নেই! হাসলে তাতে বিপদ আরো বাড়ে!"
রাত তখন তিনটা বাজে। ঘুমে আমার দু'চোখ জড়িয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু প্রচন্ড আতঙ্কের মধ্যে ঘুমাতেও পারছিলাম না। খালি মনে হচ্ছিল, একবার ঘুমিয়ে পড়লে সেই ঘুম যদি আর না ভাঙে? পৃথিবীতে এমন অসংখ্য রেকর্ড আছে! রাত্রে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, অথচ সকালে তাকে আর জীবিত উঠানো সম্ভব হয়নি। উঠাতে হয়েছে তার লাশ! এমনকি আমার এক আত্মীয়ও ঠিক একই ভাবে মারা গিয়েছিলেন। রাত্রে তিনি সবার সাথে গল্প-গুজব, খাওয়া-দাওয়া করার পরে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বিছানায় গেলেন ঘুমাতে! অথচ সকালে এত ডাকা-ডাকির পরেও তার আর ঘুম ভাঙে না। পরে ঘরের দরজা ভেঙে দেখা গেল, তিনি বিছানায় মরে পড়ে আছেন। ডাক্তার এসে পরীক্ষা নিরিক্ষা করে বললেন- 'হার্ট স্ট্রোক করে মারা গেছেন। মৃত্যুর সময় আনুমানিক রাত দুইটা থেকে তিনটা!'
বাতাসের বেগ তখন কিছুটা কমে এসেছে। চোখ পিটপিট করতে করতে ছোট ভাই-বোন দু'টো যে আবার কখন মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে, সেটা খেয়ালই করিনি। এখন তাদের চেহারাটা দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। একদম মায়াময় মন কাড়া চেহারা। শুনেছি ঘুমানোর পরে সব মানুষের চেহারার মধ্যেই নাকি একধরনের মায়া মায়া ভাব বিরাজ করে। আজ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম! মা লম্বা করে আঁচল বিছিয়ে তাদের দু'জনেরই পা ঢেকে দিয়েছেন। তারপর তাদের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করছেন। সম্ভাবত তিনি দোয়া দরুদ পড়ছিলেন। আমিও তাদের মত করে মায়ের উঁরুর উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আম্মা আমার মাথার উপরে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, 'ঘুমিয়ে পড়! যা হওয়ার হবে! মনে হয় ঝড় এবার একটু কমতে শুরু করেছে।' আমি কিছু বললাম না, চোখ বুজে শুয়ে রইলাম! আসলে বলবোটাই বা কি? কিছুই তো বলার নেই!
সকালে ঘুম ভাংলো মায়ের ডাকে! তখন সকাল প্রায় নয়টা সাড়ে নয়টা বাজে! বাইরে এসে দেখলাম আকাশ একদম পরিষ্কার! ঝলমলে রোদ উঠেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন গতকালকের রাতটা ছিল একটা দুঃস্বপ্ন! দুঃস্বপ্ন কেটে গিয়ে মানুষের ঘুম ভাংলে যে রকম অবস্থা হয়, এখন আমার অবস্থাও ঠিক সেরকম! গতকাল রাত্রে যে এই গ্রামের উপর দিয়ে একটা প্রলয় কান্ড ঘটে গেছে, আশেপাশের দৃশ্যটা না থাকলে হয়তো সেটা বিশ্বাসই করতে পারতাম না! চারিদিকটা একদম ফকফকা! মনে হচ্ছিল আমাদের সাঁজানো গ্রামটা যেন হঠাৎ কোন এক পিচাশ দৈত্যের আক্রশে পড়ে খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেছে। চারিদিকে গাছ, গাছের ডাল-পালা ভেঙে পড়ে আছে। মৃত জীব-জন্তুরের দেহ অসহায় ভাবে পড়ে আছে বাড়ির আঙিনায়, পথে ঘাটে। দেখে চোখে পানি চলে আসার মত অবস্থা!
আজ সিডরের নয় বছর হতে চলল। অথচ এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আজও সেই রাতের স্মৃতি আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়ায়! আজও ঘুমের ঘরে সেই রাতের স্মৃতিকে মনে করে গভীর রাতে দুঃস্বপ্নের মধ্যে মা বলে ডুকরে কেঁদে উঠি! কোল বালিশ জাপটে ধরে সেই প্রচন্ড ভয়কে তাড়ানোর চেষ্টা করি। চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পাই, সেই রাত্রের তীব্রো ঝড়ের শো শো শব্দ আর গগন বিদারী কান ফাঁটানো বজ্রপাতের পিলে চমকানো আওয়াজ। ভুলতে পারবো কিনা জানি না, হয়তো পারবো না! আসলে ভুলতে পারার মত কোন স্মৃতি যে সেদিন ছিল না! শুধু আমি কেন, আমার মত হাজারও যুবক হয়তো সেই রাতের স্মৃতিকে চাইলেও আর ভুলতে পারবে না! যে স্মৃতি একবার হৃদয়ের দৃশ্যপটে গাঁথা হয়ে যায়, আসলেই কি তাকে আর চাইলেও ভুলে থাকা যায়.......?
অফটপিকঃ- আলোচ্য ঘটনাটি আমার ডায়েরির পাতা থেকে নিয়ে পাঠকের জন্য সু-পাঠ্য করার লক্ষে কিছুটা পরিমার্জিত করে বাকিটা হুবহু এখানে উঠিয়ে দেওয়া হল!
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ- টাইপিংয়ের ভুলের কারনে হয়তো অনেক জায়গায় বানানে ভুল থাকতে পারে। সেটাকে বিবেচ্য বিষয় হিসাবে না ধরে, ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে কৃতার্থ হবো!