পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডিতে যোগদান করার পর থেকে জীবনে যে কত শত রকমের অদ্ভুতুড়ে কেসের মুখোমুখি হতে হয়েছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। মামুলী চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, পকেটমারি থেকে শুরু করে খুন, গুম, হত্যা, লুণ্ঠন, রাহাজানি, হাইজ্যাক, ইভটিজিং এমনকি প্রেমিক কর্তৃক প্রেমিকা বা প্রেমিকা কর্তৃক প্রেমিককে ছ্যাঁকা খাওয়ানোর মত কেসের ও তদন্ত করতে হয়েছে! এর মধ্যে হয়তো অনেক কেসের সমাধান করতে পেরেছি, আবার অনেক কেসের সমাধান করতে পারিনি। সমাধানকৃত কেসের জন্য হয়তো উর্দ্ধোতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনেক প্রশংসা পেয়েছি, আবার যে কেস গুলোর সমাধান করতে পারিনি তার ব্যার্থতা নিজের কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে তিরষ্কারও শুনেছি। কিন্তু তারপরেও মাঝে মধ্যে এমন কিছু অদ্ভুত কেস হাতে এসে পড়তো, যেগুলোকে ঠিক কেস বলা যায় না। কি রকম যেন গন্তব্যহীন ভাবে পথ চলার মত। অনেক চেষ্টা তদবির করেও যার কোন মাথা মুন্ডু খুঁজে পেতাম না। সেই সব কেস গুলো নিয়ে ঘাটতে ঘাটতে মাথা এতটাই গরম হয়ে যেত যে, তখন হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে উক্ত কেসের ঝাঁঝ নিজের পরিবারে উপরে ঢেলে কিছুটা হলেও মনের ঝাল মিটাতাম। তাছাড়া কেস গুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে ভাবতাম, 'এমন কেসের নজির যদি শার্লক হোমসের সময় থাকতো, তাহলে আমি নিশ্চিত তিনিও ঘোল খেয়ে যেতেন।'
আমাদের আইনি ভাষায় একটা কথা প্রচলিত আছে, যখন কেউ কোন অপরাধ ঘটায় কিংবা ঘটানোর পরিকল্পনা করে তখন নিশ্চই তার কোন মটিভ বা উদ্দেশ্য থাকে। কারণ উদ্দেশ্য ব্যতীত যে কোন কার্জ সিদ্ধি হওয়া সম্ভব নয়! অথ্যাৎ পৃথিবীর মধ্যে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনার মধ্যে একটা না একটা উদ্দেশ্য থাকবেই। কিন্তু অনেক পরিশ্রমের পরেও এই সকল কেসের মধ্যে আমি না পেতাম কোন উদ্দেশ্য, আর না পেতাম কোন আলোর দিশা। মানে গোটা ব্যাপারটাই যেন একটা রহস্যে ঘেরা অদ্ভুত রকমের সাসপেন্স!
ঠিক এমনই একটা কেস হাতে এসে পড়েছিল ২০১৪ সালের ২৯ শে এপ্রিল। কেসটা যেমন ছিল উদ্দেশ্য হীন, ঠিক তেমনি ছিল সাসপেনশান সমৃদ্ধ। যদিও শেষ পর্যন্ত কেসটার সমাধান আমি করতে পেরেছিলাম, কিন্তু তার সবটাই যে আমার ক্রেডিট ছিল তা বলবো না। কারণ আমি নিশ্চিত যদি ভিকটিম আমার সাথে কো-অপারেট না করতো তাহলে আমি কেন, পৃথিবীর কোন পুলিশই এই কেসের সমাধান করতে পারতো না। তবে মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে আমি সংক্ষেপে কেসটার সারমর্ম কিছুটা আপনাদেরকে জানিয়ে দিতে চাই। তাহলে কেসটার বিষয়ে বুঝতে আপনাদের আর কোন কষ্ট করতে হবে না। কেসটা ছিল এই যেঃ-
"গ্রামের মুসলিম ধনী এবং ঊশৃঙ্খল যুবক নাহিদ আলম সরদার নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে ফেরারি হয়। কিন্তু খুন করে পালিয়ে যাওয়ার সময় সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। প্রত্যক্ষ প্রমাণ অবশ্য তেমন কিছু ছিল না। কেউ নাহিদকে খুন করতে দেখেনি। কিন্তু পরোক্ষ প্রমাণ এতটাই জোরালো ছিল যে, সেটা থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার কোন উপায় ছিল না। নাহিদের স্ত্রী কমলা ছিল দজ্জাল মহিলা। নাহিদের সাথে প্রায়ই তার ঝগড়া হতো। এমনকি মাঝে মাঝে মারপিটও যে হতো, পাড়া পড়শি তার স্বাক্ষী ছিল। নাহিদ দ্বায়রা সোপর্দ হলো। মামলা যখন প্রায় শেষ হওয়ার পথে এবং নাহিদের প্রাণ রক্ষার কোন রাস্তাই আর খোলা নেই। ঠিক এমন সময় শ্রী অখিল চন্দ্র রায় নামে একজন স্থানীয় হিন্দু ভদ্রলোক স্বেচ্ছায় কোটের পক্ষ থেকে স্বাক্ষী দিলেন। তিনি বললেন,
-'যে রাতে এগারটার সময় নাহিদের স্ত্রী কমলা খুন হয়, সে রাতে সোয়া দশটা থেকে প্রায় বারটা পর্যন্ত নাহিদ অখিল রায়ের বাড়িতে ছিল। নাহিদ তার স্ত্রীর উপপতি।'
সওয়াল জবাবের পর আর সন্দেহ থাকে না যে অখিল রায় সত্য কথা বলছেন। তার স্বাক্ষের জোরে নাহিদ মুক্তি পায়। তারপর মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যায় এবং আসামী যে সু-বিচার পেয়েছে এব্যাপারেও কোন সন্দেহ থাকে না। তবুও আমার মন সন্তুষ্ট নয়। কোথায় জানি গুরুতর একটা প্রশ্ন এখনো অমিমাংসীতই রয়ে গেছে!"
আগেই বলে রাখি, খুঁতখুতে মানুষ হিসাবে ডিপার্টমেন্টে আমার একটা বদনাম অনেকদিন থেকেই আছে। তাছাড়া আমি স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় একটু অতিরিক্ত কৌতুহল প্রবণ। কোন কিছু নিজের মতের সাথে খাপ না খেলে যতক্ষণ পর্যন্ত তার কোন সমাধান বের না করতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন নিজের কাছে শান্তি পাই না। এজন্য অবশ্য ডিপার্টমেন্টের অনেকেই আমাকে ভিন্ন নজরে দেখে থাকে। অনেকে ভাল চোখে, আবার অনেকে খারাপ চোখে। তবে তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। কারণ আমি একদম আমার নিজের মত করেই চলতে চাই। আর সেজন্য অনেক কেসের নিষ্পত্তি হওয়া স্বত্তেও আমি নিজ উদ্দ্যোগে সেগুলোর তদন্ত করি। এটাকে অনেকটা আমার নিজের অ-পেশাগত শখও বলতে পারেন। আর এই রি-ওপেনকৃত কেসের মধ্যে মাঝে মাঝে এমন কিছু তথ্য খুঁজে পাই, যা উক্ত কেসের তদন্ত চলাকালিন সময়ে একটুও সামনে আসে না। এবং যার জন্য কেসটা আজন্মকাল ধরে একটা রহস্যের মধ্যে পড়ে থাকে। তবে সেই তদন্তে যদি দেখি মূল অপরাধী বাদে অন্য কোন নির্দোষ বা নিরাপরাধ ব্যক্তি সাঁজা পাচ্ছে, তখনই শুধু সেই কেসটা সম্পর্কে উর্দ্ধোতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করি। তাছাড়া কোন কেসে যদি দেখি অপরাধী স্বেচ্ছায় অপরাধ না করে বাধ্য হয়েছে অপরাধ করতে, তাহলে সেটা আর হায়ার অথরিটিকে না জানিয়ে মনে মনে চেপে রাখি।
ঠিক তেমনি ভাবে সদ্য সমাপ্ত এই কেসটার সব কিছু নিষ্পত্তি হয়ে গেলেও, আমার মনের কোণে ঊঁকি ঝুঁকি দিতে থাকা বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য, অনেকটা গোপনে আমি পুনরায় এই কেসের তদন্ত শুরু করি। কিন্তু অনেক খোঁজা খুঁজির পরেও এর কোন কূল কিনারা আমি করতে পারি না। কেসটা আসলেই উদ্দেশ্যহীন এবং এর কোন সমাধান আদৌ সম্ভব নয় দেখে যখন সেটাকে বাদ দিতে যাবো, ঠিক তখনই হঠাৎ করে কোর্টে দেওয়া শেষ স্বাক্ষী অখিল রায়ের কথা আমার মনে পড়ে গেল। আর একদিন গোধূলি বেলায় অনেকটা আনমনা ভাবে নিজের বাইকে চড়ে পথ চলতে চলতে প্রায় সিভিল পোশাকেই আমি অখিল রায়ের বাড়িতে গিয়ে হাজির হই।
বাড়িটা আগেই চেনা ছিল। কারণ তদন্তের স্বার্থে এর আগে বেশ কয়েকবার এই বাড়িতে আমাকে আসতে হয়েছে। অখিল রায় গ্রামের গন্যমান্য ব্যক্তি। তাছাড়া উনার বাড়ির ৬০ থেকে ৭০ গজ দূরেই আসামী নাহিদের বাড়ি। সেজন্য তদন্তের কাজে যতবার এই গ্রামে এসেছি প্রায় ততবারই অখিল রায়ের বাড়িতেই বসেছি। পাড়াটা বেশ নিরিবিলি। তাছাড়া জনসংখ্যাও অনেক কম। এখানে হিন্দু মুসলিম মিলিয়ে কয়েকঘর ভদ্র গৃহস্থের বাস। একতলা ছোট ছোট বাড়িগুলি সবই প্রায় একই ছাঁচের গড়া। অখিল রায়ের ছোট্ট বাগানটা পার হয়ে সোঁজা ওর বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলাম। বাড়িটাকে বেশ নির্জন বলে মনে হলো। গেটে দাঁড়িয়ে হর্ণ বাজাতেই স্বয়ং অখিল রায় নিজে এসে গেট খুলে দিলেন। তারপর কিছুটা বিস্মিত ভাবে জিজ্ঞাসা করলেনঃ
-কাকে চাই?
বুঝলাম তিনি আমাকে চিনতে পারেন নি। কারণ এর আগে যতবার এসেছি ততবারই ইউনিফর্ম পরা অবস্থাতে ছিলাম। আর আজ এসেছি সম্পূর্ণ সিভিল পোশাকে। সম্ভাবত সেই কারণেই আমাকে চিন্তে উনার কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া বয়ষ্ক লোক। সুতরাং দৃষ্টি বিভ্রমও হতে পারে! তবে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমিও আর নিজের সত্যিকারের পরিচয়টা দিলাম না। তার বদলে নিজেকে অনেকটা স্বাভাবিক রেখেই বললামঃ
-জ্বি, আমার নাম সম্রাট! "সত্যের সন্ধান" নামক একটা দৈনিক পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক। আপনার কাছে এসেছিলাম একটা দরকারে। ঐ মামুলী দু'চারটে কথা বলেই তারপর চলে যাবো।
আমার কথা শুনে অখিল রায় গেটটা একটু ফাঁক করে ধরে বললেন- 'ভিতরে আসুন!'
আমি বাইক নিয়ে অখিল রায়ের বাড়ির ভিতরে গিয়ে ঢুকলাম। তিনি বারান্দায় একটা চেয়ার দেখিয়ে সেখানে আমাকে বসতে বলে নিজে পাসে পেতে রাখা চৌকিটার উপর গিয়ে বসলেন। অখিল রায়ের বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। দোহাড়া বলিষ্ট গোছের চেহারা। মাথার চুল ও গোঁফ ছোট করে ছাঁটা। খাটো ধুতির উপরে ময়লা সোয়েটার পরে তিনি বসে আছেন। মোট কথা যে বয়সে মানুষ নিজের দৈহিক পারিপাট্য সম্পর্কে উদাসিন হয়ে পড়ে, এটা সেই বয়স। আমাকে বসতে বলে তিনি পাশে রাখা একটা মরিচাধরা ইয়ারগান হাতে তুলে নিয়ে সেটার জং পরিষ্কার করতে করতে অনেকটা কৌতুহলি ভাবে ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ-
-সব তো চুকে বুকে গেছে, আবার কেন?
অখিল রায়কে এর আগে আমি বাড়িতে সহ স্বাক্ষীর কাঠগড়ায় অনেকবার দেখেছি। তার বাইরের আচার ব্যবহার এবং প্রকৃতি সম্বন্ধে আমার মনে বেশ স্পষ্ট ধারনা আছে, কিন্তু তার চরিত্র চিত্র আঁকা সহজ নয়। লোকটি ভদ্র শ্রেণীর, জাতিতে কায়স্ত। অভাব গ্রস্থ নন, বেশ সচ্ছল অবস্থার মানুষ। আবার অশিক্ষিতও নন, সম্ভবত বি.এ পাশ। তবুও তার কথায় বা আচার ব্যবহারে কোথায় যেন একটু খটকা লাগে। তাকে পাড়ার চন্ডি মন্ডপের আসরে ততটা বেমানান লাগবে না, কিন্তু কোন মার্জিত সমাজের ড্রয়িং রুমে ছেড়ে দিলে ঐ হাঁসের মধ্যে বকের মত মনে হবে, সে ব্যাপারে কোন স্বন্দেহ নেই। তার প্রশ্নটা শুনে আমি একটু ঢোক গিলে বললামঃ-
-না, আমি সাংবাদিক হিসাবে আপনার কাছে আসিনি। নিতান্তই ব্যক্তিগত কৌতুহল আর কি। আপনার মত চরিত্রবল মানুষ আজকালকার দিনে তো দেখাই যায় না! কিন্তু একটা দুঃশ্চরিত্র লম্পটের প্রাণ বাঁচানোর জন্য আপনি.........
তোষামদিতে কাজ হলো না। তিনি অত্যন্ত দৃঢ় ভাবে আমাকে বাঁধা দিয়ে বললেন- 'ওসব কথা ছাড়ুন। কি জানতে চান বলুন?'
আমি ছোট্ট করে প্রশ্ন করলাম- 'আপনার স্ত্রী?'
-সে পালিয়েছে!
অখিল বাবু ইয়ারগানের ঘাড় ভেঙে সেখানে জেট পাউডারের পানি ঢেলে ব্রাশ দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে লাগলেন। আমি একটু অবাক হলে বললাম- 'সেকি! কোথায় (?) কার সঙ্গে?'
-জানি না! খোঁজও করিনি।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে তার ইয়ারগান পরিষ্কার করা দেখলাম। তিনি প্রথমে ন্যাকড়ায় করে একটু একটু জেট পাউডার মিশ্রিত পানি ইয়ারগানের উপরে ঢালছেন, তারপর একটা ভোঁতা ব্রাশ দিয়ে সেটার আগামাথা সব কিছু ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছেন। পাশেই আর একটা বোতলে দেখলাম কিছু স্প্রিট অয়েল রাখা আছে। জেট দিয়ে পরিষ্কার করা হয়ে গেলে এবার তিনি সেই বোতল থেকে ড্রপে করে কিছু স্প্রিট নিয়ে ইয়ারগানের বিশেষ বিশেষ জায়গায় লাগাতে লাগলেন। তারপর ঘাড় ভাঙা ইয়ারগানটা হাতে তুলে নিয়ে বেশ কয়েকবার ঘাড় উঠা নামা করিয়ে স্প্রিট অয়েলকে ভাল ভাবে লাগিয়ে দিলেন। আমি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে বসে এইসব দেখতে দেখতে আবারও প্রশ্ন করলামঃ
-আপনি পাখি মারতে ভাল বাসেন, না?
অখিল রায় ইয়ারগানের উপর থেকে চোখ না তুলেই জবাব দিলেন- 'হ্যাঁ।'
-রাতে পাখি মারেন কেন?
-মজা আছে! দিনে পাখি মারার চেয়ে ঢের বেশি মজা। গভীর বাগানের মধ্যে বড় বড় গাছের মাথায় বক, সারস বসে থাকে। চার্জার লাইটের তিক্ষ্ণ আলো তাদের চোখে ফেললে তারা আর উড়তে পারে না।
-আজ পাখি মারতে যাবেন নাকি?
-দেখি, যদি সময় পাই তাহলে হয়তো যেতে পারি।
-আপনার বাড়িতে এখন কে কে আছে?
-কেউ নেই, আমি একা! নিজে রেঁধে খাচ্ছি।
আমি আবারও কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলাম। অখিল রায় কাঁধের ময়লা তোয়ালেটা দিয়ে ইয়ারগানের উপরে লেগে থাকা পানি এবং ময়লা পরিষ্কার করতে লাগলেন। আমি আর কোন রকম ভনিতা না করে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলামঃ
-আচ্ছা নাহিদ তার স্ত্রীকে খুন করেনি সেটা যেমন প্রমাণ হলো। কিন্তু কে খুন করেছিল, তা তো জানা গেল না?
অখিল রায় আমার দিকে একটু অবজ্ঞা সূচক দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে বললেনঃ
-আপনি তো আইনের কিচ্ছু জানেন না দেখছি? কে খুন করেছে এ মামলায় তাতো জানবার দরকার নেই। নাহিদ খুন করেনি এটা প্রমাণ হলেই তো যথেষ্ট?
-না তবু, কে খুন করেছে জানা দরকার তো?
-সে ভাবনা পুলিশের!
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম- 'তা বটে, ত......বু......!!'
অখিল রায়ের ইয়ারগান পরিষ্কার করা শেষ। তিনি ইয়ারগানের ঘাড় লাগিয়ে পাশে পড়ে থাকা গুলি ভর্তি কার্তূজ এবং শিশি বোতল গুলো তুলে রাখতে রাখতে একটু অন্য মনষ্ক ভাবে প্রশ্ন করলেনঃ
-আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?
সত্যি কথা বললাম- 'যশোর!'
তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর অনেকটা ধরা গলায় বললেন- 'ভিতরে আসুন!'
অখিল রায় আমাকে বাড়ির ভিতরে বসবার ঘরে নিয়ে গেলেন। অখিল রায়ের মনের মধ্যে অনেক কথা জমা ছিল। সে রাতে আমরা দু'জনে মুখোমুখি বসে প্রায় দুই প্যাকেট সিগারেট সাবাড় করে ফেলেছিলাম। সেই সঙ্গে তার মুখে যে বৃত্তান্ত শুনেছিলাম, তার সাথে আদালতে দেওয়া এজেহার মিলিয়ে একটা গোটা কাহিনী খাড়া করা যেতে পারে। তার পলাতকা স্ত্রী মৃণালিনীর একটা ফটোও দেখেছিলাম। এমন কিছু আহামরি চেহারা তার নেই। বয়স আন্দাজ কুড়ি-বাইশ। তবে শরীরের বাঁধুনি আছে এবং চোখে আছে কপট ভাল মানুষী। তাছাড়া শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজে ভাঁজে যেন যৌবন ঠিকরে পড়ছে।
অখিল রায় এই জেলারই লোক। ছেলে বেলা থেকেই তিনি এই গ্রামেই মানুষ। বেশ কয়েক বছর শহরে থেকে লেখা পড়া শেষ করে তারপর আবার গ্রামে ফিরে আসেন। তিনি পেশায় একজন হাতুড়ে ডাক্তার। তাছাড়া গ্রামের থেকে চার পাঁচ কিলোমিটার দূরে শহরের মাথায় তার একটা ডিস্পেন্সারিও আছে। ডাক্তারি পেশায় যদিও তার পশার বেশি নেই। তবে হাতে কিছু নগদ টাকা আছে, তাছাড়া ডিস্পেন্সারি ছাড়াও লগ্নি কারবারে উপার্জন মন্দ হয় না। মোটের উপর বেশ সচ্ছল অবস্থা। গ্রামের সকলের সঙ্গে পরিচয় আছে, কিন্তু বেশি ঘনিষ্টতা কারো সঙ্গে নেই। অখিল রায়ের প্রথম পক্ষের স্ত্রী রুগ্ন ছিলেন। বিবাহিত জীবনের প্রায় পনেরটা বছর একটানা সয্যাগত থেকে নিঃসন্তান অবস্থায় পটল তোলেন। অখিল রায়ের বয়স তখন প্রায় পঁয়তাল্লিশ ছুই ছুই করছে। আবার বিয়ে করবার জন্য তিনি বিশেষ উৎসুখ ছিলেন না। কিন্তু অখিল রায়ের এক দূরসম্পর্কের খুড়তুত বোন ছিল। তার বিয়ে হয়েছিল অন্য জেলায়। অখিল রায় বিপত্নিক হয়েছেন শুনে, সে এসে দাদাকে ধরে বসলো। তার স্বামীর এক দূরসম্পর্কের বোন আছে। মেয়েটি অনাথা। বেশ রুপবতি এবং গুণবতি কন্যা, নেহাৎ অনাথা বলে দূরসম্পর্কের ভাইয়ের গলায় পড়েছে। অখিল রায় প্রথম দিকে একটু না না করলেও বোনের চাপের কারণে, এবং তার দাম্পত্য সুখের জন্য শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজি হলেন।
মৃণালিনী সাধারণ বিচারে দেখতে শুনতে ভালই। রুপ যত না থাক, চটক আছে বেশ। তবে তার গুণের পরিচয় ক্রমে প্রকাশ পেল। সংসারের কাজ জানলেও সেদিকে খুব একটা উৎসাহ তার নেই। ভাল মানুষের মত ঘরে থাকে বটে, কিন্তু মন বাইরের দিকে। ঘরের কাজ ফেলে বিছানায় শুয়ে রোমাঞ্চকর উপন্যাস পড়তে ভালবাসে, সাঁজ গোজের দিকে নজর বেশি, সিনেমা দেখার দিকে প্রবল ঝোঁক। প্রথমে অখিল রায় কিছু বুঝতে পারেন নি। ক্রমে নব পরিচয়ের ঘোলা জল পরিষ্কার হতে লাগলো। কিন্তু নতুন বৌয়ের যে ধরনের দোষ গুলি তিনি দেখতে পেলেন, সেগুলি তার কাছে খুব একটা মারাত্মক মনে হলো না। মৃণালিনী সাধারণ মেয়ে। এই রকম সাধারণ মেয়ের সাধারণ দোষ গুণ নিয়ে পৃথিবী সুদ্ধু লোক সংসার করছে, সুতরাং তিনি বিশেষ কৌতুহলি হলেন না।
এভাবে প্রায় বছর খানিক কেটে গেল। ক্রমে ক্রমে তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে, মৃণালিনী সাধারণ মেয়ে নয়। সে অত্যন্ত স্বার্থপর, অন্যের সুখ সুবিধা সামর্থ্যের কথা সে ভাবে না। তার একটা প্রচ্ছন্ন জীবন আছে। তার অতীত জীবনে কোন গুপ্ত রহস্য আছে। সে অত্যন্ত সরল এবং নির্বিবোধ মুখ নিয়ে অনর্গল মিথ্যা কথা বলে যেতে পারে। সে লুকিয়ে লুকিয়ে কারো সাথে ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে। কিন্তু একদিন খুবই সামান্য একটা ঘটনা ঘটলো-
"অখিল রায় ডিস্পেন্সারি থেকে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য বাড়িতে ফিরে দেখেন মৃণালিনী ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। তিনি একটু গলা খাকরানি দিলে মৃণালিনী ফোন রেখে দ্রুত তার সামনে চলে আসে। তিনি ভাত দেওয়ার কথা বলে মৃণালিনীকে জিজ্ঞাসা করেনঃ
-দুপুর বেলা ঘুমাওনি দেখছি। তা কার সাথে কথা বলছিলে?
সরল বিস্ময়ে চক্ষু বিষ্ফারিত করে মৃণালিনী বললোঃ
-কথা বলছিলাম! (?) আমি? কই না তো!"
অখিল রায়ের মনে একটু ধোকা লাগলো। তবে কি তিনিই ভুল শুনলেন? তিনি আর কিছু বললেন না। দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ডিস্পেন্সারিতে ফিরে গেলেন। কিন্তু অনিশ্চয়তার স্বংশয়ে তার মন প্রশ্নে ভরে উঠলো। তার দু'তিন দিন বাদে অখিল রায়ের সেই দূরসম্পর্কের বোনের স্বামী এসে উপস্থিত হলেন। যার বাড়িতে মৃণালিনী থাকতো ইনি তিনি। বয়সে অখিল রায়ের থেকে কিছুটা ছোট। শক্ত স্বামর্থ্য চেহারা। চোখে শিকারী বেড়ালের স্বতর্কতা। বললেনঃ
-কাজে এসেছিলাম। ভাবলাম একটু দেখা করে যাই!
তিনি অখিল রায়ের বাড়িতেই রইলেন। অখিল রায় তাকে যথেষ্ট আদর যত্ন করলেন। প্রায় দু'দিন অখিল রায়ের বাড়িতে থেকে অতিথী বিদায় নিলেন। কিন্তু তিনি কি কাজে এসেছিলেন অখিল রায় তা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না। কারণ এখানে এসে তিনি একবারের জন্যেও বাইরে গেলেন না। অখিল রায় অবশ্য প্রতিদিনের মতই সকালে ডিস্পেন্সারিতে গিয়েছিলেন আবার সন্ধ্যার দিকে ফিরে এসেছিলেন। এর পর থেকে তিনি মাঝে মাঝে আসেন, দু'একদিন থেকে আবার চলে যান। অখিল রায় স্বন্দিগ্ধ প্রকৃতির লোক নন, কিন্তু তার মনেও খটকা লাগে!
'লোকটি সম্পর্কে মৃণালিনীর ভাই, অথচ তাদের সম্পর্কটা যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়। অখিল রায়ের সামনে তারা সব সময় এমন সংকুচিত হয়ে থাকে কেন? কোথায় যেন কিছু গলদ আছে!'
এভাবে প্রায় আরো বছর খনিক কেটে গেল। অখিল রায় দিনের বেলা ডিস্পেন্সারিতে বসেন, সন্ধ্যার পর ইচ্ছা হলে পাখি স্বীকারে যান, আবার ইচ্ছা না হলে যান না। এ অভ্যাস তার বেশ পুরানো। এছাড়াও ওষুধের প্যাটেন্ট আনার জন্য তাকে মাঝে মাঝে শহরে যেতে হয়। এবং দু'একরাত হয়তো শহরেই কাটাতে হয়। তখন মৃণালিনী বাড়িতে একা থাকে। একলা থাকতে মৃণালিনীর একটুও ভয় করে না!
অখিল রায়ের বাড়িতে অবশ্য বেশি লোকের আসা যাওয়া নেই। যারা আসে কাজের দ্বায়ে আসে। কাজ শেষ হলে আবার চলে যায়। কখনো কখনো দু'একজন রুগি আবার কখনো কখনো দু'একজন আসে টাকা ধার নিতে অথবা ধার নেওয়া টাকা ফিরিয়ে দিতে। পরশীদের সাথে অখিল রায়ের খুব একটা যোগাযোগ নেই, কেবল নাহিদ সরদারের সাথে একটু ব্যবহারিক ঘনিষ্টতা আছে।
নাহিদ সরদার, ফুর্তিবাজ ছোকড়া। সুদর্শন চেহারা, মিষ্টি ব্যবহার, কিন্তু প্রচন্ড জুয়াড়ি। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাঝে মাঝে মাদক দ্রব্যও সেবন করে, কিন্তু নেশাখোর নয়। প্রকাশ্যে তার কোন চরিত্র দোষ ছিল না, কারণ ঘরে ছিল দজ্জাল স্ত্রী। এই নাহিদ সরদার মাঝে মধ্যে আসতো অখিল রায়ের কাছে টাকা ধার নিতে। তার বাবা তার জন্য যথেষ্ট সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু জুয়াড়িদের কি আর সেই হিসাব থাকে? সুতরাং মাঝে মাঝে তার টাকার টান পড়তো এবং তখন নাহিদ, অখিল রায়ের কাছে অনেক সময় তার ব্যবহৃত যে কোন জিনিস বন্ধক রেখে কিংবা মাঝে মাঝে শুধু হাতে টাকা ধার নিয়ে যেত। আবার হাতে টাকা এলে ঋণ শোধ করে দিয়ে যেত। অখিল রায় মনে মনে নাহিদ কে পছন্দ করতেন। কারণ সে জুয়াড়ি হলেও মহাজনের টাকা মেরে খাওয়ার মত মানুষ সে নয়।
একবার অখিল রায় ওষুধের প্যাটেন্ট আনতে দু'তিন দিনের জন্য শহরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে এসে মৃণালিনীকে দেখে তার মস্তিষ্কে সন্দেহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। মৃণালিনী ভাল মেয়ে নয়। সে নষ্টা মেয়ে। তার কোন গুপ্ত নাগর আছে। আর তার সঙ্গে সে গোপনে ব্যাভিচার করে। সন্দেহ জিনিসটা যে সকল প্রমাণের উপরে নির্ভর করে চলে, সে প্রমাণ কাউকে দেখানোও যায় না, এমনকি নিজের কাছেও খুব একটা স্পষ্ট নয়। তবুও এজাতীয় সন্দেহের হাত ছাড়ানো খুবই কঠিন। অখিল রায় মাথার মধ্যে তুষের আগুন জ্বেলে ভাবতে লাগলেন-
"মৃণালিনী বিয়ের আগে থেকেই দুঃশ্চরিত্রা। তাই অখিল রায়ের বোন তাকে তাড়াবার ব্যবস্থা করেছিল। হয়তো ভগ্নিপতির সাথে নট ঘট আছে, ঐ জন্যই লোকটা তার বাড়িতে এত ঘন ঘন আসতো। তারা সম্পর্কে ভাই বোন, কিন্তু যারা নষ্ট দুঃশ্চরিত্র তাদের কি সম্পর্কের জ্ঞান থাকে? আর সে জন্যই তারা যখনই অখিল রায়ের সামনে আসতো, তখনই ঘটি চোরের মত ব্যবহার করতো। শুধু তাই নয়, এখানেও মৃণালিনীর গুপ্ত প্রণয়িনী আছে। আর অখিল রায়ের অনুপস্থিতিতে তার সাথেই সে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যাভিচার করে!
-কে সে? বাড়িতে তো সে রকম কেউ আসে না? তার অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীর কাছে কার যাতায়াত আছে? সে কে হতে পারে.......??"
((পর্ব নং-০২))
অখিল রায় স্থির করলেন কেবল সন্দেহের আগুনে জ্বলে পুড়ে মরলে চলবে না। ধরতে হবে! হাতে নাতে ধরে তারপর নষ্টা স্ত্রী লোকটিকে দূর করে দেবেন। কেলেঙ্কারি হয়তো হবে, গ্রামে কয়েকদিন কান পাতা যাবে না, কিন্তু তা স্বত্তেও এটা করতে হবে। কারণ দুষ্টু গরুর থেকে শূণ্য গোয়াল অনেক ভাল।
একদিন দুপুরে তিনি ডিস্পেন্সারি থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খেতে খেতে মৃণালিনীকে লক্ষ করে বললেনঃ
-আজ রাত্রে পাখি মারতে যাবো। সব কিছু গোচ-গাছ করে রেখো?
কথাটা শোনার সাথে সাথে মৃণালিনীর চোখে মুখে ঝিলিক খেলে গেল! তার বাইরের ব্যবহার দেখে মনের কথা অনুমান করা যায় না। সে তক্ষুনি চোখের পাতা নামিয়ে বললঃ
-ও, তাহলে তোমার রাত্রের খাবার তৈরি করি? ফিরতে কি রাত হবে?
অখিল রায় বললেন- 'হু, ঐ যেমন হয়! একটা-দেড়টা।'
অখিল রায় রাত সাড়ে আটটার সময় বাড়ি থেকে বের হলেন। একটি হাই পাওয়ারের চার্জার লাইট, একটা চটের ব্যাগ, গুলি ভর্তি কার্তূজ, ইয়ারগান এবং সেই সঙ্গে দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা একটা লোহার রড নিয়ে তিনি রওয়ানা হলেন। এর আগে অবশ্য কখনই তিনি লোহার রড সঙ্গে নেন নি, কিন্তু আজ নিলেন! নির্জন জায়গায় একা একা রাত কাটানো, এ বাগান থেকে সে বাগানে ঘুরে বেড়ানো, সুতরাং হাতে একটা আত্মরক্ষার অস্ত্র থাকা ভাল। যদিও ইয়ারগান থাকতে লোহার রডের কোন দরকারই পড়ে না। তারপরেও আজ কি মনে করে তিনি লোহার রডটিকে সঙ্গে নিয়ে নিলেন। একহাতে ইয়ারগান এবং অন্যহাতে থলি আর সেই লোহার রডটা নিয়ে অখিল রায় বেরিয়ে গেলেন। তিনি গেটের দরজা পার না হওয়া পর্যন্ত মৃণালিনী ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর গেট পার হয়ে কিছুদূর চলে যেতেই, পিছন দিকে স্ব-শব্দে গেটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
একমাত্র মৃণালিনী ছাড়া বাড়িতে এখন আর কেউ নেই। পাচুর মা দিনের বেলা কাজ করে দিয়ে চলে গেছে। আবার কাল সকালে এসে আজকের রাতের এঁটো বাসন মাজবে। অখিল রায়ের বাড়ির সামনের রাস্তাটির দু'টি মুখ। একটা ডানে শহরের দিকে চলে গেছে, এবং আর একটা বামে গ্রামের ভিতরে চলে গেছে। অখিল রায় বামের পথটা ধরলেন। তিনি কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরে হঠাৎ সামনে নাহিদ সরদার কে দেখতে পেলেন। নাহিদ অখিল রায়কে দেখে একটু হাসি হাসি মুখ করে বললঃ
-এই যে রায় মশায়, পাখি মারতে চললেন বুঝি?
অখিল রায় ছোট করে উত্তর দিলেন- 'হ্যা!'
-তা বেশ আছেন! সকালে ডিস্পেন্সারি, রাতে পাখি শিকার। আনন্দেই আছেন বলতে হবে, কি বলেন?
অখিল রায় একটু হেসে বললেন- 'কি করবো বলো? বুড়ো শরীর, ভারি কোন কাজই তো করতে পারি না। বলতে পারো সেজন্যই এই রাতের বেলা একটু হাঁটা হাঁটি আর কি।'
-তা বেশ বেশ! আমি অবশ্য ভাবছিলাম আজ একবার আপনার সাথে একটু দেখা করবো! জরুরি দরকার ছিল। তবে পথে দেখা হয়ে বেশ ভালই হলো।
অখিল রায় অবাক হয়ে বললেন- 'কেন বলতো?'
-আর বলবেন না, কিছু টাকার দরকার ছিল। ভাবছিলাম আপনার কাছ থেকে ধার নিয়ে আসি, তারপর আবার হাতে টাকা এলে ফিরত দিয়ে দেওয়া যাবে।
-ও, কিন্তু এখন তো হবে না। আমি যে বেরিয়ে পড়েছি। তুমি বরং কাল সকালে একবার এসো!
-হ্যা, তাই যাবো ভাবছি। তা ঠিক আছে আপনি যান তাইলে। দেখেন পাখি টাখি পান কিনা!
বলে নাহিদ হাসতে হাসতে চলে গেল। নিজের বাড়িতে ফিরলো না সে। চলে গেল শহরের দিকে। অখিল রায় নাহিদের বাড়িটা পার হওয়ার সময় বাড়ির ভিতর থেকে একটা কাশা কণ্ঠের তিক্ষ্ণ নারী কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলেন। মহিলাটি একমনে গজগজ করতে করতে বলছেঃ
-বাড়িতে মন বসে না, না? দিন রাত শুধু জুয়া আর জুয়া। আটকুইড়া মিনশে। বাপ যা রেখে গেছে সব গোল্লায় দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। আজ জুয়ার আড্ডা থেকে বাড়িতে ফিরলে ঘরে জাগা হবে না, এই বলে দিলাম হু!
অখিল রায় চলতে চলতে ভাবতে লাগলেন- 'নাহিদের বউ সুন্দরী এবং যুবতী। কিন্তু কি গলার স্বর? কি মেজাজ? দুনিয়াতে বিয়ে করে কেউ সুখী হয়েছে কি? এক বলতে তিনি নিজে দু'বার বিয়ে করেছেন। প্রথমটা চির রুগ্না, আর দ্বিতীয়টা ভ্রষ্টা। আচ্ছা মানুষ বিয়ে করে কেন?
রাস্তাটা আরো আধমাইল গিয়ে চৌধুরিদের বাগানের মাথায় এসে মিশেছে। এই বাগানটা এলাকার সব থেকে বড় বাগান। এবং হাজার হাজার বক, সারস, পানকৌড়ি পাখি রাতে বিশ্রামের জন্য এই বাগানে এসে আশ্রয় নেয়। অখিল রায় বাগানের কাছে পৌঁছে একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালেন। রাত্রে এ রাস্তায় জন মানুষের চলাচল খুব একটা নেই বললেই চলে। তুব অখিল রায় একটা বড় গাছের পিছন দিকে গিয়ে, ইয়ারগানটি গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রাখলেন। তারপর হাতের থলেটি মাটিতে রেখে নিজে একটি উঁচু শিকড়ের উপরে বসে পড়লেন। এখানে বসে থাকলে তাকে কেউ দেখতে পাবে না। রাস্তাদিয়ে মোটর গাড়ি গেলেও তার হেড লাইটের আলো এতদূর অবধি পৌঁছবে বলে মনে হয় না। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে অখিল রায় একটাতে অগ্নি সংযোগ করলেন। সিগারেট ধরানোর সময় তিনি দেশলাইয়ের আলোতে হাত ঘড়িটাও একবার দেখে নিলেন। রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে। আজ সিগারেট বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। তিনি আর একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর সেটা শেষ হয়ে গেলে আর একটা!
এভাবে রাত যখন দশটা বাজলো তখন অখিল রায় পায়ের জুতো খুলে ফেললেন। তারপর জুতো জোড়া গাছের গায়ে তুলে রাখলেন। শিয়াল কুকুরে যাতে জুতো জোড়া মুখে করে নিয়ে যেতে না পারে। গাছের গায়ে হেলান দেওয়া ইয়ারগানটার বেল্টের সাথে দড়ি দিয়ে তিনি গাছের একটা ডাল বেঁধে দিলেন। তারপর থলের পাশ থেকে লোহার রডটা হাতে উঠিয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
অখিল রায় লোহার ডান্ডাটি শক্ত হাতে ধরে প্রায় নিঃশব্দে শিকারী বিড়ালের মত ফিরে চললেন। রাস্তায় জন মানব নেই। নিজের পাড়ায় যখন ফিরলেন তখন পাড়া প্রায় নিশুতি। সব বাড়িতে আলো নিভে গেছে। কেবল নাহিদের বাড়ির একটা ঘরে আলো জ্বলছে। অখিল রায় জানালা দিয়ে দেখলেন, নাহিদের বৌ সেই আলোতে কাপড় সেলাই করা মেশিনে বসে কি যেন সেলাই করছে। অখিল রায় তার নিজ বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন।
তার নিজের বাড়িও অন্ধকার। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। তিনি চোরের মত খিড়কি দ্বার দিয়ে নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলেন। অখিল রায়ের ঘরে প্রবেশ করার দুইটি দরজা। একটি সামনে আর একটি পিছনে। অখিল রায় দেখলেন যে দুইটি দরজাই বন্ধ। তিনি তখন শোয়ার ঘরের জানলার সামনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়ালেন। জানালার একটি কপাট অল্প খোলা রয়েছে। সেই খোলা অংশটা দিয়ে একটা সূক্ষ্ম নীল আলোর রেখা, জানালার পর্দা ভেদ করে বাইরে এসে পড়ছে। অর্থাৎ ঘরের মধ্যে ডিম লাইট জ্বলছে। অখিল রায় জানলার কপাটের গায়ে কান পেতে থেকে কিছু শোনার চেষ্টা করলেন।
ভিতর থেকে গরম নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। গভীর অথচ ভারি নিঃশ্বাস। একজনের নয়, দু'জনের! ঘরের ভিতরে যেন দুইজন মানুষ ফিস ফিস করে কথা বলছে। স্পষ্ট নয়, খুবই আস্তে আস্তে এবং নরম কণ্ঠে। একজন পুরুষ আর একজন মহিলা। কণ্ঠস্বর দুইটা, কিন্তু সুরটা যেন একই সুঁতোই বাধা। হঠাৎ করে জোরে অথচ চাপা কণ্ঠের একটা খিলখিল হাসির শব্দ হলো। কিছুক্ষণ পর জানলা ভেদ করে একটা নারী কণ্ঠের আওয়াজ তার কানে এসে আছড়ে পড়লো। কণ্ঠস্বরটি চাপা গলায় বলছেঃ
-যাহঃ, তুমি খুব দুষ্টু!
অখিল রায় এবার কণ্ঠস্বরটিকে স্পষ্ট চিনতে পারলেন! আর কেউ নয়, এটা তার স্ত্রী মৃণালিনী.......!!
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তিনি অপর কণ্ঠস্বরটিকে ঠিক ধরতে পারলেন না। একবার ভাবলেন জানালার কপাট সরিয়ে ভিতরে নজর দিয়ে দেখি পুরুষ লোকটি কে? কিন্তু পরক্ষণে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সেটা আর করলেন না। তাছাড়া তার নিজের বিবেক কিছুতেই সায় দিল না যে, এই ঘৃণ্য নষ্টামী কার্জকলাপটা সে দেখুক। অখিল রায় আরো কিছুক্ষণ জানলার পাশে কান পেতে থেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ শুধু ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া তিনি আর কিছুই শুনতে পেলেন না। এভাবে প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর ভিতর থেকে এবার খুবই স্পষ্ট একটা পুরুষ কণ্ঠের গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসলো। আর সাথে সাথে অখিল রায় অপর কণ্ঠস্বরটিকেও চিনতে পারলেনঃ
- আরে, এ যে নাহিদ......! ছিঃ ছিঃ এত বড় বিশ্বাস ঘাতক!
((পর্ব নং- ০৩))
পরদিন সকাল বেলা গ্রামে হুলুস্থুল কান্ড। নাহিদ সরদার নিজের স্ত্রীকে খুন করে ফেরারি হয়েছে। বাড়িতে পুলিশ এসেছে। নাহিদের বাড়ির বাম পাশে বিভূতীভূষণ বাডুয্যের বাড়ি, এবং ডান পাশে থাকেন করিম জমাদ্দার। দু'জনেই পৌড়ো ব্যক্তি। তারা এসে পুলিশের কাছে স্বাক্ষী দিলেন। নাহিদ এবং কমলার ঝগড়া রোজকার ব্যাপার। গতকাল রাত আন্দাজ এগারটার সময় তারা নাহিদের বাড়ি থেকে কমলার চিৎকার এবং গালিগালাজ শুনতে পান। নাহিদ কোনদিনই চেঁচিয়ে ঝগড়া করতো না। গতকালও তার কণ্ঠস্বর শোন যায় নি। হঠাৎ কমলা মেরে ফেললো, মেরে ফেললো বলে দু'তিনবার চিৎকার করে তারপর চুপ করলো। ব্যাপার এতটা চরমে আগে কখনো ওঠেনি। কিন্তু দাম্পত্য কলহের মধ্যে বাইরের লোকের হস্তক্ষেপ করতে যাওয়াটা মূর্খতা। তাই বিভূতী বাবু এবং করিম জমাদ্দার অত রাতে আর বাড়ির বাইরে বের হননি। বিশেষত যখন কমলা হঠাৎ চুপ করে গেল তখন তারা ভেবেছিলেন, হয়তো নাহিদ পিটিয়ে বৌকে স্বায়েস্তা করে ফেলেছে। কিন্তু সে যে বৌ কে খুন করতে পারে, এ সম্ভাবনা তাদের মাথায় আসেনি। সারা রাত মৃতদেহ খোলা বাড়িতে পড়ে ছিল। সকাল বেলা ঝি এসেই খুনের ঘটনা আবিষ্কার। ঝিয়ের চিৎকারে বিভূতী বাবু এবং করিম জমাদ্দার এ বাড়িতে এসেছেন এবং মৃতদেহ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন!
অখিল রায় নাহিদের বাড়িতে গেলেন। পাড়ায় এমন একটা কান্ড হয়ে গেল, সকলেই গেছে, সুতরাং তিনি না গেলে খারাপ দেখায়। দারোগা অখিল রায়কে দেখে জিজ্ঞাসা করলেনঃ
-আপনি কিছু জানেন?
যদিও এজেহার দেওয়ার ইচ্ছা অখিল রায়ের ছিল না। কিন্তু পুলিশী জেরার মুখে পড়ে তিনি ইতস্তত করে বললেনঃ
-ঠিক কখন এই ব্যাপার ঘটেছে?
দারোগা বিভূতী বাবু এবং করিম জমাদ্দারকে দেখিয়ে বললেনঃ
-এদের কথা থেকে মনে হয় রাত আন্দাজ এগারটার সময় খুন হয়েছে। অন্য স্বাক্ষী নেই, বড়িতে ঝি-চাকর কেউ থাকতো না।
অখিল রায় বললেনঃ
-এগারটার কথা জানি না। আমি চৌধুরীদের বাগানে পাখি শিকারে গিয়েছিলাম। কিন্তু রাত আন্দাজ সাড়ে এগারটার সময় নাহিদের সঙ্গে আমার দেখাও হয়েছিল।
-তাই নাকি! কোথায় দেখা হয়েছিল?
অখিল রায় গতরাতে নাহিদের সাথে পথে দেখা হওয়ার বিবরণ দিলেন। সব কথা শুনে দারোগা কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকে বললেনঃ
-হু, খুনের আর একটা জোরালো মোটিভ পাওয়া যাচ্ছে। মৃত মহিলার গলায় দশ বার ভরি ওজনের একটা স্বর্ণের চেইন ছিল। খুনি সেটা নিয়ে গেছে। নাহিদ সরদার আপনার কাছে টাকা ধার নিতে যাচ্ছিল, কিন্তু আপনার কাছে ধার না পেয়ে খালি হাতেই জুয়ার আড্ডায় গিয়েছিল। সেখানে বোধ হয় সুবিধা করতে পারেনি, তাই বৌয়ের গলার হার নিতে এসেছিল। কিন্তু বৌ সেটা দিতে অস্বিকার করায়, তাকে খুন করেই তারপর হার নিয়ে চম্পট দেয়।
দারোগা স্থানীয় অনেকের কাছেই খুন সম্পর্কিত বিষয়ে নানা রকম প্রশ্ন করলেন। কিন্তু নতুন কোন তথ্য পাওয়া গেল না। নাহিদ জুয়াড়ী ছিল। দলে পড়ে মাঝে মাঝে মাদক দ্রবও সেবন করতো কিন্তু মোটের উপর মানুষ হিসাবে মন্দ ছিল না। কমলার একদমই সহ্যগুণ ছিল না। সমান্য কারণে ঝগড়া বাধিয়ে পাড়া মাথায় করতো। এই ধরনের মামুলি তথ্য গুলিই সকলের কাছে প্রকাশ পেল। তদন্ত শেষ করে দারোগা লাশ নিয়ে চলে গেলেন। পলাতক নাহিদের বিরুদ্ধে পুলিশের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো।
গতরাতে প্রায় একটার দিকে অখিল রায় পাখি শিকার করে বাড়ি ফিরেছিলেন। মৃণালিনী ঘুম ঘুম চোখে এসে দরজা খুলে দিয়েছিল। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে একটা বড় রকমের হাই তুলে জিজ্ঞাসাও করেছিলঃ
-পাখি মারতে পারলে?
অখিল রায় সংক্ষেপে বলেছিলেন- 'না!'
আর কোন কথা হয়নি। মৃণালিনী গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। অখিল রায় হাত মুখ ধুয়ে তার পাশে এসে শুয়ে পড়েন। মৃণালিনী কয়েকবার আড়মোড়া ভেঙে তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিল। অখিল রায় সারা রাত জেগেছিলেন!
সকাল বেলা দুজনের মধ্যে লুকোচুরি খেলা আরম্ভ হলো। বাড়ির বাইরে খুনের খবর শুনে অখিল রায় বাড়ির ভিতরে এসে মৃণালিনীকে বললেনঃ
-কাল রাত্রে নাহিদ সরদার তার বৌকে খুন করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে।
মৃণালিনী চা তৈরি করছিল। তার মুখ খানা হঠাৎ শুকিয়ে শির্ণ হয়ে গেল। সে চমকে গিয়ে ভয়ার্ত্ব চোখ তুলে, আবার তা নামিয়ে ফেলল। অখিল রায় বললেনঃ
-নাহিদ কে তুমি দেখেছো নিশ্চই? ঐ যে আমার কাছে টাকা ধার নিতে আসতো?
মৃণালিনী চোখ তুললো না। জাড়িয়ে পেঁচিয়ে বলল- 'কি জানি! আমার মনে পড়ছে না!'
অখিল রায়ের ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু সেটাকে আর বাইরে প্রকাশ না করে তিনি চা খেয়ে ঘটনা স্থলে গেলেন। সেখান থেকে ফিরতে প্রায় বেলা দুপুর হলো। বাড়ি এসে তিনি মৃণালিনীকে বললেনঃ
-কাল রাত এগারটার সময় নাহিদ তার বৌকে খুন করেছে।
মৃণালিনীর চোখে ঝিলিক খেলে গেল। সে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বললঃ
-তাই নাকি!
কথাটা অখিল রায়ের কাছে অত্যন্ত নিরশ এবং অর্থহীন শোনালো।
((পর্ব নং-০৪))
এভাবে প্রায় একমাস কেটে গেল। নাহিদের গ্রেফতারি পরোয়ানা শহরের বাইরেও জারি হয়ে গেছে, কিন্তু নাহিদ এখনো ধরা পড়েনি। এদিকে পুলিশের বড় কর্তারা থানাতে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু কোন ভাবেই থানা থেকে নাহিদকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয় না। এদিকে গ্রাম থেকে শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভীষণ রকমের ক্ষোভ জমা হতে থাকে। তারা স্টেপ পুলিশের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে আমাদের আলোচিত মিডিয়া গুলোতো আছেই। কোন সাধারণ ঘটনাকে অসাধারণ করে তোলবার পক্ষে যাদের জুড়ি মেলা ভার। সুতরাং উপর মহলের চাপ এবং সাধারণ মানুষের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে তখন এই মামলা সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এবং একমাসের মধ্যে নাহিদকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। সিআইডির তরফ থেকে তখন এই মামলার তদন্তের ভার পড়ে আমার উপর।
তদন্তের ভার নিয়ে প্রথমেই আমি দেশের প্রত্যেকটা থানায় ই-মেইলের মাধ্যমে নাহিদের ছবি পাঠিয়ে দিই। এবং যেখানেই ওকে পাওয়া যাবে, সেখান থেকে যেকোন ভাবে হোক ওকে গ্রেফতার করার অনুরোধ করি। তাছাড়া আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শনের জন্য সেইদিন রাতেই ঢাকা থেকে ট্রেনে করে গন্তব্যস্থানে রওনা দিই। ট্রেন তখন সবে মাত্র খুলনা গোল্লামারি রেল স্টেশনে এসে থেমেছে, আমি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ নামাতে গিয়ে হঠাৎ একজন গামছায় মুখ ঢাকা কুলির দিকে নজর পড়তেই, সমস্থ শরীর শিউরে ওঠে! আমি ব্যাগ বোকচা ট্রেনের এক গার্ডের জিম্মায় রেখে দিয়ে আস্তে আস্তে সেই গামছায় মুখ ঢাকা লোকটার দিকে এগিয়ে যাই। উদ্দেশ্য কাছ থেকে লোকটাকে ভাল ভাবে দেখা। দেখলাম লোকটা একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা পান করছে। আমিও ঠিক সেই দোকানটার সামনে গিয়ে দোকানদারের কাছে একটা ব্যানসন সিগারেট চাইলাম। দোকানদার সিগারেট দিলে আমি সেটা ধরানোর সময়, আড় চোখে সেই লোকটাকে এবার ভাল ভাবে দেখে নিলাম।
আর কেউ নয়, এ আমার তদন্তকৃত খুনের সেই বিখ্যাত আসামী নাহিদ সরদার! সিগারেট ধরিয়ে তাৎক্ষনিক ভাবে আমি স্থানীয় রেলওয়ে পুলিশের কামরার দিকে চলে যাই। এবং তাদের কে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে সকল ঘটনার বিবরন দিয়ে গোটা কতক পুলিশ নিয়ে আবারও সেই দোকানটার সামনে চলে আসি। নাহিদ সরদার তখন সবে মাত্র চা শেষ করে দোকানদারকে বিল মিটিয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি সাথে সাথে বাঁশি বাজিয়ে স্থানীয়দেরকে সরে যেতে বলি এবং আমার সার্ভিস রিভালবারটি নাহিদের দিকে তাক করে ধরে তাকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিই।
হঠাৎ করে সামনে একঝাঁক বন্দুক এবং রিভালবার তার্ক করা দেখে নাহিদ ঘাবড়ে যায়, এবং ভড়কানো ঘোড়ার মত সে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পালানোর আগেই একজন দৌঁড়ে গিয়ে তাকে জাপটে ধরে। তারপর তাকে নিয়ে থানার ঘরে হাজির করা হলো, এবং সার্চ করে তার কাছে তার মৃত স্ত্রীর সোনার হার এবং কয়েক'শ টাকা পাওয়া গেল।
((পর্ব নং-০৫))
নাহিদের মামলা দ্বায়রা আদালতে উঠলো। নাহিদের পক্ষে একজন নামজাদা ফৌজদারি উকিল নিযুক্ত হয়েছিলেন। এবং তার সঙ্গে দুই তিনজন জুনিয়র। সরকারের পক্ষে ছিলেন স্থানীয় প্রবীণ পাবলিক প্রসিকিউটর। অখিল রায় কোন পক্ষেরই স্বাক্ষী হিসাবে ছিলেন না, কিন্তু তিনি বরাবরই কোর্টে হাজির ছিলেন। তাছাড়া শহরের মিডিয়ার লোকজন ছাড়াও কৌতুহলি জনতা ভিড় করে মজা দেখতে এসেছিল। আসামীর কাঠগড়ায় নাহিদ সরদার একমাথা রুক্ষ্ম চুল এবং একমুখ দাঁড়ি নিয়ে চোখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হাকিম আফসার খান বিচারকের আসনে বসবার পর মামলা আরম্ভ হলো। আফসার খান কড়া মেজাজের বিচারপতি। তার এজলাসে উকিলরা বৃথা বাক্য ব্যয় বা চেচামেচি করার সাহস পায় না। জুড়ি নির্বাচন সম্পন্ন হলে সরকারি উকিল সংক্ষেপে মামলার বিবরণ দিলেনঃ
"নাহিদ সরদার উশৃংখল যুবক। জুয়া এবং আনুসঙ্গিক নানা প্রকার অনাচারে পৈত্রিক পয়সা ওড়ানোই ছিল তার একমাত্র কাজ। তার সতী স্বাদ্ধী স্ত্রী কমলা তাকে অনেক বার সৎ পথে আনবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ঠিক পেরে উঠতো না। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে প্রায়ই ঝগড়া হতো। নিজের রুচি ও প্রবৃত্তি অনুযায়ী তার কাজে বাঁধা পেয়ে, নাহিদ স্ত্রীর প্রতি অতিশয় বিদ্বেষ ভাবপন্য হয়ে উঠেছিল। গত ১৭ ই মার্চ শনিবার স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ চরমে ওঠে। নাহিদের জুয়া খেলবার প্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল অথচ মাসের শেষে তার হাতে কোন টাকা ছিল না। সে প্রথমে টাকা ধার করবার চেষ্টা করলো কিন্তু কারো কাছে টাকা ধার না পেয়ে, স্ত্রীর গলার হার বন্ধক দিয়ে টাকা সংগ্রহ করবার মতলব করলো। রাত সাড়ে দশটার পর সে বাড়ি ফিরে স্ত্রীর কাছে হার চাইলো। কমলা স্বাভাবিক ভাবেই হার দিতে অস্বীকার করলো। তখন নাহিদ স্ত্রীর মাথায় প্রচন্ড জোরে আঘাত করে তাকে খুন করলো এবং তার গলা থেকে হার খুলে নিয়ে ফেরারি হলো।
এর প্রায় একমাস বাদে গোল্লামারি রেল স্টেশনে নাহিদ সরদার সিআইডি অফিসার ডিএসপি নিশানের হাতে গ্রেফতার হয়। তার সঙ্গে তখনও তার স্ত্রীর হার ছিল। সেই হার পুলিশ কর্তৃক কেমিক্যাল এনালিস্টের কাছে পাঠানো হয় এবং হার পরীক্ষার পর জানা গেছে তাতে রক্ত লেগে ছিল। সেই রক্ত নাহিদের স্ত্রী কমলার রক্ত! অন্তত হারে লেগে থাকা রক্ত এবং কমলার রক্ত একই গ্রুপের। এছাড়া ডিএনএ টেস্টেও উক্ত হার যে কমলার তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। খুনের প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষী অবশ্য নেই, তবে সকল স্বাক্ষ্য প্রমাণ পরপর সাজিয়ে বলাই যায়, নাহিদ তার নিজের স্ত্রীকে খুন করেছে। এ বিষয়ে রি-এজনেবল ডাউটের কোন অবকাশ নেই।"
আসামীকে প্রশ্ন করা হলোঃ
-তুমি দোষী কি নির্দোষ?
নাহিদ হাত জোড় করে গলায় কান্না ভেজানো কণ্ঠে বলে উঠলোঃ
-হুজুর আমি মহা পাপী, কিন্তু আমি আমার নিজের স্ত্রীকে খুন করিনি হুজুর!
আসামী পক্ষের উকিল নিজের মক্কেলের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। কারণ সরকারি পক্ষের উকিলের উপস্থাপিত স্বাক্ষীগণের জবানবন্দীর পর আসামী পক্ষের উকিলের সাফাই আর ধোপে টিকলো না। স্বাক্ষীগণ একে একে এসে তাদের স্বাক্ষ্য পেশ করতে লাগলেন। বিভূতিভূষণ বাডুয্যে এবং করিম জমাদ্দার সহ আরো অনেকেই তাদের স্ব স্ব জবানবন্দি প্রদান করলেন। অখিল রায়েরও স্বাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি আগে থেকেই পাবলিক প্রসিকিউশনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। প্রথম দিন তিন চারজন স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হলো। নাহিদের উকিল দীর্ঘক্ষণ জেরা করেও স্বাক্ষীদেরকে টলাতে পারলেন না। সেদিনের মত মকদ্দমা শেষ হলে নাহিদকে আবার লকাপে নিয়ে যাওয়া হলো।
আদালত থেকে ফিরে অখিল রায় রাতের খাবার খেতে বসলেন। ঘরে এখন তিনি আর মৃণালিনী ছাড়া আর কেউ নেই। মৃণালিনী খাঁচায় ধরা পড়া ইঁদুরের মত ঘরের এদিক থেকে সেদিক ছটফট করে বেড়াচ্ছে। যেন বাইরে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। সে জানে, আজ থেকে নাহিদের মামলা শুরু হয়েছে। অখিল রায় খেতে খেতে বললেনঃ
-আজ দ্বায়রা এজলাসে লোকে লোকারণ্য। তীল ফেলবার জায়গা ছিল না। সবাই নাহিদের মোকদ্দমা শুনতে এসেছে।
মৃণালিনী কথা বলল না। তার অস্থিরতা যেন একটু বেড়ে গেল। অখিল রায় আবার বললেনঃ
-নাহিদ বলল, সে মহা পাপী, কিন্তু স্ত্রীকে খুন করেনি। হয়তো সত্যি কথাই বলছে। হয়তো এমনও হতে পারে যে, তার বৌ যখন খুন হয়, তখন সে বাড়িতে ছিল না। হয়তো অন্য কোথাও ছিল। কিন্তু প্রমাণ করবে কি করে!
মৃণালিনীর ছটফটানি আরো বেড়ে গেল। কিন্তু সে মুখ দিয়ে একটা কথাও উচ্চারণ করলো না। অখিল রায় মৃণালিনীর মুখের দিকে চোখ তুলে বললেনঃ
-নাহিদ যদি প্রমাণ করতে না পারে যে, খুনের সময় সে অন্য কোথাও ছিল। তাহলে হয়তো তার ফাঁসিই হয়ে যাবে।
মৃণালিনী হঠাৎ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। যেন খাঁচার ইঁদুর পালানোর পথ খুঁজে পেয়েছে।
((পর্ব নং-০৬))
পরদিন নাহিদের বিচারে আরো অনেক গুলো স্বাক্ষী উপস্থাপন করা হলো। সরকারি ডাক্তার পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট দিলেন। মাথায় ভোঁতা অস্ত্রদিয়ে আঘাত করার ফলেই কমলার মৃত্যু ঘটেছে। মৃত্যুর সময়, প্রায় মাঝ রাতের কাছাকাছি। কমলার রক্ত ও+ (পজেটিভ) গ্রুপের। তারপর পুলিশের দারোগা যিনি তদন্তের ভার পেয়েছিলেন তিনি স্বাক্ষী দিলেন। নাহিদের দু'জন পরিচিত ব্যক্তিও স্বাক্ষী দিল। খুনের আগে রাত আন্দাজ সাড়ে দশটার সময় নাহিদ তাদের কাছে টাকা ধার নিতে গিয়েছিল। কিন্তু তারা জানতো যে নাহিদ জুয়াড়ি। তাই খালি হাতে তারা টাকা ধার দিতে আপত্তি জানিয়েছিল। শুধুমাত্র যদি বন্ধক কিছু রাখে তাহলেই তারা টাকা ধার দিতে পারবে বলে জানিয়েও দিয়েছিল। ওদের কথা শুনে নাহিদ চলে গিয়েছিল, কিন্তু আর ফিরে আসেনি।
স্বাক্ষীদের জেরা শেষ করতে করতে দ্বিতীয় দিনের মত শুনানি শেষ হলো। স্বাক্ষীরা প্রত্যেকে তাদের বলা স্বাক্ষ্যের প্রতি অটল রইলো। তৃতীয় দিনের স্বাক্ষীরা ভাল করে নাহিদের গলায় ফাঁসির দঁড়ি পরিয়ে দিল। প্রথমে রেল স্টেশনের সেই পুলিশেরা স্বাক্ষী দিতে আসলো। তারপর এলো রেল স্টেশনে নাহিদের বর্ডিসার্চ কৃত সেই অন ডিউটি দারোগা। তিনি নাহিদের বর্ডিসার্চ করে তার কাছ থেকে সোনার হার উদ্ধারের কথা বলেন এবং হারটি পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারে পাঠিয়েও দেন। হারটিকে প্রমাণ সরুপ কোর্টে দাখিল করা হলো। তারপর আমার ডাক পড়লো। নাহিদ কে গ্রেফতার করা সহ পরবর্তী সকল কথা আমি আদালতের সামনে পেশ করলাম। অতঃপর এলো সরকারি রাসায়নিক পরীক্ষক। তিনি বললেন, হারে যে রক্ত লেগেছিল তা তিনি পরীক্ষা করে দেখেছেন, মানুষের রক্ত এবং ও পজেটিভ গ্রুপের রক্ত। রাসায়নিক পরীক্ষকের স্বাক্ষ্যের সাথে পোস্ট মর্টেম করেছেন যে ডাক্তার সেই ডাক্তারের স্বাক্ষ্য হুবহু মিলে গেল এবং কারোরই আর স্বন্দেহই রইলো না যে, নাহিদ সরদারই তার মৃত স্ত্রীর রক্তাক্ত দেহ থেকে হার খুলে নিয়েছিল এবং সেই তার স্ত্রীর খুনি!
স্বাক্ষীগণের স্বাক্ষ্যগ্রহণ এবং মামলার প্রমাণাদী উপস্থাপন শেষে প্রসিকিউশনের উকিল বললেন- 'হুজুর, আমার স্বাক্ষী গ্রাহণ শেষ হয়েছে। এবার আসামী পক্ষ ইচ্ছা করলে তার সাফাই পেশ করতে পারেন।'
কিন্তু সময়ের অভাবে আসামী পক্ষের উকিল সেদিন আর তার সাফাই পেশ করতে পারলেন না। আদালত পরের দিন পর্যন্ত মুলতবি ঘোষনা করা হলো। সেই দিন রাতে অখিল রায় রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটা সিগারেট ধরিয়ে বিছানার একপাশে এসে বসলেন। মৃণালিনী আয়নার সামনে বসে মুখে ক্রিম মাখছিল। অখিল রায় সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মৃণালিনীকে লক্ষ করে বললেনঃ
-নাহিদকে দেখে দুঃখ হয়। বেচারা কি যেন বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না। মামলার অবস্থাও ভাল নয়। ঞম.....মনে হচ্ছে ওর ফাঁসিই হবে।
মৃণালিনী অখিল রায়ের দিকে মুখ ফেরালো না। দু'হাতের আঙ্গুল দিয়ে মুখে ক্রিম ঘষতে লাগলো। অখিল রায় আবারও বললেনঃ
-আমার কি মনে হয় জানো? সম্ভাবত এর মধ্যে স্ত্রীলোক ঘটিতে কোন ব্যাপার থাকতে পারে। নাহিদের সঙ্গে বোধ হয় কোন কূলবধুর লটর পটর ছিল। যে রাতে নাহিদের স্ত্রী খুন হয় সে রাতে নাহিদ তার কাছে গিয়েছিল, কিন্তু সম্ভাবত সে কথা এখন সবার সামনে বলতে পারছে না। এমন অপরাধ আছে, যা স্বীকার করার চেয়ে, ফাঁসিতে চড়াই ভাল।
মৃণালিনী আলো নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো। অখিল রায় অন্ধকারের মধ্যে বসে সিগারেটটা শেষ করে তারপর তিনিও মৃণালিনীর পাশেই শুয়ে পড়লেন। হঠাৎ মৃণালিনীর হাতে তার হাত লাগলো। মৃণালিনীর হাত বরফের মত ঠান্ডা! কিছুক্ষণ চুপ থেকে অখিল রায় বললেনঃ
-নাহিদ লুচ্চা লম্পট হোক, কিন্তু ওর মনটা খুব ভাল। যার সঙ্গে ওর পিরিত আছে, তার উচিত এই বিপদে ওকে সাহায্য করা। সকলের সামনে দাঁড়িয়ে বলা, নাহিদ খুনের রাতে কোথায় ছিল! নিন্দা হবে, কলঙ্ক হবে, তবু একজন নিরপরাধ মানুষের প্রাণ তো বাঁচবে! উচিত কিনা? হুম, তুমিই বলো?
মৃণালিনী লেপের ভিতর থেকে ফোঁস করে উঠলো- 'আমি কি জানি?'
নাহিদের মামলা নিয়ে এই প্রথম সে কোন কথা বলল। অখিল রায়ের ইচ্ছা হলো বিছানা থেকে উঠে বাইরে গিয়ে চৌকির উপর শুয়ে রাত কাটান। কিন্তু সতী সাবিত্রী স্ত্রীর থেকে নষ্টা স্ত্রী লোকের চুম্বক শক্তি আরো প্রবল।
চতুর্থদিন আসামীর উকিলও যথা সম্ভব প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে তার মক্কেল খুন করেনি, সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। কারণ খুনের সময় তার মক্কেল পাশের বাজারে বসে তাস খেলছিল। এছাড়া আসামী পক্ষের উকিল তিনজন স্বাক্ষীও পেশ করলেন, যারা ঐ রাত্রে নাহিদ সরদারের সাথে বাজারে তাস খেলেছিল। কিন্তু সেই স্বাক্ষী গুলোকে দেখলেই বোঝা যায় যে, তারা ঠিক কোন ধরনের স্বাক্ষী দিতে আদালতে উপস্থিত হয়েছে। যাদেরকে সোজা কথায় সমাজের নিকৃষ্টতম জীব বলা যায়। নেশা, জুয়া, সর্ববিধ অসাধুতা তাদের মুখে পোস্ট অফিসের সীল মোহরের মত কালো ছাপ মেরে দিয়েছে। তারা একে একে এসে স্বাক্ষ্য দিলো যে, খুনের রাতে নাহিদ সরদার তাদের সাথে রাত সাড়ে নয়টা থেকে প্রায় একটা পর্যন্ত বাজারের দোকানে বসে ব্রিজ খেলছিল। ব্রিজ খেলা জুয়ার আওতাভূক্ত নয়। গেম অফ স্কেল। সুতরাং জুয়া খেলা সম্বন্ধেও তারা সম্পূর্ণ নিঃষ্পাপ। সেদিন রাত একটার দিকে তাস খেলা শেষে, নাহিদ উঠে বাড়ি চলে যায়। তারপর কি ঘটেছিল তা অবশ্য তারা জানে না।
এদের স্বাক্ষ্য ধোপে টিকলো না। পাবলিক প্রসিকিউটরের জেরার মুখে পড়ে তারা হড়বড় করতে লাগলো। তাদের স্বাক্ষ্য এতটাই দূর্বল ছিল যে, ব্রিজ খেলায় হরতন বড় না, চিড়িতন বড় সেটাই তারা জানে না। একজন স্বাক্ষী তো বলেই ফেললো, সে দিনটা শনিবার ছিল না সোমবার ছিল সেটাই তার ঠিক মত মনে পড়ছে না। তিনটা স্বাক্ষীর জেরা শেষ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেল। হাকিম আফসার খান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ
-এরকম স্বাক্ষী আপনার আর কয়টা আছে?
উকিল অপ্রতিভ হয়ে বললেন- 'আজ্ঞে হুজুর, আমার কেস ক্লোজড করলাম। আর স্বাক্ষী দেবো না।'
হাকিম একবার দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেনঃ
-খুব ভাল। এবার তাহলে আগ্রুমেন্ট শুরু করুন।
পাবলিক প্রসিকিউটর আগ্রুমেন্ট শুরু করবার আগে কাগজ পত্র নাড়া চাড়া করতে করতে তার জুনিয়রদের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছিলেন। ঠিক এমন সময় অখিল রায় কোর্টের পিছনদিকের একটা বেঞ্চে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেনঃ
-হুজুর আমার কিছু বক্তব্য আছে। আমি এই মামলায় কোর্টের পক্ষ থেকে স্বাক্ষ্য দিতে চাই।
হাকিম চমকে গিয়ে মুখ তুললেন! অখিল রায় কোর্টের সামনে এসে স্বাক্ষীর কাঠ গড়ায় দাঁড়িয়ে বললেনঃ
-হুজুর আমি একজন ডাক্তার। এই শহরেরই বাসিন্দা। আসামীর প্রতিবেশি। আমার নাম শ্রী অখিল চন্দ্র রায়। এই মামলা সম্বন্ধে আমি কিছু জানি হুজুর, আমাকে তা পেশ করার অনুমতি প্রদান করা হোক।
হাকিম কিছুক্ষণ অখিল রায়ের দিকে চেয়ে থেকে তারপর ঘাড় নাড়লেন। অখিল রায়কে স্বাক্ষীর হলফ নামা পড়ানো হলো। তিনি হাকিমের দিকে ফিরে ধিরে ধিরে বলতে আরম্ভ করলেনঃ
-হুজুর এই মামলার গোড়া থেকে আমি কোর্টে হাজির আছি। সমস্থ স্বাক্ষীর জবান বন্দীও শুনেছি। সরকারি উকিল স্বাক্ষী সাবুদ দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, গত ১৭ ই মার্চ রাত আন্দাজ এগারটার সময় নহিদ সরদার তার স্ত্রী কমলাকে খুন করেছে। হুজুর কমলাকে কে খুন করেছে আমি জানি না। কিন্তু আমি হলফ নিয়ে বলতে পারি, সেই রাতে এগারটার সময় নাহিদ তার নিজের বাড়িতে ছিল না।
অখিল রায় একটু থামলেন। হাকিম গম্ভির ভাবে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ
-তাহলে কোথায় ছিল?
-আমার বাড়িতে হুজুর।
হাকিম আফসার খান বিদ্রুপের সুরে বলে উঠলেনঃ
-রাত এগারটার সময় আসামী আপনার বাড়িতে কি করছিল? আপনার সঙ্গে তাস খেলছিল?
-না হুজুর। আমি সেদিন বাড়িতে ছিলাম না!
হাকিম বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন- 'তাহলে?'
মাথা হেট করে অখিল রায় বললেনঃ
-আমি বাড়ি নেই জানতো বলেই নাহিদ আমার বাড়িতে গিয়েছিল। নাহিদের সঙ্গে আমার স্ত্রীর গোপন অবৈধ সম্পর্ক আছে!
কোর্ট ঘরের মাথার উপর বজ্রপাত হলেও এমন লোমহর্ষক পরিস্থিতি তৈরি হতো কিনা কে জানে! কোর্টের উপস্থিত লোক গুলি যেন কিছুক্ষনের জন্য একদম অসাড় হয়ে গেল। তারপর পিছন দিকের ভিড়ের মধ্যে ক্রমে একটা চাপা কলরব উঠলো। হাকিম আফসার খান সবার দিকে কটমট করে তাকালেন। কিছুক্ষণ বাদে সবাই চুপ করে গেলেন। কিন্তু সকলের উত্তেজিত চোখ পর্যায়ক্রমে একবার অখিল রায়ের দিকে আর একবার আসামী নাহিদ সরদারের দিকে ঘুরতে লাগলো। নাহিদ অখিল রায়কে কাঠগড়ায় উঠতে দেখে ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। এখন দু'হাতে মুখ ঢেকে বসে রইলো। হাকিম আফসার খান স্বাক্ষীর দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেনঃ
-আপনি বলছেন যে আপনি বাড়িতে ছিলেন না?
-আজ্ঞে না হুজুর! আমি রাত আন্দাজ সাড়ে আটটার সময় চৌধুরিদের বাগানে পাখি শিকারে গিয়েছিলাম।
-তাহলে আপনি জানলেন কিভাবে যে, আসামী আপনার বাড়িতে গিয়েছিল?
-আজ্ঞে আমি আবার ফিরে এসেছিলাম। আমি দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে করেছি। কিছুদিন থেকে আমার সন্দেহ হয়েছিল যে, আমার স্ত্রীর চালচলন ভাল নয়। তাই সেদিন যাচাই করবার জন্য আমি পাখি শিকারের ছল করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলাম।
হাকিম কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপর কড়া সুরে বললেনঃ
-তাহলে এতদিন একথা বলেননি কেন?
-লজ্জায় বলতে পারিনি হজুর। নিজের স্ত্রীর কলঙ্কের কথা কে প্রকাশ করতে চায়? তাছাড়া নাহিদ আমার বন্ধু নয়। আমার শত্রু। তাকে বাঁচানোর কোন দ্বায় আমার নেই। কিন্তু যখন দেখলাম তার ফাঁসির সম্ভাবনা অনিবার্য, তখন আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। যতবড় পাপীই হোক, কিন্তু সে খুন করেনি।
এই সময় নাহিদ চাপা গলায় কেঁদে উঠলো। সরকারি উকিল উঠে দাঁড়িয়ে বললেনঃ
-হুজুর আমি স্বাক্ষীকে জেরা করতে চাই।
হাকিম বললেন- 'অবশ্যই! কিন্তু আজ আর সময় নেই। আগামী কাল সকাল দশটা পর্যন্ত আদালত মুলতবি ঘোষনা করা হলো।'
সেইদিন সন্ধ্যাবেলা অখিল রায় বাড়ি ফিরে দেখলেন, ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। মফঃস্বল শহরে কোন কথা বাতাসের গতিতে ছোটে। অখিল রায়ের বুঝতে বাকি রইলো না যে, আদালতের সমস্থ ঘটনাই এতক্ষনে মৃণালিনীর কানে এসে পৌঁচেছে। অখিল রায় কিছু না বলে সমস্থ রাত বারান্দায় কাটালেন।
((পর্ব নং-০৭))
পরদিন আদালতে লোকে লোকারণ্য। যেন তিল ফেলবার মত জায়গা অবশিষ্ট নেই। আসামীর কাঠগড়ায় নাহিদ কে দেখা যাচ্ছে না। সে কাঠগাড়ার খাঁচার মেঝেতে বসে সবার চোখের আড়াল হওয়ার চেষ্টা করছে। অখিল রায়ের জবানবন্দী আরম্ভ হলো। কিন্তু নতুন কিছু বললেন না। আগে যা বলেছিলেন তাই বিস্তারিত করে আবার বললেন। নাহিদের উকিল অ-প্রত্যাশিত স্বাক্ষী পেয়ে যেন ভরাডুবি থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তিনি অখিল রায়কে কোন জেরা করলেন না। পাবলিক প্রসিকিউটর হিংস্র ভাবে অখিল রায়কে আক্রমণ করলেন। কিন্তু তার জেরাও ব্যর্থ হলো। অখিল রায়কে তিনি টলাতে পারলেন না। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে সেইদিন কোর্টে উল্লেখিত সওয়াল ও জবাবের কিছু অংশ এখানে সংক্ষিপ্ত করে উঠিয়ে দেওয়া হলোঃ
পাবলিক প্রসিকিউটর বললেন- 'কতদিন হলো আপনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন?'
অখিল রায়ের উত্তর- 'বছর দুই হলো।'
-কবে আপনি জানতে পারলেন যে আপনার স্ত্রীর চাল চলন ভাল নয়?
-জানতে পারিনি, সন্দেহ করেছিলাম।
-কবে থেকে সন্দেহ করেছিলেন?
-এই ঘটনার দু'চারদিন আগে থেকে।
-কি দেখে সন্দেহ করেছিলেন?
-চালচলন দেখে।
-আপনার স্ত্রীকে কি এ বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?
-না।
-কেন বলেন নি?
অখিল রায় জিজ্ঞাসু চোখে হাকিমের দিকে চাইলেন। হাকিম বললেনঃ
-প্রশ্ন অবান্তর। অন্য প্রশ্ন করুন!
প্রসিকিউটর পুনরায় বললেন- 'আপনি বলেছেন সেই রাতে আপনি নিজের শোবার ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে আঁড়ি পেতে ছিলেন। তো প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত আপনি আঁড়ি পেতে ছিলেন?
-আন্দাজ সোয় দশটা থেকে বারটা পর্যন্ত।
-এই পৌনে দুই ঘন্টা আপনি চুপটি করে জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন?
-হ্যাঁ।
-ঘর তো একেবারে অন্ধকার ছিল না? কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না?
-না, দেখার চেষ্টা করিনি। তবে কথা শুনতে পাচ্ছিলাম।
-ওরা কি খুব জোরে জোরে কথা বলছিল?
-না। চুপিচুপি কথা বলছিল।
-চুপিচুপি কথা বলা স্বত্তেও আপনি আসামীর গলা চিনতে পারলেন?
-শুধু গলা শুনে নয়। ওদের কথা থেকেও বুঝতে পেরেছিলাম। একাবার আসামী বলেছিল- 'নাহিদ সরদার ভদ্র লোকের ছেলে। প্রাণ গেলেও সে ভদ্রমহিলার কলঙ্ক হতে দেবে না।'
-আর কি কি কথা শুনতে পেয়েছিলেন?
হাকিম উকিলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন- 'অন্য প্রশ্ন করুন!'
-যাক, আপনি যখন জানতে পারলেন যে আপনার স্ত্রী ব্যাভিচারিনী তখন আপনার রক্ত গরম হয়ে ওঠেনি, রাগ হয়নি আপনার?
-হয়েছিল। রাগের মাথায় ইচ্ছা হচ্ছিল দরজা ভেঙে দু'জনকে আচ্ছা মত পিটাই। কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়ও হচ্ছিল। আমি একা, আর ওরা দু'জন। আমি ওদের সঙ্গে শক্তিতে পারবো না। ওরা যদি আমাকে খুন করে! তাছাড়া আমি বুড়ো মানুষ।
-তাই ফিরে গিয়ে আবারও পাখি শিকার করতে লাগলেন?
-হ্যাঁ।
-আপনি মানুষ না কেঁচো?
অখিল রায় চুপ করে রইলেন। হাকিম কড়া স্বরে সরকারি উকিলকে বললেনঃ
-আপনি বারবার এভিডেন্স এ্যাক্টের বাইরে যাচ্ছেন! অনেকবার করে বলছি এসব প্রশ্ন অবান্তর, অসংগত। আপনার যদি আর কোন প্রশ্ন না থাকে তাহলে আপনি বসতে পারেন!
সরকারি উকিল তড়িঘড়ি করে বললেন- 'আর একটা প্রশ্ন হুজুর।'
-আচ্ছা আপনার স্ত্রী কি এখনো আপনার বাড়িতেই আছে?
-আজ সকালে কোর্টে আসার আগ মূহুর্ত্ব পর্যন্ত তাকে বাড়িতেই দেখে এসেছি। এখন কোথায় আছে জানি না।
- আচ্ছা এই ব্যাপারের পর থেকে তার সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?
হাকিম ধমক দিয়ে উঠলেন! অখিল রায় হাকিমের দিকে ফিরে বললেনঃ
-হুজুর প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি বয়ষ্ক মানুষ। যুবতীকে বিয়ে করা আমার উচিত হয়নি। তাই যখন তার এই ধরনের ব্যাপারগুলো জানতে পেরেছিলাম, তখন স্থির করেছিলাম তাকে আর আমার সংসারে রাখবো না। চুপিচুপি ওকে আমি ত্যাগ করবো। কিন্তু মাঝখান থেকে এই খুনের ঘটনা আমার সে প্লান সব ভেস্তে দিল।
সরকারি উকিল একবার হাকিমের মুখের দিকে তাকালেন, একবার জুড়িদের মুখ দেখলেন। কিন্তু তাদের মুখের ভাব বুঝতে তার আর দেরি হলো না। মামলার হাল একেবারে উল্টে গেছে। তিনি আর কোন প্রশ্ন না করে বসে পড়লেন। ইতোমধ্যে নাহিদের উকিল উঠে গিয়ে নাহিদের সঙ্গে কথা বলে এসেছিলেন। তিনি এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললেনঃ
-হুজুর, এবার আসামী নিজের মুখে তার স্টেটমেন্ট দেবেন।
কোর্টের সকলে শিড়দাঁড়া খাড়া করে বসলো। নাহিদ ধিরে ধিরে কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়ি গোফ ও রুক্ষ্ম চুলের ভেতর থেকে তার মুখ খানা দেখে মনে হয়, সে বুঝি একটা পাগল ভিখারী। কেঁদে কেঁদে চোখ দু'টো জবা ফুলের মত লাল করে ফেলেছে। সে হাত জোড় করে ভাঙা গলায় বলতে আরম্ভ করলোঃ
-"ধর্মাবতার, আমি মহা পাপী। ফাঁসিই আমার উপযুক্ত শাস্তি। কিন্তু আমি আমার স্ত্রীকে খুন করিনি ধর্মাবতার। অখিল বাবু যা বলেছেন, তার এক বিন্দুও মিথ্যে নয়। তিনি যদি এসব কথা না বলতেন তাহলে আমিও চুপ করে থাকতাম। কিন্তু এখন চুপ করে থাকার কোন স্বার্থকতা নেই হুজুর। সেই রাতে আন্দাজ বারটার সময় আমি নিজের বাড়িতে ফিরে যাই। গিয়ে দেখলাম সদর দরজা খোলা। সামনের ঘরে আলো জ্বলছে। আর আমার স্ত্রী কমলা মেঝেতে মরে পড়ে আছে। তার সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত। আমি ভয়ে দিশেহারা হয়ে গেলাম হুজুর। আমাকে সবাই খুনি বলে সন্দেহ করবে। কমলার সঙ্গে যে আমার ভাল সম্পর্ক ছিল না, একথা সবাই জানতো হুজুর। প্রাণ বাঁচাবার একমাত্র উপায় হলো পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমার পকেটে তখন কোন টাকা ছিল না। আর সেজন্যই আমি পালানো সময় আমার স্ত্রীর গলার হার খুলে নিয়ে পালালাম। কিন্তু তাতে যে রক্ত লেগে আছে তা জানতে পারিনি। ইচ্ছা ছিল হার বিক্রি করে যে টাকা হবে, সেই টাকা দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাবো। কিন্তু ভয় হলো, হার বিক্রি করতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে যাই। কারণ ইতোমধ্যে আমার ছবি সহ খুনের খবর পত্রিকায় বেরিয়ে গেছে। পুলিশ আমাকে হণ্যে হয়ে খুজছে। আর তাই সেখান থেকে খুলনা রেল স্টেশনে এসে আমি কুলির কাজ করতে লাগলাম। কিন্তু সিআইডি অফিসার 'নিশান' আমার খুনের তদন্ত করতে এসে রেলস্টেশনে নেমে আমাকে দেখে চিনতে পারেন। এবং আমাকে গ্রেফতার করেন। হুজুর এই হলো আমার বয়ান। আমি যদি একটি কথাও মিথ্যে বলে থাকি তাহলে আমার মাথায় যেন বাজ পড়ে হুজর। মাথায় যেন বাজ পড়ে।"
নাহিদ কান্নায় ভেঙে পড়লো। রুদ্ধশ্বাস বিচার ঘর। আসামীর উকিল ধিরে ধিরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেনঃ
-হুজুর এর পর আমি আর একটা কথাও বলবো না। সরকারি উকিল এখন তার ভাষণ দিতে পারেন।
সরকারি উকিল দীর্ঘ ভাষণ দিলেন। ভাষণ শেষ হওয়ার আগেই দুপুরে লাঞ্চের সময় হয়ে গেল। লাঞ্চ শেষে তিনি আবারও কিছুক্ষণ ভাষণ চালালেন। অখিল রায় যে নিজের নাম কেটে যাত্রা ভঙ্গ করছেন, এই কথা তিনি বার বার হাকিমকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন। তার কথা কিন্তু কারো মনে জায়গা পেল না। তার বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর হাকিম জুড়িদেরকে মামলা বুঝিয়ে দিলেন। জুড়ি উঠে গিয়ে পাঁচ মিনিট নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করলেন। তারপর ফিরে এসে হাকিমের সাথে কথা বললেন। কিছুক্ষন হাকিম তাদের সাথে কথা বলে তারপর কোর্টে সবার দিকে তাকিয়ে মামলার রায় দিলেনঃ
"আসামী নাহিদ সরদার সম্পূর্ণ নির্দোষ"
((পর্ব নং-০৮))
এতক্ষণ কথা বলার পর অখিল রায় একটু থামলেন। আবারও একটা সিগারেট ধরালেন। তখন রাত প্রায় একটা বাজে। অখিল রায়ের বাড়িতে আমি আর অখিল রায় মুখোমুখি বসে আছি। আমার মাথার মধ্যে রুমঝুম নুপুর বাঁজছে। কিন্তু বুদ্ধিটা একদম পরিষ্কার আছে। অখিল রায় নির্বাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললামঃ
-তারপর।
অখিল রায় আমার মুখের দিক থেকে চোখ সরালেন না। বললেনঃ
-সেদিন সন্ধ্যা বেলা কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম মৃণালিনী বাড়িতে নেই। সে পালিয়েছে। কোথায় গেছে জানি না। হয়তো দূর সম্পর্কের সেই ভাইয়ের বাড়িতেই গেছে!
আমি প্রশ্ন করলাম- 'আর নাহিদ?'
-সে আছে। গতকাল রাতে এসেছিল। পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে গেল।
কিছুক্ষন কোন কথা হলো না। আমার মাথার মধ্যে রুমঝুম শব্দের সাথে সাথে একটা বেতালা চিন্তা ঘুরপাঁক খাচ্ছে। শেষে বললামঃ
-একটা প্রশ্নের কিন্তু এখনো কোন ফয়সালা হলো না?
অখিল রায় রক্ত চক্ষু মেলে আমার দিকে তাকালেন। আমি কোন ধরনের ইতস্তত না করে সরাসরি বললামঃ
-কমলাকে খুন করলো কে?
অখিল রায় এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি না থেমে বলতে লাগলামঃ
-আপনি সেই রাতে লোহার ডান্ডা হাতে করে নিয়ে আড়ি পাততে এসেছিলেন। আদালতে কিন্তু সেই লোহার ডান্ডার কথা আপনি বলেন নি?
অখিল রায় আরো কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেনঃ
-আপনার বিশ্বাস কমলাকে আমিই খুন করেছি?
-বিশ্বাস নয়, সন্দেহ! আপনি পৌনে দু'ঘন্টা জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন, এটা বিশ্বাস করা শক্ত! আপনি কেঁচো নন, মানুষ!
অখিল রায়ের সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল। তিনি আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে কড়া ভাবে টানতে লাগলেন। তারপর পাশের পানির জগটি থেকে গ্লাসে এক গ্লাস পানি ঢেলে ঢকঢক করে সেটা খেয়ে, কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলেন। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। হঠাৎ তিনি মাথা উঠিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত দৃঢ় অথচ প্রায় চাপা আর্তনাদের মত করে বললেনঃ
-হ্যাঁ হ্যাঁ, কমলাকে আমিই খুন করেছিলাম। আমিই খুন করেছিলাম। আপনাকে বলছি, কিন্তু আপনি যদি অন্য কাউকে বলেন, তাহলে আমি অ-স্বীকার করবো। আমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই।
আমার মাথার মাধ্যে ঘুরতে থাকা বেতালা চিন্তাটা এবার তালে তালে নেচে উঠলো। এতদিনের অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে আমার মাথার মধ্যের সমস্থ জটগুলো যেন সব এক নিমেষে হাওয়া হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলামঃ
-আপনি কমলাকে খুন করতে গেলেন কেন? সে তো কোন দোষ করেনি? তাহলে........??
অখিল রায় বললেন- 'আমার খুন করবার কোন মতলব ছিল না। নিজের ঘরে এই নষ্টামি দেখে আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল। আমি গিয়েছিলাম প্রতিশোধ নিতে!
-প্রতিশোধ নিতে......??
-হ্যাঁ। নাহিদ আমার মুখে চুন কালি দিয়েছে। তাই আমি চেয়েছিলাম তার গালে চুনকালি দিতে। কিন্তু কমলা অন্য জাতের মেয়ে। সে মৃলালিনী নয়! আমার মতলব যখন সে বুঝতে পারলো তখন আমার ধুতির কোচা চেপে ধরে সে বললঃ
-তবেরে হাড় হাফাতে অল্প পেয়ে বুড়ো মিনশে। তলে তলে তোর মনে এই বদ মতলব ছিল! দাঁড়া তোর পিন্ডি চটকাচ্ছি।
এই বলে আমার কোচা ধরে সে প্রাণ পনে চেঁচাতে লাগলো- 'মেরে ফেললো, মেরে ফেললো।'
তখন আমার কাছে ওকে খুন করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। চিৎকার শুনে হয়তো পাড়া পরশিরা এসে পড়বে। তাছাড়া যদি ছেড়ে দিয়েও চলে আসি, তাহলে পরদিন আর লোক সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না। উপায় অন্তর না দেখে হাতে যে লোহার ডান্ডাটি ছিল সেইটা দিয়ে মাথায় দিলাম এক ঘা বাড়ি কষিয়ে। বাড়ি খাওয়ার সাথে সাথে কমলার মাথায় ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। তারপর কিছুক্ষণ ছটফট করে অবশেষে সে মারা গেল! কিন্তু বিশ্বাস করুন, তাকে মারার কোন রকমের ইচ্ছা বা অভিপ্রায় আমার ছিল না। আমি শুধুমাত্র পরিস্থিতির স্বীকার হয়েই তাকে খুন করতে বাধ্য হয়েছিলাম.......!!
অখিল রায় চুপ করলেন। তার সিগারেটের প্যাকেটে আর কোন সিগারেট নেই। আমি নিজের প্যান্টের পকেট থেকে ব্যানসনের প্যাকেটটা বের করে সেখান থেকে একটা সিগারেট তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সিগারেট পেয়ে অখিল রায় তাতে আগুন ধরিয়ে মৃদু মৃদু টান দিতে লাগলেন। এভাবে প্রায় অনেকক্ষণ কেটে গেল। রাত তখন প্রায় দু'টো বাজে। শেষে আমি উঠবার সময় উনাকে আমার মোবাইলটা দেখিয়ে বললামঃ
-আপনি প্রমাণের কথা বলছিলেন না? এটাই হলো আপনার অপরাধের সব থেকে বড় প্রমাণ!
অখিল রায় তীক্ষ্ম দৃষ্টি মেলে আমার দিকে চাইলেন। তার চোখ দু'টোকে কেমন যেন মায়ার মত মনে হলো। আমি মোবাইলের পিছনের পার্ট খুলে তার ভিতর থেকে মেমোরীটা বের করে, সেটা অখিল রায়ের হাতে দিতে দিতে বললামঃ
-কিন্তু এখন এটার আর দরকার নেই! ইচ্ছা করলে এটাকে আপনি নিজের কাছে রেখে দিতে পারেন। কারণ সব অপরাধের শাস্তি দেওয়া যায় না। কিছু কিছু অপরাধ আসলে ঠিক অপরাধ নয়। সেটাকে জিঘাংসা কিংবা প্রতিশোধও বলা যায়! আমি যদি আপনার জায়গায় থাকতাম, তাহলে হয়তো আমিও তাই করতাম, যেটা আপনি করেছেন! সুতরাং, ভাল থাকবেন!
বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। অখিল রায় মেমোরীটা হাতে নিয়ে সেটা মুখে পুরে দিয়ে দাঁত দিয়ে সেটাকে পিষতে লাগলেন। যেন তার সমস্থ রাগ এখন তিনি ঐ মেমোরীটার উপর ঝাড়ছেন। আমি বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাইরের দিকে পা বাড়ালাম। অখিল রায় শূণ্যদৃষ্টি মেলে আমার গমন পথের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি দরজার কাছ পর্যন্ত গেলে হঠাৎ অখিল রায়ের কণ্ঠস্বর শুনে আমি চমকে মুখ ফিরিয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম! তিনি বলছেনঃ
-Criminal Investigation Of Department (CID)-এর সব থেকে সিন্সিয়ার অফিসার Deputy Superintendent Of Police (DSP) জনাব 'নিশান', আমি কিন্তু আপনাকে ঠিকই চিনেছিলাম। আপনার নাম 'সম্রাট' এবং পরিচয় সাংবাদিক হিসাবে দিলেও, আপনি যখন সন্ধ্যার দিকে আমার পাশে বসে মিষ্টি মিষ্টি কণ্ঠে কমলার খুনের কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন না, সেই তখনই আপনাকে আমি চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু তারপরেও ধরা দেই নি। কারণ আমি খুব ভাল ভাবেই জানতাম, আপনি কোন ধরনের মানুষ। আর সেজন্যই বলতে পারেন, অনেকটা নিজ ইচ্ছাতেই আমি এই কাহিনী আপনার কাছে বর্ননা করেছি। অন্যকেউ হলে আমার জীবন চলে গেলেও সে আমার মুখ থেকে এই ঘটনার একটা কণামাত্রও শুনতে পেতো না!
আমার শির দাঁড়া বেয়ে একটা সরিসৃপ কিলবিলিয়ে চলে গেল। নিজের অজান্তে কেন জানি সমস্থ শরীরটা একটু শিউরে উঠলো। কিন্তু সেটাকে সামনে প্রকাশ না করে, মুখে একটু হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে বললামঃ
-থ্যাংকিউ!
বলে মুখ ঘুরিয়ে যেই না দরজার ওপারে পা ফেলতে যাবো, অমনি পিছন থেকে আবারও অখিল রায়ের ডাক শুনতে পেলাম। মুখ ফিরিয়ে দেখি, অখিল রায় ডান হাত কপালে ঠেকিয়ে আমাকে সেলুট দেওয়ার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বৃদ্ধাঙ্গুল নাচিয়ে তার স্যালুটের জবাব দিয়ে, বাইক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছোট করে বললামঃ
-Dear Akhil Babu, All the best.....!!
------------------------------------------------------সমাপ্ত------------------------------------------------------
পুনশ্চঃ- গত কয়েক বছর আগে জনপ্রিয় ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বকশি এবং ভুতজ্ঞানী বড়'দা চরিত্রের উদ্ভাবক জনাব 'শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়' রচিত 'শরদিন্দু অমনিবাস-৭ম খন্ড' থেকে 'স্বাক্ষী' নামক একটি গল্প পড়েছিলাম। আমার আজকের এই গল্পটি অনেকটা সেই স্বাক্ষী গল্পের অনুকরণে রচিত। ইচ্ছা ছিল গল্পটাকে খন্ড খন্ড আকারে প্রকাশ করবো। কিন্তু কয়েকজন পাঠকের বিশেষ অনুরোধে গল্পটি সব একত্রে প্রকাশ করা হলো। এতক্ষণ যাবত আপনার মূল্যবান সময়টি নষ্ট করে এতবড় একটা গল্প পড়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ! অফুরন্ত শুভেচ্ছা রইলো আপনার জন্য!
বিঃ দ্রঃ- এটি একটি অনুকরণীয় গল্প। তবে গল্পের বিষয়বস্তু সহ সমস্থ চরিত্রই কাল্পনিক। যদি কারো ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মিলে যায়, তাহলে সেটা একান্তই কাকতালীয় মাত্র। সেজন্য লেখক কোন অংশেই দ্বায়ী থাকবে না। তাছাড়া টাইপিংয়ের ভুলের কারনে হয়তো অনেক জায়গায় বানানে ভুল থাকতে পারে। সেটাকে বিবেচ্য বিষয় হিসাবে না ধরে, ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে কৃতার্থ হবো!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১০:৩৮