সাঈদীকে যেদিন চাঁদে দেখা গেল, সালেহি সেদিন বলেছিল, ‘দেখিস এবার আল্লাহ নিজের হাতে গোলাম আযম আর সাঈদীদের রক্ষা করবেন। তাঁরা যা করেছিলেন তা তো ইসলামের জন্যই করেছিলেন।’
আমরা বিশ্বাস করেছিলাম ওর কথা। ও মোবাইলে একটা ছবি দেখিয়েছিল। অবিশ্বাস করার কিছুই ছিল না তাতে। আমরা দেখলাম ছবিতে চাঁদের মধ্যে মওলানা সাহেবকে দেখা যাচ্ছে। সুবাহানাল্লাহ! আল্লাহ তায়ালার কত বড় কুদরত। জীবনে এমন জিনিস আর দেখা হবে কিনা কে জানে? সিরাজুল সালেহির কাছে থেকে নিয়ে মোবাইলটাকে সালাম করলো, চুমু খেল। এতে নাকি ছোওয়াব আছে।
সিরাজুলের বাবা আমাদের মসজিদের ইমাম; তাই ছওয়াবের হিসাবটা ও আমাদের চেয়ে ভাল জানে। আমরা যদিও হিসাবে অতো পটু নই কিন্তু হিসাবের খাতাটা উড়িয়ে দিতে পারি না। তাই আমরাও সালেহির হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে চুমু খেলাম, সালাম করলাম।
সিরাজুল প্রশ্ন করলো, ‘এই ছবিটা কখন তুলেছিস?’
‘ভোর রাতে’
‘কয়টার সময়?’
‘রাত তিনটা, সাড়ে তিনটা হবে।’
‘আমাদের ডাকিস নাই যে?’
‘ভাবলাম তোরা ঘুমিয়ে আছিস, তাই ডাকিনি।’
‘ঘুমে তো ছিলামই। কিন্তু এতো বড় ঘটনা ঘটলো, তুই আমাদের ডাকবি না?’
‘ভুল হয়ে গেছে। কিছু মনে করিস না দোস্ত।’
সালেহি ভুল স্বীকার করলেও আমাদের মন খারাপটা গেল না। সেটা আরও বেড়ে গেল যখন মাহাবুব ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। তিনি আমাদের এলাকার শিবির নেতা। যাদের এক নজরে শিবির বলে চেনা যায়, তিনি তাঁদের একজন। পাঞ্জাবীর সাথে একটা জিন্স প্যান্ট পড়ে আছেন, পায়ের কব্জির উপর এসে প্যান্ট শেষ হয়ে গেছে। ছোট ছোট দাড়ি চামড়ার সাথে লেপ্টে রয়েছে। সেই দাড়িতে হাত ঘসে তিনি বললেন, ‘গত রাতে তোমরা কোথায় ছিলে?’
প্রশ্নের সাথে সাথেই বুঝে গেলাম কি প্রসঙ্গে কথা বলবেন মাহাবুব ভাই। তাই একটু মাথা নিচু করে বললাম, ‘ঘুমাচ্ছিলাম।’
‘ও আচ্ছা। এদিকে কি হয়েছে শুনেছো?’
‘জী’। আমরা কেন ঘুমিয়ে ছিলাম, কেন দেখতে পারিনি সে ব্যপারে তিরস্কার করা হলো না বলে আশ্বস্থ হলাম।
‘ছবি দেখেছো?’ তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
‘দেখেছি’
‘কোথায়! কার কাছে দেখেছো?’
‘সালেহির কাছে’
‘আমিও ছবিটা তুলেছি। দেখবে?’
আমরা মাথা নেড়ে দ্বিতীয়বার ছবিটা দেখলাম। একই ছবি। সালেহির ছবিটাও তাই ছিল; অবিশ্বাস করার কিছু নাই।
‘এটা হলো ইঙ্গিত।’ তিনি নসিহত শুরু করলেন। বরাবরের মতো আমার আর সিরাজুলের হাত ধরে আছেন, যাতে তাঁর কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা পালিয়ে যেতে না পারি। যদিও আজ আমাদের তেমন লক্ষণ ছিলো না, বরং আগ্রহ ছিল বেশি। মনের মধ্যে আক্ষেপ ছিলো চাঁদের ঐ দৃশ্যটি নিজের চোখে দেখতে পারি নাই বলে।
মাহাবুব ভাই আবার বললেন, ‘এটা হলো ইঙ্গিত, বুঝেছো?’
‘জ্বী’
‘আল্লাহ তায়ালা মাঝে মাঝে তার বান্দাদের এমন ইঙ্গিত দিয়ে দেন। তখন বান্দাদেরও কিছু কর্তব্য করতে হয়।’
‘কি কর্তব্য?’
‘সেইটাই তো বলতে তোমাদের ডেকেছি’
‘জি আচ্ছা’
‘দেশে যে ঈমানদারদের বিরুদ্ধে জুলুম চলছে, মুসলমানদের দেশে ইহুদী-নাসারা আর হিন্দুদের রাজত্ব চলছে এটার বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে।’
‘জ্বী, জ্বী; জিহাদ করতে হবে।’ সিরাজুল প্রায় চিৎকার করে উঠে। সেটা দেখে মাহাবুব ভাই আনন্দিত হন।
আমরা সবাই জিহাদের জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হলাম। মাহাবুব ভাই আমাদের জিহাদ সম্পর্কে বয়ান করলেন। এই জিহাদ মুসলমানদের জন্য ফরয, একটা মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ৭১-সাল থেকে যে জিহাদ শুরু হয়েছিল তা আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের সকলের আত্মত্যাগ করতে হবে। আসলে আপাত চোখে পরাজয় দেখলেও সামনে রয়েছে ঈমানদারদের জন্য বেহেস্তি উপহার।
আমরা জিহাদের আহ্বানে উদ্দিপ্ত হয়ে রাস্তায় বের হলাম। পড়ার মোড়ে হঠাৎ সুমন্তকে দেখা গেল। সে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। পড়ালেখার ব্যপারে সুমন্তের খুব নামডাক; কাউকে কিছু বলতে হলেই মুরুব্বীরা সুমন্তকে দেখিয়ে দেয়।
রুমির বড় চাচা তো সেদিন আমাদের কয়েক জনকে কি অপমানটাই না করলো। তাও আবার স্কুলের সামনে। হঠাৎ সামনে পড়া মাত্রই উপদেশ দেয়া শুরু করেছিলেন, ‘পড়ালেখা তো করবি না, বড় হয়ে কি করবি? ঘোড়ার ঘাস কাটা ছাড়া তো আর কিছুই পারবি না; আর ঐ দিকে শৈলেন বাবুর ছেলে সুমন্তকে দেখ, ক্লসে কোনদিনও দ্বিতীয় হয় নাই।’
সুমন্তের জন্য বারবার অপমান হওয়ায় আমাদের মনে ওর প্রতি একটা তীব্র ক্ষোভ কাজ করছিল, মনে মনে ওর উপর গালাগালির ঝড় বইয়ে দিতাম, কিন্তু আজ সেটা প্রকাশ্যে রূপ নেয়ার সুযোগ এসে গেল। ‘ব্যাটা মালাউন, তোর এতো পড়ালেখার কি দরকার?’
সিরাজুল এগিয়ে গিয়ে পথ আগলে দাড়ালো। ভঙ্গিটা এতোটা আক্রমণাত্মক ছিল যে একা সুমন্ত নয়, আমিও ভড়কে গেলাম। মনে হলো এই বুঝি সিরাজুল ওর চেহারা মোবারক পাল্টে দেয়। কিন্তু তা আর হলো না, সুমন্তকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘হিন্দুস্থানে কবে যাবি?’
ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অবস্থায় সে প্রশ্নটা ঠিক বুঝলো না। সে জবাব দিলো, ‘কই আমার তো কোথাও যাওয়ার কথা নাই।’
সিরাজুল অবাক হওয়ার ভান করে, কপট অভিনয় করে বলে, ‘কেন, তোরা তো গুষ্টিসহ সবাই ইন্ডিয়ার সাপোর্টার, তাইলে হিন্দুস্থান যাবি না কেন?’
সুমন্ত এবার একটু ধাতস্থ হলো, সে বুঝতে পারলো যে আমরা তাকে আসলে ফাঁদে ফেলেছি। আমার দিকে কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো; হয়তো ভাবছে আমাকেও সে এই রূপে দেখবে তা আশা করেনি। আমি অবশ্য এসব আমল দেই না, আসল কথা হলো জিহাদ। জিহাদ করার জন্য আত্মত্যাগ করতে হয়, কুরবানি দিতে হয় জীবনের চাওয়া-পাওয়াকে। ত্যাগ চাই মার্সিয়া ক্রন্দন চাই না; সারা জাহানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিধর্মীদের আগে ধ্বংস করতে হবে। ধ্বংস করতে হবে ওদের সব কিছু, ওদের শেষ আশ্রয়টুকুও। তাই সুমন্তের মায়াভরা চোখ দুটো আমাকে আরও কঠিন হতে বাধ্য করলো।
এইবার সালেহি মুখে শ্লেষমাখা হাসি নিয়ে বললো, ‘এইটা তো মুসলমানদের দেশ, তোদের দেশ তো ইন্ডিয়া। সে জন্যই তো ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচের দিনে তোরা ঐ রেন্ডি গাছের সাথে ইন্ডিয়ান পতাকা উড়াইছিলি। ঠিক কি না?’
‘তোরাও তো পাকিস্তানের পতাকা উড়াইছিলি’
‘উড়াইছি। পাকিস্তান তো মুসলমানদের দেশ, বাংলাদেশও তো মুসলমানদের দেশ। হিন্দুদের দেশ তো হিন্দুস্থান।’ সালেহি পাল্টা জবাব দেয়।
সুমন্ত এবার একটু ঢোক গিলে; তারপর বলে, ‘ এই দেশ আমাদের দেশ। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা, এই দেশের জন্য সে যুদ্ধ করছে। সেইটা তো তোরা জানিস।’
‘জানি জানি, মুসলমানদের দুই ভাগ করে তোরা শালা মালাউনের বাচ্চা বহুত ফায়দা নিয়েছিস।’
সুমন্ত একথা শুনে খানিক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকলো। ও ভাবতেই পারছিল না যে বর্তমান সময়েও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা এরা কিভাবে করে? সিরাজুল কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলেছিল, কিন্তু কিছুই বলল না। সে দূরে মাদ্রাসার গলির দিকে কাকে যেন খুঁজলো।
এমন সময় পাড়ার মোড়ে পল্টুদাকে দেখা গেল। সিরাজুল কয়েক পা পিছিয়ে গেল, সালেহিও আর কোন উচ্চ-বাচ্য করলো না। অবস্থা বেগতিক দেখে আমিও কেটে পড়লাম। এ যাত্রা সুমন্ত বেঁচে গেল, কিন্তু সব সময়তো আর পল্টুদা ওকে রক্ষা করতে পারবেন না।
পল্টুদা সম্ভবত চা পানের জন্য বাজারে যাচ্ছেন। নাটকের মানুষ, নাটক আর গান-বাজনা নিয়ে মেতে থাকেন। বিষয়টা মুরুব্বী মহলে তেমন প্রশংসার না হলেও কেউ তাঁকে ঘাঁটায় না। সালেহির কাছে শুনেছি, পল্টুদা নাকি কম্যুনিস্ট, আল্লা-খোদা মানে না।
সিরাজুলের বাবা মওলানা সাহেব, বিড়াট বুজুর্গ ব্যক্তি। তিনি বলেছেন, ‘আইয়ুব শাহী আমল ছিল সত্যিকার ঈমানদারদের জন্য শাসন ব্যবস্থা, তখন এইসব কমু্যুনিস্ট মুখ দিয়ে টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারতো না। আর এখন এদের অত্যাচারে ঈমাণ রক্ষা করাই মুস্কিল।’
সিরাজুল, সালেহির সাথে আমরা ঐদিন রাতেই প্রথম জিহাদে অংশগ্রহণ করি। সেটা ছিল সত্যিকার রোমাঞ্চকর এক অভিযান। সুমন্তদের বাড়ির টিনের চাল পর্যন্ত দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া হয়েছিল। আর ওদের বাড়ির পাশের মন্দিরটা, সেটার যে কি হাল হয়েছিল তার বর্ণনা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। একটা পত্রিকায় ছবিটা ছাপা হয়েছিল, পারলে দেখে নিয়েন।
আর হ্যাঁ, সুমন্তরা আর থাকেনি। অবশেষে তারা নিজের দেশ হিন্দুস্থানে চলে গেছে।