কানাই থেকে দেবদাস পর্যন্ত বাঙালি নায়কের হাতে কোন কাজ নেই, নেই কাজ তো খই ভাজ। নায়কের একমাত্র কাজই হলো নায়িকাকে জিতে নেয়া। নায়িকাও যেন কেবল পটের বিবি, তার কোন প্রজ্ঞা বা ধী শাক্তির পরিচয় থাকে না; থাকে কেবল ছলাকলা। অবশ্য সমাজে তেমন ধী শক্তি নিন্দাজনক। এ ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে খনার নামটি ঝিলিক দিয়ে উঠে মিলিয়ে যায়। সমাজে খনা প্রশংসিত হয় তার বচনে, কিন্তু আদর্শ নারী হিসেবে নয়।
আমাদের নাটক, সিনেমায়, গল্পে-উপন্যাসের নায়কেরা সত্যিকার অর্থে কোন কাজ করে না, তাদের সামনে রূপকল্প কেবল লটারীর ভাগ্য। হঠাৎ করে বড়লোক বা ধনী হওয়া। সে উদ্দেশ্যই যেন সব সময় গরিব নায়ক জিতে নেয় ধনীর দুলালী নায়িকাকে। আর প্রমান করতে থাকে আসলে সে নায়িকাকেই ভালবাসে তার বাপের টাকাকে নয়। সংলাপও তেমনি থাকে, নায়ক নায়িকার বাবাকে চিৎকার দিয়ে বলে,
’চৌধুরী সাহেব, আমি আপনার টাকা পয়সা চাই না, আমি কেবল আপনার মেয়েকে ভালবাসি, ওকেই চাই।’
কি অনুভূতি! কি উপস্থাপনা! আহ! বাঙালি দর্শক মুগ্ধ হয়ে যায়। আমাদের পরিবারের ছেলেরা সেই নায়কের মতো হতে চায়, মেয়েরা চায় তেমনি এক স্বপ্নের পুরুষ। অন্য ”লচিত্রে এর উল্টো হয়, নায়ক থাকে ধনীর একমাত্র পুত্র আর নায়িকা থাকে বস্তির মেয়ে। এক সেন্টিমেন্টাল ড্রামা। নায়ক তার সমস্ত বৃত্ত ভেঙে বস্তি থেকে নায়িকাকে নিয়ে তোলে রাজপ্রাসাদে, আর কি অলৌকিক গুণে নায়িকা শিখে নেয় আভিজাত্যের সমস্ত অনুসঙ্গ।
আমাদের বাঙালি পরিবারের মেয়েরা তাদের স্বপ্ন বুনতে থাকে এমনই এক জীবনের। এদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠির সামনে জীবনের লক্ষ্য বেধেঁ দেয়া হচ্ছে এই আদর্শ নায়ক কিংবা নায়িকাদের জীবনালেখ্য নির্মাণ করে। এই নির্মাণও হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার ফসল। সেই রাজ-রাজাদের আমল থেকেই বাঙালি জনসমাজ হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে। সেটা রূপকথার গল্পেও যেমনি, লোককাহিনীতেও তেমনি; আর আধুনিক সাহিত্যে সে এতোটাই বিভ্রান্ত যে, তাতে নৈতিকতার লেশ থাকে না। সেখানে নায়ক হয়ে ওঠে সমাজ বিরোধী, সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি, ডাকাত এবং খুনে বদমায়েশ। এভাবেই সে প্রথম জীবনে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে শেষে ভাল হয়ে যায়। সেই যে গল্প আছে না নিজাম ডাকাতের সেই জীবনটা আমাদের জন্য রোল-মডেল হয়ে উঠেছে।
এখন কর্মের মাধ্যমে বাঙালি মধ্যবিত্ত নতুন জীবন সন্ধান করে না, সে ন্যায় ধারনাকে পাল্টে ফেলেছে ধনতন্ত্রের স্বপ্নে। মুখে বাঙালির সর্বহারাদের শ্লোগান, বৃত্ত ভাঙার বাসনা, শ্রেণিভেদ সে যেন মানতে চায় না; তাই ধনী বা বৃত্তশালীদের গালাগাল করে উঠতে বসতে। কিন্তু মনের মাঝে তারও বাসনা জাগে ’’হঠাৎ যদি ধনী হতাম’’ অথবা ’’একটা যদি দাও মারতে পারতাম’’। এবং তা হলে কি করতেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা জটিল, সেটার সব শেষ কথা হলো ’’তবে বসে বসে খেতাম’’।
অর্থাৎ এদেশের মানুষের জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় একটাই, সেটা যে কোন মুল্যে টাকা অর্জন। অর্থাৎ অঢেল টাকা থাকলে কোন কাজ করতে হবে না।
নায়িকার ক্ষেত্রে কি বলি আমরা? সে কি রাধা হয়ে উঠবে? না রাধাকে পছন্দ করে প্রতিটি পুরুষ কিন্তু নিজের বউকে কেউ রাধা ভাবতে চায় না, তেমনি কৃষ্ণকে পছন্দ করে সব মেয়েরা কিন্তু কেউ চায় না তার স্বামী কৃষ্ণের মতো হোক। তবে রাধা-কৃষ্ণ বাংলার আপামর নারী পুরুষের প্রেমের আদর্শ হয়েও জীবনের আদর্শ হয় নি। কেননা আমাদের সমাজ প্রেমকাহিনীতে মন্ত্রমুগ্ধ হলেও প্রেমের স্বীকৃতি দানে বাকরুদ্ধ। দেবদাস-পার্বতী হোক আর আমাদের সাধারণ পরিবারের কোন মেয়ে হোক আমরা খুঁজি এমন এক নারীকে, যে স্ত্রী হিসেবে হবে দমদেয়া পুতুলের মতো। এবং সেই পুতুল কেবল হাসবে, নাচবে, গাইবে এবং যৌনানুভুতি জোগাবে। তারপরও তারা থাকবে স্বামীর পদতলে, এবং পর্দানশীন। এ ভাবেই আমাদের নায়িকারা নিজেদেরকে চলচিত্রের ভেতরে উপস্থাপন করে, আর আমাদের নারী সমাজও তাই অনুসরণ করে এবং মনের আকাশে স্বপ্নের রাজপ্রাসাদে রাজপুত্তুরের সাথে থাকে। সেখানে বাস্তবতায় আমাদের সমাজ অকার্যকর হয়ে পড়ে।
এসব কারণেই আজ রোল-মডেল নিয়ে নতুন কিছু করতে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিব্যবসায়িদের দায়িত্ব নিতে হবে, কারণ দায়ী কিন্তু তারাই।