মাঘ মাস শেষের দিকে প্রায়। হাড় কাপানো শীত চলছে, সকালে ঘন কুয়াশা। সবমিলিয়ে শীতকাল বলতে যা বুঝায়। এইতো দু’দিন আগে পাশের গ্রামে একটা বিয়ে হয়েছে আজ তৃতীয় দিন, কন্যা পক্ষ্য এসেছে ‘নায়র’ নিতে। প্রতিদিন আমি লক্ষ রাখতাম ঐ বাড়ির সকলের চালা ফেরা কে কখন কোথায় কি করছে। যে বিষয়টা আমার চোখে বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে সেটা হল ঃ
কেউ এই দু’দিন কাজের ঝামেলায় ঠিকমত ঘুমাতে পারেনি, আর সেটাই মূলত আমি চাচ্ছিলাম।
রাত বাড়ছে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আড়াইটা বাজে এই সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। অন্য দিনের চেয়ে আজ শীত একটু বেশি পড়ছে কিন্তু আমি হাল ছাড়ার পাত্র নই।
সমস্ত শরীরে ভাল করে সরিষার তেল মাখালাম,এমন ভাবে মাখালাম যাতেকরে ছাই মাখিয়েও আমাকে আটকে
রাখাযাবেনা।
আমার ধারনা কোণার ঘরটাতেই বর ও বৌ ঘুমিয়ে আছে এবং গত দু’দিন তারা ঐ ঘরটাতেই ঘুমিয়ে ছিল।
চারিপাশে টিনের বেড়া দোচালা ঘর, গ্রামের সব গুলো ঘরই প্রায় টিনের বেড়া ও টিনের চালা শিদ কেটে ঢুকতে মোটেও অসুবিধা হবে না।
ঘরের কাছে গেলাম উত্তর কোণাটায় একটা গাদা ফুল গাছের ঝাড় ছিল, ওটার আড়ালে বসে শিদ কাটলাম
ভিতরে প্রবেশ করব তাই গাছ থেকে একটা ফুল ছিড়লাম এবং ঘরের ভিতরে প্রবেশ করালাম যাতে করে কোন কিছু থাকলে আঘাত করে। যাই কিছু থাকনা কেন আঘাত করলে হাতের উপর দিয়ে যাবে।
কিন্তু না
কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। ঢুকে পড়লাম ঘরের মধ্যে।
খুব অন্ধকার কিছু দেখাযায় না। খুজতে লাগলাম আলমারিটা কোথায় আছে। মনে মনে খুব ভয় করছে যদি ধরা পরে যাই।
মনকে সামলে নিলাম।
খাটের কাছে গেলাম, চাবিটা কোথায়?
হঠাৎ, লাইট জ্বলে উঠল, লাফদিয়ে যে পালিয়ে যাব তার কোন উপায় নেই, গর্তটা যে দিক করেছিলম আমি তার বিপরিতে। লোকটা বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো ।
ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে। ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়েসের, বেশ ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে অনেকটা বেদেনার মত।
দেখে মনে হল এবাড়ির কোউনা কারন এবাড়ির সবাই কে আমি গত দু’দিন ধরে ভাল করে চিনে রেখেছি।
হয়তো কন্যা পক্ষের কেউ ‘নায়র’ নিতে এসেছে। কিন্তু এ ঘরে তো বর ও বৌর থাকার কথা ছিল।
কিন্তু নেই!
যাক ভালই হল।
ঘুম ঘুম চোখে মেয়েটি বলল কে?
আমিতো পালাতে পারছিনা, গর্তটা বেশ দূরেই। হাতে সেই ফুলটা এখোন আছে।
সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফুলটা এগিয়ে দিলাম তার দিকে আর বললাম-
আমি..
মানে - আমি তোমাকে ভালবাসি।
কাথাটা শুনে মেয়েটি যেন আমার চেয়ে বেশি কাঁপতে লাগলো।
তখন মেয়েটি বলল - আপনাকে তো চোরের মত দেখায়
দেখুন, চোর হলে তো পালিয়ে যেতাম। আসলে হয়েছে কি ! আপনার সাথে দেখা করার এটা একটা কৌশল মাত্র। আপনাকে খুব বেশি পছন্দ হয়েছে তো তাই (মুচকি হেসে)। তাছাড়া আজ সারাদিন অনেক ঘুরা ঘুরি করেও মনের কথাটি আপনাকে জানাতে পারিনিতো তাই এভাবে আসতে হল।
তখন মেয়েটির ভাব দেখে মনে হল ওকে যেন ব্যপারটা বিশ্বাস করাতে পারলাম। মৃদু হেসে মেয়েটি বলল ঃ
আপনার কৌশলটা মোটেও ভালনা। এতো রাতে একটা মেয়ের ঘরে একটা পুরুষ থাকার মানে আপনি বুঝেন?
বুঝব কিভাবে?
এর আগে তো কোন মেয়েকে এতো রাতে প্রেম নিবেদন করতে আসিনি।
থাক আপনাকে আর প্রেম নিবেদন করতে হবে না। আপনি এখন যান।
আমার ফুলটা নেবেনা?
ওটা টেবিলের উপর রেখে যান।
আচ্ছা, আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে।
দেখুন আপনি এখন এখান থেকে যান।
আমি চলে গেলে জানব কিভাবে আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে কি না?
ঠিক আছে কাল বিকালে পুকুর পাড়ে আসবেন।
ঠিক আছে তাহলে যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম সেদিক দিয়ে বেরিয়ে যাই, গর্তটা বুজিয়ে দিয়েন এখনি।
বাইরে এসে হাফ ছেড়ে বাগানের ভিতরে বসলাম শরীর দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ছুটছে এটাযে শীত কাল আমার মনেই হচ্ছে না। শরীর এখনো কাঁপছে।
বসে বসে ভাবলাম মেয়েটি কি আমাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিল? নাকি সত্যি সত্যি আমাকে তার ভাল লেগেছে।
না, আসলে আমি চোর আমাকে ভাল লাগার কোন প্রশ্নই ওঠেনা।
নিজেকে পাগল বলে মনে হচ্ছিল নিজের।
আচ্ছা আমি কি সাড়া জীবন এভাবেই চুরি করে যাব? অমন ষোড়শী কন্যা ! আমি চোর না হলে তাকে জীবন সাথী হিসাবে পেতে পারতাম। কিন্তু সে যখন জানবে আমি চোর তখন সে আমাকে ঘৃণা করবে। আসলে ঐ মেয়ের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ । আমি যা ভাবছি সে গুলো কখনই সম্ভব নয়। আসলে মেয়েটি মূলত বিয়ে বাড়ির সম্মানর্থে আমাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, তাই ওকে নিয়ে আমার এতো চিন্তা। যদি ধোলাই দিতো তাহলে চিন্তা গুলো মাথায় আসতো না।
তারচেয়ে বরং এখন বাড়ি যাই।
পরদিন বিকালে আমি তো হতবাক! মেয়েটি এক গোছা গোলাপ নিয়ে পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে আছে।
নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না তাই পাছায় চিমটি কেঁটে দেখলাম, মনে হচ্ছে ব্যাথা পেলাম না আসলে হয়েছে কি বিভিন্ন জায়গাতে গনধোলাই খেতে খেতে শরীরে ব্যাথা অনুভব করিনা। তাই একটা গাছে ঠিল মেরে দেখলাম লাগে কি না
দেখলাম লেগেছে।
বুঝলাম ব্যাপারটা সত্যি! কিন্তু তার কাছে যাব কি ভাবে গতকাল রাতের ছলনার ভালবাসাটা যেন সত্যিকারের ভালবাসায় রুপ নিতে লাগল। এসব কথা ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেল। আজ আমি তার ভালবাসা পেলেও সে যেদিন জানবে আমি চোর সেদিন কোথায় যাবে এই ভালবাসা। নিজের বিবেকটা নিজেকে বাধা দিলো যেতে পারলাম না ওর কাছে, দূর থেকে দাড়িয়ে দেখলাম খোপাতে আমার দেওয়া গত রাতের সেই গাদা ফুলটি আর হাতে গোলাপ ফুল।
নিশ্চই আমাকে দিতে এনেছিল। সন্ধা পর্যন্ত মেয়েটি আপেক্ষা করতে করতে চলে গেল। আমার দু-চোখ গড়িয়ে দুই ফোটা জল বেরিয়ে এলো। এই জীবনে আমি অনেক পিটুনি খেয়েছি কিন্তু আমার চোখে কখনই জল আসেনি। কিন্তু এ কেমন আঘাত যা শরীরের কোথাও লাগেনি কিন্তু জল বেরিয়ে এলো। সেদিনের পর থেকে আমি আর কোন দিন চুরি করিনি। শুধু এক গোছা লাল গোলাপের জন্য। তারপর থেকে ঐ মেয়েটিকে ওবাড়িতে আর কোন দিন আসতে দেখিনি। পরে জানতে পারলাম সে কন্যের চাচাত বোন ‘নায়র’ নিতে এসেছিল।
শুধু মনে হল চুরি করা ভালবাসা চোরের মতই পালিয়ে গেল।