টানা তিন দিনের নানামুখী নাটকীয়তায় শেষ পর্যন্ত ভেস্তেই গেলো তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ও ট্রানজিট বিষয়ে সম্মতিপত্র সই পরিকল্পনা। এমনকি এসব চুক্তির সুনির্দিষ্ট রূপরেখা পাওয়া যায়নি উভয় দেশের সরকার প্রধানের বৈঠকেও।
বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের আরো একদিন বাকি থাকলেও মূলত রুটিন কর্মসূচিতেই কেটে যাবে বাকি সময়। এতে এসব চুক্তির পরিবর্তিত সময় ও সম্ভাবনা নিয়ে তৈরি হওয়া অস্পষ্টতা যেমন আরো ঘনীভূত হয়েছে, তেমনি গত তিন দিনের ঘটনা প্রবাহের রেশ ধরে আগামীতে আরো নাটকের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এ সফরে উভয় দেশের মধ্যে ৩ চুক্তি, ৭ এমওইউ ও ১ প্রটোকল সই হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সে পরিকল্পনা ঠিক থাকেনি।
প্রথম দিকে বিষয়গুলো সব ঠিকঠাকই এগুচ্ছিলো। কিন্তু মনমোহনের সফরের মাত্র দুদিন আগে গত রোববার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মততা ব্যানার্জি তার রাজ্যের স্বার্থের ধুয়ো তুলে বাংলাদেশ সফর বর্জন করায় সরল পথ হঠাৎ করেই জটিল হয়ে ওঠে। শুরু হয় টান টান নাটক।
গত দুতিন দিন ধরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে বলে এই আশা জাগানিয়া খবর আসে, আবার পরমুহূর্তেই অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় চাপা পড়ে যায় সম্ভাবনা। শেষ পর্যন্ত পিছিয়েই যায় পানি ভাগাভাগির পরিকল্পনা।
এদিকে ড. মনমোহন সিংয়ের এ সফরে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে গত ৪ সেপ্টেম্বরই জনিয়েছিলো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়।
একই দিন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, মনমোহনের সফরে ৩ চুক্তি, ৭ এমওইউ ১ প্রটোকল সই হবে। এছাড়া চুক্তিতে সীমান্ত সংকট সমাধান, পানি বণ্টনের বিষয়গুলোও থাকছে।
কিন্তু ওই রাতেই উভয় সরকারে অস্থিরতা শুরু হয় কলকাতা থেকে আসা এক খবরে।
জানা যায়, সন্ধ্যায় মহাকরণে জরুরি বৈঠক ডেকে বাংলাদেশ সফর বর্জন করেছেন মমতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হচ্ছেন না পশ্চিমবঙ্গের এই মুখ্যমন্ত্রী।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে পশ্চিমবঙ্গ বঞ্চিত হচ্ছে। বেশি পানি দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে।
এ সময় কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি অবহেলারও অভিযোগ তোলেন তিনি।
সফরের আগে আগে বেঁকে বসা মমতাকে গলাতে শুরু হয় নানামুখী দৌড়ঁঝাপ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন কংগ্রেসের ড্যামেজ কন্ট্রোলার খ্যাত অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। মনমোহনের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা বলেন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশও।
এছাড়া ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন মমতাকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে বলেন, আগে চুক্তিটা হয়ে যাক। তারপর আপনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে আপনার আপত্তির কথা জানাবেন।
সূত্রমতে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকেও ফোনে যোগাযোগ করা হয় মমতার সঙ্গে।
কিন্তু চুক্তি তো দূরের কথা, স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য মনমোহনের সফরঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশে আসতেও রাজি করানো যায়নি মমতাকে।
যদিও ওই রাতেই ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, মমতা না এলেও তার কোন প্রভাব পড়বে না মনমোহনের সফরে।
এ পরিস্থিতিতে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে নানা কথা শোনা গেলেও আসলে কে কতো পানি পাচ্ছে রোববারই তা জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে।
জবাবে দীপু মনি বলেন, দুই দেশেরই লাভ হবে এমন হিস্যাই বিবেচনায় রয়েছে। সুনির্দিষ্ট কত পরিমাণ পানি কে পাচ্ছে, সে ঘোষণা দুই প্রধানমন্ত্রীই দেবেন।
কিন্তু এর পরদিন সোমবারই জানা যায়, তিস্তার ৭৫ শতাংশ পানি দাবি করেছেন মমতা।
নিজে তো আসছেনই না, এমনকি তার রাজ্যের পানিসম্পদমন্ত্রী মানস ভূঁইয়াকেও ঢাকা আসতে দিচ্ছেন না মমতা।
এ পরিস্থিতিতে সোমবার বিকেলেই পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস বলেন, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছে পানি চুক্তি ও মমতার বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে এ চুক্তি হচ্ছে না বলেই যখন ধরে নেওয়া হলো, তখন আবারো স্রোতের গতি পাল্টে দিলেন দীপু মনি।
সোমবার রাতে তিনি জানালেন, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হচ্ছে।
মনমোহনের সফরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি অনিশ্চিত বলে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব রঞ্জন মাথাই এর দেওয়া বক্তব্যের ৫ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই তিনি বললেন, মনমোহনের সফরেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হচ্ছে, আপনার অপেক্ষা করেই দেখুন।
তিনি আরো বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তিপত্রে যা লেখা হয়েছিল তা অপরিবর্তিত আছে। চুক্তি অবশ্যই হবে। সবার সম্মতির ভিত্তিতেই হবে।
মমতার বাংলাদেশ সফরে না আসা প্রসঙ্গে দীপু মনি বলেন, মমতা ব্যানার্জি না এলেও চুক্তি হবে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দীপু মনির ওই বক্তব্য অসার হয়ে ওঠে। এ সফরে তো নয়ই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আদৌ কবে হবে তা নিয়েই তৈরি হয় অনিশ্চয়তা।
বস্তুত তিস্তার খসড়া চুক্তি অনুযায়ী শিলিগুড়ি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ভারতের গজলডোবা পয়েন্টে তিস্তায় প্রবাহিত পানির পরিমাণ হিসাব করে দেশের মধ্যে পানিবণ্টন হওয়ার কথা। ৪৬০ কিউসেক হারে পানির সঞ্চয় রেখে বাকি পানির ৫২ শতাংশ ভারত ও ৪৮ শতাংশ বাংলাদেশের পাওয়ার কথা।
ভারতের উত্তরপূর্বের হিমালয় সংলগ্ন সিকিমের সো-লামো হ্র্রদ থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এই তিস্তা।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ১২৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তা মিশেছে গাইবান্ধা জেলার উত্তর-পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদে।
কিন্তু বছর খানেক ধরে যৌথ নদী কমিশনের দফায় দফায় বৈঠকে প্রস্তুত হওয়া এ নদীর পানি চুক্তি পরিকল্পনা হঠাৎই অনিশ্চিত হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা সদস্য আবু হাশিম খান চৌধুরীর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশকে মাত্র ২৫ শতাংশ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিবশংকর মেনন।
এ বক্তব্যের পর দারুণ অসন্তোষ তৈরি হয় ঢাকায়। সেই অসন্তোষ সামলাতে ঢাকায় ঝটিকা সফর করেন শিবশঙ্কর মেনন।
বাংলাদেশ পক্ষকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, দিল্লির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪৮ শতাংশ পানিই দেওয়া হবে বাংলাদেশকে।
মেননের এ সফরের পরপরই মমতার আপত্তিতে পানি চুক্তি ভেস্তে যায়। পরিবর্তে বাংলাদেশকে মাত্র ১২ শতাংশ পানি দেওয়ার প্রস্তাব দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তার এ প্রস্তাবে ভেস্তে যায় ফেনী নদীর পানি বণ্টন চুক্তিও।
একই কারণে ছিটমহল ও তিনবিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা বিষয়ক চুক্তিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
এ পরিস্থিতিতে মমতার মন রক্ষায় ঢাকা আসার আগে তাকে আশ্বস্ত করেন মনমোহন। মমতাকে তিনি জানান, বাংলাদেশে তিনি এমন কিছু করবেন না যা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কোনো ক্ষতির কারণ হবে।
এদিকে মঙ্গলবার মনমোহনের সঙ্গে ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী পবন কুমার বানসাল না আসায় তিস্তাচুক্তি না হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। ভেস্তে যায় ঢাকায় অনুষ্ঠেয় যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক।
এদিকে মঙ্গলবার বহুল আলোচিত তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির অনিশ্চয়তা প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার রজিত মিত্রকে মঙ্গলবার দুপুরে জরুরি বার্তায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশ। তাকে জানিয়ে দেয়, তিস্তার পানি চুক্তি না হলে ভারতকে ট্রানজিটই দেবে না বাংলাদেশ। উপরন্তু একই দিন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এখনই ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা সময় নেব, তাড়াহুড়ো করব না। এ প্রসঙ্গে গত রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে কোনো ট্রানজিট চুক্তি সই হবে না। একটি সম্মতিপত্র সই হবে। ওই বক্তব্যেরই রেশ টেনে অর্থমন্ত্রী বলেন, ট্রানজিট চুক্তি যে সই হবে তা উল্লেখ থাকবে সম্মতিপত্রে।
এদিকে বরাবরই তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে আশা জাগানিয়া বক্তব্য দিয়ে আসা দীপু মনি মঙ্গলবার বিকেলে ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কোন কথাই হয়নি মনমোহনের সঙ্গে।
সবশেষ সন্ধ্যায় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকেও এ বিষয়ক কোন অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক শেষে জানা যায়, পানি ও ট্রানজিট নিয়ে চুক্তি হয়নি। তবে ভারতে ৪৬ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে।
মনমোহনের সফরের আরো এক দিন বাকি থাকলেও বাকী সময়টা বস্তুত রুটিন কর্মসূচিতেই কেটে যাবে। তাই এ সফরে তিস্তার পানি বণ্টন ও ট্রানজিট চুক্তি হচ্ছে না। আগামীতে এসব ইস্যু কোন নাটকীয়তায় মোড় নেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র: বাংলা নিউজ ২৪
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৪:৩৯