০৯ নভেম্বর'২০১১ইং সকাল বেলা। সবে মাত্র যাত্রা শুরু করলাম। ঘড়িতে সময় তখন সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট। ঈদের ছুটি থাকায় রাস্তা-ঘাট ছিল ফাঁকা। তাই পথে কোন জট পড়লো না। গাড়ি ছুটে চলেছে প্রাকৃতি নৈসর্গে ভরা মহামায়ার দিকে, সামনের দিকে চলছেই আর চলছে। এরইমধ্যে আড্ডা শুরু হয়ে গেল একে অপরের সাথে। সাথে চললো প্রিয় সানি ভাইয়ের মজার মজার সব জোক্স। সানি ভাই আমাদের মাঝে সবচেয়ে সিনিয়র, কিন্তু সবার সাথে উনার সুন্দর সম্পর্ক। যদিও আমাদের মাঝের সব সিনিয়র-জুনিয়রদের সাথে সবারই খুবই ভালো ও সুন্দর সম্পর্ক রয়েছে।
যাওয়ার পথে ভাটিয়ারীতে কিছু হালকা নাস্তা নেয়ার জন্য থামলাম। আমাদের সাথে যখন বন্ধু রানা ও ছোট ভাই আলম ছিল তখন এই নাস্তা কেনার কাজটি তারাই সম্পন্ন করলো। ছোট ভাই আলম একজন আন্তরিক মন-মানসিকতার ছেলে। যে কোন কাজ আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করে সে। ভাটিয়ারীতে ১৫ মিনিটের মত বিরতি করে আবারো যাত্রা শুরু করলাম মহামায়ার দিকে।
মহামায়া লেক
যে মহামায়ার উদ্দেশ্য আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে সে মহামায়া সম্পর্কে ব্লগার ও পাঠকদের কিছু বর্ণনা দিই। এটি মূলত একটা সেচ প্রকল্প এবং কাপ্তাই লেকের পরে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম লেক। প্রকল্পটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধাণে পরিচালনাধীন। এটি চট্টগ্রাম জেলার প্রবেশদ্বার মিরসরাই উপজেলার ৮নং দুর্গাপুর ইউনিয়নের ঠাকুরদিঘী বাজারের প্রায় দেড় কিলোমিটার পূর্বে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। প্রকল্পের পুরো নাম- মহামায়া ছড়া সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্প। ২০০৬-০৭ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০০৯-১০ অর্থবছরে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ২৬ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা।
আকাশ পানে তাকিয়ে রয় বৃক্ষ
এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে লেক, পাহাড়, ঝর্ণা ও রাবার ড্যাম। লেকের আয়তন ১১ বর্গ কিলোমিটার। লেকে চাইলে আপনি সাতার কাটতে পারেন এবং ইঞ্জিন চালিত নৌকায় চড়তে পারেন। সাতার কাটার সময় তীরের আসে-পাশে থাকা ভালো। কারণ লেকের পানি সাধারণত ভারী হয়ে থাকে, যার ফলে যে কেউ সামান্য সাতার কাটার পর দুর্বল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এই প্রকল্পের এলাকায় যে পাহাড়ি ঝর্ণা রয়েছে সেটিতে আপনাকে ইঞ্জিন চালিত নৌকার সাহায্যেই যেতে হবে। ভাড়া গুনতে হবে জনপ্রতি ৪০ টাকা (যাওয়া-আসা)। সংখ্যায় যদি বেশি থাকেন তাহলে একেবারে যাওয়া-আসার জন্য রিজার্ভ ভাড়া করা ভালো। এক্ষেত্রে ভাড়া গুনতে হবে প্রায় ৪০০-৪৫০ টাকা। সময় বেশি লাগেনা, যাওয়া-আসায় ২৫-৩০ মিনিটের মত লাগে। এককথায় বলতে গেলে যারা লেক, পাহাড়, ঝর্ণা এই তিনটি একসাথে ভালবাসেন তাদের জন্য একটা আদর্শ জায়গা এই মহামায়া প্রকল্প। অর্থাৎ মহামায়া একটি সেচ প্রকল্প হলেও এতদ অঞ্চলের আকর্ষণীয় পর্টযন স্পট হিসেবে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে এটি।
ঝর্নার দিকে এগিয়ে চলছে আমাদের ভাড়া করা ইঞ্জিন চালিত নৌকা
ঝর্ণার ঠান্ডা পানি গড়িয়ে পড়ছে তার গন্তব্যের দিকে
যা হোক, এবার আসি আমাদের ভ্রমন কাহিনীতে। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২ ঘন্টা লাগে এই মহামায়াতে পৌঁছতে। ঘড়িতে সময় যখন প্রায় ১১টা তখন আমরা পৌঁছলাম মহামায়ায়। এর আগে যদিও এই জায়গাতে আমার ২ বার আসা হয়। সেখানে পৌঁছে যাওয়ার পথে কিনে নেয়া হালকা নাস্তা সেড়ে নিলাম সবাই। তারপর শুরু হলো ছবি তোলার পর্ব। যে যার মত পারলাম ছবি তুললাম। প্রকল্পের মধ্যে থাকা পাহাড়ে চষে বেড়ালাম। পাহাড়ে ঘুরাঘুরি শেষ করে ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করে রওনা দিলাম পাহাড়ী ঝর্ণা দর্শনে। ১৩ মিনিটেই পৌঁছে গিয়েছিলাম ঝর্ণার স্থানে। গত ২ বারের চেয়ে এবারের ঝর্ণার স্থানটি বেশ ঝুকিপূর্ণ মনে হলো। তাই আমরা কয়েকজন ঝর্ণার মূল স্থানে গেলাম না। যদিও আমাদের বেশ কয়েকজন তাদের অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণে ঝর্ণার মূল জায়গা এমনকি উৎপত্তিস্থল খুঁজতে গিয়ে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যায়। যদিও পরবর্তীতে তারা আমাদের মাঝে ফিরে এসেছিল। ঝর্ণা দর্শন শেষে আমরা ফিরে এলাম লেকের তীরে। লেকের তীরে পৌঁছার পর দুপুরের খাবারের জন্য আমরা গেলাম মিরসরাইয়ের বারৈয়ারহাটে।
মুহুরী প্রকল্পের বাঁধ
বারৈয়ারহাট থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা হলাম মিরসরাইয়ের আরেক পর্যটন স্পট মুহুরী প্রকল্পের উদ্দেশ্যে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বাজার থেকে ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে মুহুরী সেচ প্রকল্প। চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার কিয়দাংশ এবং ফেনী জেলার ফেনী, সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার কিয়দাংশের সর্বমোট ৪০,০৮০ হেক্টর (গ্রস) জায়গা জুড়ে এই প্রকল্পের অবস্থান। ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছর থেকে শুরু হয়ে ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১৫৬ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বার্ষিক ৭৫,০০০ মেট্রিক টন ফসল উৎপাদন হয়। এই মুহুরী প্রকল্প এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মৎস্য জোন হিসেবে পরিচিত। এককথায় বলা যায় বাংলাদেশে মৎস্য চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছে এই প্রকল্প। দেশের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে এখানে মৎস্য প্রকল্প গড়ে তুলেছে; বসুন্ধরা গ্রুপ, মেরিডিয়ান গ্রুপ, ক্লিফটন গ্রুপ, আবুল খায়ের কোম্পানি, রিঙ্কু ফিশ প্রজেক্ট সহ প্রায় দুই হাজার মৎস্য প্রকল্প রয়েছে এখানে। বছরে মত্স্য চাষ থেকে আয় হয় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
মুহুরী প্রকল্পে নির্মিত দেশের প্রথম উইন্ড মিল
বাঁধের অপর পাশে ভরা নদী
খুবই সুন্দর একটা জায়গা এই মুহুরী প্রকল্প। যারা চট্টগ্রামের নেভালে গিয়েছেন মুহুরী প্রকল্পের প্রবেশদ্বার অনেকটা চট্টগ্রামের নেভালের মত দেখতে। এখানে এলে আপনি দেখতে পাবেন উইন্ড মিল, যা দেশে প্রথম নির্মিত। এই প্রকল্পের আওতাধীন যে বাঁধটি রয়েছে তা ফেনী নদীর উপর দিয়ে নির্মিত হয়েছে। বাঁধের একপাশে দেখতে পাবেন ভরা নদী আর অন্য পাশে দেখতে পাবেন প্রায় পানি শুন্য নদী। নদী যাদের কাছে টানে তাদের জন্য অন্যতম একটা প্রিয় জায়গা হতে পারে এটি। নৌকা করে নদীতে ঘুরে বেড়াতে পারেন চাইলে। শীতকাল চলে আসছে ধীরে ধীরে। আর এই শীত মৌসুমে মুহুরী প্রকল্পের অন্যতম আকর্ষণ সাইবেরিয়ার অতিথি পাখি। যদিও গুটি কয়েক সাইবেরিয় অতিথি পাখি আমাদের চোখে পড়েছে কারণ শীত মৌসুম এখনো পরিপূর্ণভাবে আসেনি এই অঞ্চলে।
সবাই মিলে অনেক আনন্দ করলাম মুহুরী প্রকল্প সহ পুরো ভ্রমণে। আমাদের গ্রুপের বেশ কয়েকজনের পড়াশোনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। সামনের কোন ভ্রমণে তাদের কাউকে পাওয়া যাবে না হয়ত। এছাড়া আমাদের গ্রুপটির সবাই অর্থাৎ সব সিনিয়র-জুনিয়র একে অপরের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক। তাই এই ভ্রমণটি স্বরণীয় হয়ে থাকবে অন্তত আমার কাছে। সন্ধ্যা যখন নেমে আসছিল তখন রওনা হলাম বাসার উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রামে পৌঁছে বন্ধু রানার বাসায় সবাই কিছু সময় অতিবাহিত করার পর প্রত্যেকে নিজ নিজ বাসায় চলে আসলাম। এভাবে সমাপ্তি ঘটলো সুন্দর একটা ভ্রমণের।
এক পিস রেখে দিলাম "সমতলে"।