সকাল সোয়া ৫টায় মোবাইল ফোনের এলার্মের কল্যাণে ঘুম ভাংলো। ঘুম থেকে উঠে সারাদিনের প্রস্তুতি স্বরূপ গোসল সেড়ে নিলাম একেবারে। গোসল সাড়ার পর ভাইয়ার বন্ধু লাকী ভাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললাম। তিনিও ফ্রেশ হয়ে নিলেন। এদিকে হোটেল রুমের দরজায় ভাইয়া নক করতে দরজা খুলে দিলাম। ইতোমধ্যে তিনিও প্রস্তুত হয়ে গেলেন। উনাকে রুমে বসিয়ে আমি আর ভাগ্নে প্রস্তুত হয়ে গেলাম।
সকাল সোয়া ৬টার দিকে আমরা বের হলাম বিখ্যাত ইসলাম ধর্ম প্রচারক ও সাধক হযরত শাহজালালের (রহ.) মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। হোটেল থেকে পায়ে হেঁটে মাত্র ৭ মিনিট লাগল। "হযরত শাহজালালের (রহ.) সমাধিস্থলে প্রবেশের মুখে যে মসজিদটি রয়েছে সেটি ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত আর মাজারটি নির্মাণ করা হয় ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে। হযরত শাহজালালের (রহ.) সমাধির পাশেই রয়েছে ইয়েমেনের রাজা শাহজাদ আলীর কবর এবং ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের শাসনকর্তা মুক্তালিব খান উজিরের কবর। এ মাজারে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজশাহের শাসনকালে ১৩০৩ সালে হযরত শাহজালালের হাতে এ অঞ্চল বিজিত হয়। তিনি রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। সে সময়ে তুরস্কের কুনিয়া শহর থেকে তিনি ৩১৩ জন শিষ্যসহ এ দেশে আসেন। বহু যুদ্ধে বিজয়ের পর তিনি সিলেটেই থেকে যান। ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন।" সমাধিস্থল জিয়ারত শেষে মাজারের পাশে কবরস্থানে ঢুকলাম। খুবই শান্ত-শ্লীষ্ট কবর স্থান সেটি। অনেক গুনীজনের কবর রয়েছে সেখানে। প্রথমেই ঢুকতেই চোখে পড়ল স্বাধীনতা উত্তর উপেক্ষিত বীর সেনানী আতাউল গনী উসমানীর কবর। এরপর চোখে পড়ল জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার মরহুম হারুনুর রশীদের কবর, উনার পাশে সারিবদ্ধভাবে শায়িত আছেন উনার বাবা, মা ও স্ত্রী। এরকম আরো অনেক গুনীজনের কবর রয়েছে সেখানে। তবে বেশিরভাগ পর্যটকদের মনোযোগ থাকে চিত্রনায়ক সালমান শাহ’র কবরের প্রতি। হযরত শাহজালালের (রহ.) মাজার কমপ্লেক্সের অন্যতম আকর্ষণ হল- জালালী কবুতর। সুন্দর সুন্দর অনেক জালালী কবুতর রয়েছে সেখানে।
সেখান থেকে ফেরার পথে প্রাতঃরাশ সেড়ে নিলাম। তারপর দেখতে গেলাম সিলেটের প্রথম মুসলিম ও প্রখ্যাত ইসলাম ধর্ম প্রচারক বোরহানুদ্দীন শাহ’র (রহ.) সমাধি। সেখানে গিয়ে দেখলাম উনার পাশেই শায়িত আছেন উনার স্ত্রী ও একই সাথে উনার সেই ছোট্ট শিশুটি যাকে তৎকালীন অত্যাচারী রাজা গৌর গোবিন্দের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সুরমা নদীর পাশেই তাঁদের সমাধিস্থল। সুরমা নদী দেখে খুবই অবাক হলাম। কারণ ২০০২ সালে যখন সিলেট গিয়েছিলাম তখনকার সুরমা নদীর সাথে আজকের সুরমা নদীর আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সেইবারের তুলনায় নদীর পানি বর্তমানে খুবই কম। টিপাইমুখ বাঁধ দেয়া হলে বর্তমানে সুরমা নদী যে পর্যায়ে আছে সে পর্যায়ে মোটেও থাকবেনা। বরং পানি শুন্য দেখতে হবে সুরমা নদীকে!
হোটেলে যখন ফিরলাম তখন সকাল প্রায় ১০টা। প্রায় পৌনে ২ ঘন্টা পর আবার বের হলাম হোটেল থেকে। টমটম (টেক্সির মত দেখতে তবে ব্যাটারী চালিত) ভাড়া করে সোজা ঘুরতে গেলাম পর্যটন মোটেলের পাশে পিকনিক স্পটে। পিচঢালা আঁকাবাকা পথ বেয়ে পাহাড়ের উপর উঠতে হয়। গাড়ি নিয়েও উঠা যায়। পিকনিক স্পটের প্রবেশ ফি জনপ্রতি ২০ টাকা করে। মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায় সেখানে। অনেক যুগল চোখে পড়ল যারা নীরবে নিভৃতে তাদের বিশেষজনের সাথে সময় কাটাচ্ছেন। আর আমি মাঝে মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলাদেশ বনাম নেদারল্যান্ডসের মধ্যকার বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচের খবর রাখছিলাম।
৪৫ মিনিটের মত ছিলাম সেখানে। সেখান থেকে দেখতে গেলাম সিলেটের অন্যতম আকর্ষণ মালনিচড়া চা বাগান। সিলেট ওসমানী বিমান বন্দর, পর্যটন মোটেল ও সিলেট ক্যাডেট কলেজে আসা-যাওয়া পথেই উক্ত চা বাগানটি। মালনিছড়া চা বাগানটি বাংলাদেশের প্রথম বানিজ্যিক চা বাগান যেটি ১৮৫৪ সালে ইংরেজ হার্ডসনের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো চা বাগানও বলা হয়ে থাকে। চা বাগানে প্রবেশের মুখ থেকে একজন বয়স্ক (বয়স আনুমানিক ৬০ বছর হবে) চা শ্রমিককে আমাদের সঙ্গে নিলাম যাতে চা বাগানের ভিতরে পথ চিনতে সুবিধা হয়। বাগানের ভিতর উনি আমাদেরকে বিভিন্ন গাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বাগানের মধ্যে একটি কমলালেবুর বাগানও আছে। উনার দেয়া তথ্যমতে উক্ত চা বাগানের শ্রমিকদের প্রতিদিনের গড় পারিশ্রমিক মাত্র ৪৪ টাকা! আর প্রতি সপ্তাহে প্রত্যেককে ২কেজি করে চা পাতা দেয়া হয় বিনামূল্যে। ঘুরতে ঘুরতে চা বাগানের ভিতরে পাহাড়ের উপর সুশীতল জায়গা পেলাম। সেখানে কিছুক্ষণ বসলাম। পাহাড়ের চূড়া থেকে অনেক সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে পড়ল। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। মনে হল এ যেন সবুজ কার্পেট দিয়ে ঘেরা কোন এক অঞ্চল।
চা বাগান থেকে যখন বের হলাম তখন ঘড়িতে সময় দুপুর পৌনে ৩টা। তখন অনেকটা ক্লান্ত। টমটম নিয়ে আমরা সোজা চলে আসলাম জিন্দাবাজারের পাশে জল্লার পার এলাকার দাড়িয়া পাড়ায় ‘পাঁচ ভাই রেষ্টুরেন্ট’-এ। সেখান থেকে দুপুরের খাবার সেড়ে সোজা ফিরে এলাম হোটেলে।
পৌনে ৪টার দিকে হোটেলে ফিরে আমাদের রুমে আমি, লাকী ভাই ও ভাগ্নে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ কে যেন দরজা নক করল। দরজা খুলতে দেখি রাসেল ভাই। উনি এসে ঘুমন্ত লাকী ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে দিলেন। তারপর আমরা রুমের মধ্যে আড্ডা দিতে লাগলাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম হোটেলের বাইরে মিছিল ও গাড়ির হর্নের শব্দ! মনে মনে তখন ধরে নিলাম নিশ্চয় বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয়লাভ করেছে। লাকী ভাই তৎক্ষণাৎ জিন্দাবাজার থেকে ঘুরে আসার জন্য প্রস্তাব করল। আমি আর রাসেল ভাই রাজী হয়ে যায়। হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় ভাগ্নেকে ভাইয়াদের রুমে দিয়ে যায়। জিন্দাবাজারে গিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সমর্থকদের বিজয় উল্লাস ছিল চোখে পড়ার মত। আমি নিজেও সেটা উপভোগ করেছি। এরই ফাঁকে বিকেলের নাস্তা সেড়ে নিলাম। রিক্সায় চড়ে ও পায়ে হেঁটে সিলেট শহরের আশ-পাশ ঘুরে দেখা হল। ঝামেলাহীন পরিচ্ছন্ন শহর মনে হল আমার কাছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে হোটেলে ফিরে আসলাম।
ভাইয়া আর আপু সবেমাত্র দুপুরের ঘুম থেকে উঠল সে সময়ে। ঘুম থেকে উঠে বাহির থেকে আনা পার্সেল নাস্তা সেড়ে ভাইয়া আর আপু বলল শপিং করার জন্য বের হতে। উনাদের প্রস্তাবে সায় দিয়ে আবারও বের হলাম শপিং-এর উদ্দেশ্য। বিভিন্ন শপিং মলে ঘুরলাম। উনাদের সাথে ঘুরে ফিরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে পুনরায় হোটেলে ফিরে আসলাম। আমাদের হোটেলে রেখে ভাইয়া ও তার ২ বন্ধু লাকী ভাই আর রাসেল ভাই গেলেন চট্টগ্রামে ফেরার ট্রেনের টিকেটের জন্য।
ঘড়িতে সময় রাত ১১টা; কিন্তু ভাইয়া ও তার বন্ধুরা যে ট্রেনের টিকিটের জন্য গেল আসার কোন নাম নেই! ভাইয়াকে ফোন দিলে উনি বলেন, ট্রেনের টিকিট পেতে ঝামেলা হয়েছিল বিধায় আসতে দেরি হচ্ছে আর আধা ঘন্টার মধ্যে খাবারের হোটেল থেকে পার্সেল নিয়ে হোটেলে ফিরছেন। ঠিক সাড়ে ১১টায় টিকেট নিয়ে উনি আর উনার বন্ধুরা হোটেলে ফিরে আসলেন। তারপর ফ্রেশ হয়ে সবাই রাতের খাবার সেড়ে নিলাম।
মোবাইল ফোনে সকাল ৬টার এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম পরের দিনে জৈন্তাপুর, শ্রীপুর, তামাবিল ও জাফলং-এ যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে।
(চলবে)
আমার পার্সোনাল ব্লগে
১ম পর্ব