১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যাকারী ও বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে প্রথম বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল আয়োজিত হয়েছিল ১৯৭২-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি।
জনপথে মিছিল শহীদ মিনারে জনসভা : বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার চাই
স্টাফ রিপোর্টার : সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের অনতিবিলম্বে জনসম্মুখে বিচার করে সমূলে নিপাত করার দাবী জানিয়ে গতকাল রবিবার নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষুব্ধ পরিবারবর্গ কেন্দ্রীয় শহীদ চকে অনুষ্ঠিত জনসভায় ও মিছিলে দাবী তুলেছেন।
‘নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষুব্ধ পরিবারবর্গ’ গতকাল রবিবার উক্ত জনসভা এবং রাজপথে মিছিলের আয়োজন করেছেন।
বিগত ন’মাসে বাংলাদেশে বর্বর পাকবাহিনী এবং তাদের দোসর কুখ্যাত আল-বদর এবং আল-শামস্ ও জামাতে ইসলামীর দালালরা যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল, সেই গণহত্যার সাথে বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
সুপরিকল্পিত, হীন চক্রান্ত ও গভীর ষড়যন্ত্র করে ঠাণ্ডা মাথায় বেছে বেছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছিল, যাতে বাংলাদেশের মানুষ আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
সে ষড়যন্ত্র আজও চলে আসছে। তার প্রমাণ, গত মাসে জহির রায়হানের নিখোঁজ হবার ব্যাপার থেকে স্পষ্টই বুঝতে পারা যায়।
বাংলা একাডেমীর পরিচালক জনাব কবীর চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত জনসভায় নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্ত্রীরাসহ বহু সাহিত্যিক, কবি, সাংবাদিক, অধ্যাপক, শিল্পী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বক্তৃতা করেন।
নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী বেগম লিলি চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী মিসেস চৌধুরী, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জনাব শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী মিসেস পান্না কায়সার, প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক, পরিচালক ও প্রযোজক জনাব জহির রায়হানের স্ত্রী সুচন্দা রায়হান ও তাঁর বোন নফিসা কবীর, প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী, ভাসানীপন্থী ন্যাপের কোষাধ্যক্ষ সাইদুল হাসানের স্ত্রী মিসেস ফরিদা হাসান, ডঃ আলীম চৌধুরীর স্ত্রী, প্রকৌশলি জনাব শামসুদ্দীনের স্ত্রী এবং মিসেস নাজমুল হক।
এছাড়াও যাঁরা বক্তৃতা করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন, কবি জসিমউদ্দীন, বেগম সুফিয়া কামাল, ‘পূর্বদেশের’ সম্পাদক জনাব এহ্তেশাম হায়দার চৌধুরী, কমরেড অনীল মুখার্জী, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, জনাব আলী আকসাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সভাপতি জনাব আ, শ, ম, আবদুর রব, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি জনাব নুরুল ইসলাম, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি জনাব হায়দার আনোয়ার খান ঝুনু, জনাব রাশেদ খান মেনন, চিকিৎসা সমিতির সভাপতি ডঃ মান্নান, স্থাপত্য সমিতির জনাব মাজহারুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আহসান রব, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ আলী আজহার, ডঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কণ্ঠশিল্পী সানজিদা খাতুন, চলচ্চিত্র শিল্পী জনাব হাসান ইমাম, খেলাঘরের পক্ষ থেকে সাংবাদিক জনাব শওকত আনোয়ার, সুচন্দা রায়হানের বোন ববিতা প্রমুখ।
কবীর চৌধুরী : জনাব কবীর চৌধুরী বলেন, গণহত্যার সাথে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার কোন মিল নেই। তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বুদ্ধিজীবী হত্যার হীন যড়যন্ত্র আজও শেষ হয়নি।
তিনি বলেন, সরকারের উচিত, অনতিবিলম্বে দেশের ভিতরে ও বাইরে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বিরোধী দোসরদের প্রকাশ্য বিচার করে শাস্তি প্রদান করা। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এ ব্যাপারে যদি সরকারের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয়ে থকে, তাহলে তাও জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা উচিত। কারণ জনসাধারণ তাহলে বিচারের দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
কবি জসিমউদ্দীন : কবি জসিমউদ্দীন বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতে যে বন্ধ্যাত্ব দেখা দিয়েছে তা অপূরণীয়। তিনি অবিলম্বে হত্যাকারীদের বিচার দাবী করেন।
বেগম সুফিয়া কামাল : বেগম সুফিয়া কামাল বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে তাদের বিচার দাবী করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বুদ্ধিজীবীদের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকারের নিকট দাবী জানান।
কমরেড অনীল মুখার্জী : কমরেড অনীল মুখার্জী সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে বদরবাহিনী খুঁজে বের করার আহ্বান জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন যে, অনতিবিলম্বে যদি বাংলাদেশ সরকার হত্যাকারীদের প্রকাশ্যে বিচার না করেন, তাহলে আমরা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে হত্যাকারীদের বিচার দাবী করতে বাধ্য হবো।
এহ্তেশাম হায়দার চৌধুরী : জনাব এহ্তেশাম হায়দার চৌধুরী বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং গণহত্যাকে এক পর্যায়ের অন্যায় বলে অভিহিত করলে ভুল করা হবে।
তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পিছনে কাজ করেছে একটি সুপরিকল্পিত হীন চক্রান্ত। যে চক্রান্তের মূল উদ্দেশ্য ছিল এদেশের মানুষ আর যাতে কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকারের ন্যায় শক্তিশালী সরকার পৃথিবীর কোন দেশেই নেই। তিনি বলেন, জনশক্তি সমর্থিত এই সরকার যে ব্যবস্থাই নেবেন, জনসাধারণ সে ব্যবস্থাই মাথা পেতে নিতে বাধ্য থাকবেন।
তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচার দাবী করে বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি দিতে হবে। দরকার হলে হত্যাকারীদের খুন করা হবে।
বেগম মুনীর চৌধুরী : বেগম মুনীর চৌধুরী বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের কি সরকার বিচার করবেন না?
তিনি সরকারের নিকট জীবনের নিরাপত্তাও দাবী করেন।
মিসেস সাইদুল হাসান : ভাসানীপন্থী ন্যাপের কোষাধ্যক্ষের স্ত্রী মিসেস সাইদুল হাসান বলেন, কেন হত্যাকারীদের বিচার করতে সরকারের বিলম্ব হচ্ছে? তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারের সাথে সাথে সেই হত্যাকারীদের যারা এখনও আশ্রয় দিচ্ছেন, তাদেরকেও বিচার করতে হবে।
নফিসা কবির : তিনি হত্যাকারীদের বিচারের ব্যাপারে সরকারের বর্তমান ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, সরকার বিপ্লোবত্তোর সরকারের ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বেগম সুচন্দা রায়হান : তিনি সরকারের নিকট তার স্বামীর নিখোঁজ হবার কারণ সন্ধানের দাবী জানান।
মিসেস নাজমুল হক : তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ায় কিছু বলতে পারেন নি।
মিসেস আলীম চৌধুরী : প্রখ্যাত ডাক্তার আলীম চৌধুরীর স্ত্রী বেগম চৌধুরী বলেন, যে পর্যন্ত হত্যাকারী এবং তাদের সাহায্যকারী বুদ্ধিজীবীদের জনসম্মুখে বিচার করে শাস্তি দেয়া না হবে সে পর্যন্ত আমি ‘জয় বাংলা’ বলব না।
বেগম মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী : তিনি স্বামী হারানোর ব্যথায় এত বিমর্ষ হয়ে পড়েন যে একটি কথাও বলতে পারেননি।
মিসেস আলতাফ মাহমুদ : তিনি সরকারের কাছে হত্যাকারীদের প্রকাশ্য বিচার দাবী করেন।
বেগম শহীদুল্লাহ কায়সার : তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদী হীন চক্রান্তকারী, হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের এই ন্যূনতম দায়িত্ব পালন না করলে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে।
হাসান ইমাম : হাসান ইমাম বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীরা এখন আমাদের স্বাধীনতা ও জীবনের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আ. শ, ম, রব : তিনি বলেন, সরকারের নিকট হত্যাকারীদের বিচারের দাবী জানাতে হবে কেন। হত্যাকারীদের বিচার করা হবে সরকারের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য।
নুরুল ইসলাম : তিনি হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
হায়দার আনোয়ার খান ঝুনু : তিনি সরকারকে হত্যাকারীদের বিচারের ব্যাপারে সম্পূর্ণ সহযোগিতা দানের আশ্বাস দেন।
রাশেদ খান মেনন : তিনি বলেন, ষড়যন্ত্র এখনো চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। তাই তিনি হত্যাকারীদের অবিলম্বে বিচার করে নির্মূল করার দাবি জানান।
গৃহীত প্রস্তাব : সভায় গৃহীত প্রস্তাবে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ নাগরিকদের হত্যার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ও জড়িত সকল সাহায্যকারীদের বিচারের জন্য সকল সরকারী, আধা সরকারী এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় অবিলম্বে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ট্রাইবুনাল গঠনের দাবী জানানো হয়।
অপর এক প্রস্তাবে, অপরাধীদের খুঁজে বের করার জন্য সকল পুলিশ, গোয়েন্দা ও সামরিক দফতরকে ট্রাইবুনালের সাথে কার্যকরী সহযোগিতায় জরুরী তথ্যাবলী সংগ্রহ করে ট্রাইবুনালের বিচার ত্বরান্বিত করার দাবী জানানো হয়।
প্রস্তাবে বর্বর পাক সেনাবাহিনীর যে সব কর্মকর্তা এই বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী তাদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠনের দাবী জানানো হয়।
সর্বশেষ প্রস্তাবে সমাজের সকল ক্ষেত্র থেকে অপরাধী ও দালালদের চিহ্নিত করে অপরাধীদের শাস্তি দাবী করা হয়।
রাজপথে মিছিল ও শ্লোগান : দুপুরে বায়তুল মোকাররম থেকে নিহত ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষুব্ধ পরিবারবর্গ মিছিলসহকারে বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করেন।
মিছিলে ‘বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার চাই’, ‘ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা প্রস্তুত’, ‘সাম্যাজ্যবাদী চক্রান্ত খতম কর’, ‘দালালদের ক্ষমা করা হবে না’, ‘বুদ্ধিজীবীদের পরিবারবর্গকে সম্মানিত নাগরিক মর্যাদা দিতে হবে’ প্রভৃতি শ্লোগান দেয়া হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:৪৬