কবি নাটকের একটি দৃশ্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রযোজনা কবি। শিক্ষার্থী থাকাকালীন এই বিভাগে মনসার কথা, সীতায়ন, দ্রৌপদী শীর্ষক নাটকে কাজ করেছিলাম একাগ্রচিত্তে। যাঁর হাত দিয়ে এইসব নাট্যগাঁথার মঞ্চায়ন তিনি ইউসুফ হাসান অর্ক। বিভাগের শিক্ষক। কবি নাট্যের নির্দেশকও তিনিই। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত এই উপন্যাসকে মেলে ধরেছেন মঞ্চে। শুধুমাত্র নির্দেশনাই নয়, দিয়েছেন নাট্যরূপও- এবং অতিঅবশ্যই বর্ণনাত্মক আঙ্গিক মান্য করে।
বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার [ঢাকা বিভাগ] ও ঢাকা থিয়েটায়ের আয়োজনে সেলিম আল দীন স্মরণ উৎসব ২০১৬ উদযাপনের অংশ হিসেবে, ১৩ জানুয়ারি বুধবার সন্ধ্যা ৭টায়, জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হলে মঞ্চায়িত হয় নাটকটি। ইউসুফ হাসানের প্রতিটি নাটকেই সংগীত বড় অংশজুড়ে থাকে। এটি যেমন তাঁর নিজস্বতার অভিজ্ঞান তেমনি বর্ণনাত্মক নাট্যের ঐতিহ্যিক ধারারও অনুগামী।
কবি নাটকেও ছিল না ব্যতিক্রম। চাঁদ তুমি আকাশে থাকো শীর্ষক গানের মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু। একই চরিত্রের আবরণে তখন তিন নারী মঞ্চে। পৃথক তাদের চেহারা। অথচ দৃশ্যায়নে ‘রাধাভাবের’ এমন উপস্থাপন আমাদের মধ্যে প্রবিষ্ট করে দেয় প্রেমময়তার আবেশ। তাতে দর্শক হিসেবে নিতে থাকি প্রস্তুতি। আমাদের চোখ বেয়ে নামে ডোমের সন্তান নিতাই এবং তার আকস্মিক কবিয়াল হয়ে ওঠা, সামাজিক স্বীকৃতিহীন প্রেম, অনটন, আত্মযন্ত্রণা ইত্যকার বিষয়। আর তার ফাঁকে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিয়ে গেছে অপরাপর চরিত্র এবং ঘটনার যাবতীয়। শূন্য মঞ্চ। ফলে অভিনয় আর বর্ণনাই ছিল সেই অবাস্তবতার মধ্যে বাস্তব সময়ে নির্মিত সবকিছুর কেবলমাত্র উপাদান। এটি ঝুঁকিপূর্ণ বটে। তবে সেই ঝুঁকি সবাইকে নিয়ে সামর্থের সঙ্গেই মোকাবিলা করেছেন নির্দেশক।
নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক
বর্ণনাত্মক নাট্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিভাগটি ধারণ করে আছে। বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিয়া অর্থাৎ সংলাপ ও বর্ণনার ভেদরেখা ঘুচিয়ে দেয়া। ঢাকা থিয়েটার ও গ্রাম থিয়েটারের পরিবেশনাতেও বিদ্যমান একই বৈশিষ্ট্য। এটি একটি অতুলনীয় ম্যাজিক। রবীন্দ্রনাথ যেমন ফুলবাগান আনার পরিবর্তে দর্শকের চিত্তে জাগাতে চেয়েছেন পুরো পুষ্প উদ্যান, এই কৌশলও ঠিক তাই। এটিই ঐতিহ্যের ধারা।
আলোর অসামান্য ব্যবহার নেই ‘কবি’তে অথচ এরপরও মনে হয়নি দৃশ্য সৃষ্টি কোথাও হয়েছে বাধাগ্রস্ত। আর পোশাক সেতো যৎসামান্য। মূলত ফতুয়া, ধুতি, শাড়ি। বলাই বাহুল্য চরিত্রগুলোর সঙ্গে মানানসই। তবে নিতাই চরিত্র রূপায়নকারীর চলনে কখনও কখনও ধরা পড়েছে, ওই জীবন তিনি যাপন করেননি কোনোদিন। মনে হয়েছে একটু সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কালো মেয়ে ঠাকুরঝিকে মনে থাকবে বহুদিন, কিংবা মাসীর কথা। বসন্ত কিংবা বসন নিশ্চিতই মনে রাখবেন, ন্যূনতম দিয়েই স্বর্গ-মর্ত্য বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব যেখানে, বাহুল্য সেখানে অপরাধ। সংগীত মনোগ্রাহী কিন্তু সমবেত অংশগ্রহণে টোল খেয়েছে সুর কখনো কখনো।
কবি নাটকের একটি দৃশ্য
দীর্ঘকালব্যাপী চর্চার ফলে চিন্তার যে কাঠামো গড়ে ওঠে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া ক্রিয়াকর্মের মধ্যদিয়ে নিজের ভেতরে যে অচলায়তনের সৃষ্টি হয়, ব্যতিক্রম সেখানে সহজে পায় না প্রবেশের অধিকার। এ কারণেই ঐতিহ্যবাহী ধারার আধুনিকায়নের শেষ দেখে ফেলতে চান অনেকে। যে আঙ্গিকবাদিতা নিয়ে এখনো বিভক্ত দেশের নাট্য পরিসর যারা কিনা কয়েকশ বছরের ঘেরাটোপেই বেঁধে ফেলতে চান আমাদের সূত্রসমূহকে, তারা বরং এর সমাপ্তি রেখা টেনে ক্লিশে একঘেয়েমিতেই মুখ গুঁজে থাক। আমরা একে বলতে চাই লড়াই। অচলায়তন ভাঙার লড়াই। ‘কবি’ নাটকে নিতাই যে লড়াই করেছিল তার সমাজের শ্রেণীগত বিভেদের সঙ্গে, সামাজিক স্বীকৃতিহীন প্রেমের সঙ্গে, সনাতন মানসিক আয়তনের সঙ্গে- বাংলা নাট্যে আঙ্গিকবাদিতার লড়াইটিও তারই সমান্তরাল। ইউসুফ নাট্যের অন্তর্গত আধেয়র সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যগত এই লড়াইটিকেও জারি রেখেছেন সমান তালে। নাটকটিকে দেখা যেতে পারে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই। কেন এমন কথা বলছি? কারণ এই নির্দেশকের প্রায় সবগুলো নাট্যের উপস্থাপনই একই ধারার অনুবর্তী। আর নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের যে লড়াই ঐতিহ্যবাহী আঙ্গিক নিয়ে কবি তারই প্রতিনিধিত্বশীল উজ্জ্বল প্রযোজনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:১৮