ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনা ‘আউটসাইডার’ নাট্যে কবি
আলব্যের ক্যামুর আউটসাইডারের মূল চরিত্র ম্যরসল এক অনিচ্ছুক খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়। প্রচলিত আইনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় তাকে। কিন্তু তাকে দণ্ডিত করার প্রক্রিয়ায় দোষী হিসেবে নিশ্চিত করার জন্য তুলে আনা হয় মায়ের মৃত্যুর সময় ম্যরসলের নির্লিপ্ত থাকার বিষয়টি। প্রকৃতপক্ষে ম্যরসল অকপট এবং সৎ একজন মানুষ। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আচারের যে অর্থহীনতা ম্যরসলের অবস্থান সেই বিষয়টির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। আর সে কারণেই আইন তাকে দণ্ডিত করে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামো অটুট রাখার স্বার্থে। ম্যরসলের অন্তিম ইচ্ছে ছিল, তার মৃত্যু কার্যকরের দিন যে প্রকাশ্য স্থানে তার শিরচ্ছেদ হবে সেখানে যেন বহু মানুষের সমাগম হয়। ক্যামুর উপন্যাস সেখানেই সমাপ্তি রেখা টেনে দেয়।
ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনা ‘আউটসাইডার’ নাট্যের একটি দৃশ্য
কিন্তু আমার পুনর্নিমাণে ক্যামুর আউটসাইডারের শেষ অংশের পর আরও খানিক অগ্রসর হয়। তাতে দেখা যায় ম্যরসলের অন্তিম ইচ্ছে বা পরিণতির প্রতীকী রূপ। আর এ কারণেই শুরু হয় পৃথক এক গল্প, ম্যরসলের সমান্তরালে সেখানে প্রধান হয়ে দাঁড়ান একজন কবি। সেই কবি যে নগরে বাস করেন সেখানকার সবাই উল্টো হাঁটলেও কবি সোজা হাঁটার দায়ে একপ্রকার দণ্ডিত হয়ে পা খোয়ান। নগরটি এমন যে, সেখানে কাউকে পুরস্কৃত করা মানে তাকে একটি অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঠেলে দেয়া, যে সুড়ঙ্গের শেষে অনন্তলোক রয়েছে বলে কথিত। কিন্তু কবি জানেন সেই সুড়ঙ্গের শেষে কিছু নেই, শুধু অন্ধকার। আসলে যাকে সেই সুড়ঙ্গে ঠেলে দেয়া হয়, তার মৃত্যুই নিশ্চিত করা হয়। এই সত্য কবি তার গ্রন্থের মাধ্যমে প্রকাশ করে দিলে নগরের কর্তারা বিপদের আভাস পান। তাদের নিয়ন্ত্রণ কাঠামোয় চিঁড় ধরার আশঙ্কা করেন। তাই কবিকেও পুরস্কৃত করে সেই সুড়ঙ্গে ঠেলে দেয় নগরের প্রশাসন, আর সেইক্ষণটিতে উপস্থিত থাকে অগণিত মানুষ, যেমনটি ম্যরসল চেয়েছিলেন তার অন্তিম পরিণতির মুহূর্তে। ক্যামু ম্যরসলকে নির্মাণ করেছেন তার ক্রাইস্ট হিসেবে, যিনি সমাজের প্রচলিত আচারের বিপরীতে নিজের স্বভাবজ অবস্থান থেকেই দন্ডায়মান থাকেন। অতিমানব সে নয়, কিন্তু তারপরও তাকে ঠিক গ্রহণেরও সামর্থ্য থাকে না রাষ্ট্রকাঠামোর অর্থাৎ প্রশাসনের।
ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনা ‘আউটসাইডার’ নাট্যের একটি দৃশ্য
‘কায়া’ নাট্যে বিধৃত আমার কবি চরিত্রও তেমনি, বিপ্লবী নয়, সামান্য লেখাই তার সম্বল। অথচ তাকেও সহ্য করতে পারে না নগর প্রশাসন। ম্যরসল আর কবি ঠিক এই জায়গায় অভেধাত্মক রূপ ধারণ করে। অর্থাৎ তারা দু’জনেই সাধারণ মানুষ, তারা অকপট এবং সৎ। আউটসাইডার যে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত সেই সময় থেকে আমরা এগিয়েছি বেশ কিছুদূর। তার সমাজবাস্তবতা এবং এই সময়ে এ দেশীয় সমাজবাস্তবতা এক নয়। অন্তর্গত প্রেরণার জায়গায় তার বৈশ্বিক একরূপ রয়েছে কিন্তু নাটক যখন ভিন্ন সমাজ ও রাষ্ট্রে উপস্থাপিত হয় তখন সেই পরিবেশ-সংস্কৃতির অন্তর্গত হতে হলে তার খানিক রূপান্তর ও যোজন-বিয়োজন প্রয়োজন পড়ে। ‘কায়া’ নাটকেও তাই ক্যামুর আউটসাইডারের গল্পের পাশাপাশি আমার গল্পটিও সংযোজিত হয় স্বদেশের মধ্যে সংঘটিত অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর প্রচলিত ব্যবস্থার অসারতা প্রমাণে শিল্পভাষ্য নির্মাণের প্রয়োজনে। ক্যামুর ম্যরসলের পরিণতি আমরা জানি না কিন্তু কবির মধ্যে ম্যরসলকে প্রতিস্থাপন করে নিলে দেখতে পাই তাকে আসলে মৃত্যুর মুখেই ঠেলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ক্যামুর কাছে যে ম্যরসল ক্রাইস্টের আদলে হাজির হয়, আমার কাছে সেই ম্যরসল একজন কবির রূপে ধরা দেয়। প্রকৃতপক্ষে দাঁড়াচ্ছে, আমার কবি ক্যামুর ম্যরসলের একটি ব্যাখ্যা ও পরিণতি মাত্র।
ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনা ‘আউটসাইডার’ নাট্যের একটি দৃশ্য
আলব্যের ক্যামু ১৯১৩ সালের ৭ নভেম্বর ফ্রান্সে জন্মগ্রহণ করেন। একাধারে লেখক, সাংবাদিক, দার্শনিক ক্যামু তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৫৭ সালে অর্জন করেন নোবেল পুরস্কার। বিংশ শতাব্দীতে যে কয়েকজন মুষ্টিমেয় সাহিত্যিক বিশ্বকে নানা মাত্রায় প্রভাবিত করেছিলেন ক্যামু সেই বিরলপ্রজদের একজন। ‘দ্য আউটসাইডার’ এই লেখকের সম্ভবত জনপ্রিয়তম উপন্যাস, ফরাসি ভাষার যার নাম ‘লেত্রঁজে’। এটি ‘দ্য স্ট্রেঞ্জার’ নামেও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয় এই উপন্যাস। ক্যামু নিজেকে অস্থিত্ববাদী বলে বিবেচনা না করলেও তাঁর প্রতিটি লেখায় অস্থিত্ববাদ ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের প্রবল উপস্থিতির খোঁজ পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে অ্যাবসার্ড, নিয়তিবাদ, ন্যাচারালিজম ইত্যাদি মতবাদের দ্বান্দ্বিক প্রাবল্যও লভ্য। ১৯৬০ সালের ৪ জানুয়ারি মাত্র ৪৬ বছর বয়সে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। ক্যামুর উল্লেখযোগ্য অন্যান্য রচনা উপন্যাস দ্য প্লেগ, দ্য ফল, দ্য ফার্স্ট ম্যান ইত্যাদি। তিনি নাটকও লিখেছেন। তারমধ্যে ক্যালিগুলা, দ্য মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং, দ্য স্টেট অব সিজ, দ্য জাস্ট অ্যাসাসিনস, দ্য পসেসড উল্লেখযোগ্য।
আলব্যের ক্যামু
২০১৩ সালের নভেম্বরে পূর্ণ হয় আলব্যের ক্যামুর জন্মশতবর্ষ। ঢাকা থিয়েটার ক্যামুর বিখ্যাত এই উপন্যাসটি অবলম্বনে নাটক মঞ্চায়ন করে যার উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় ২০১৪ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় নাট্যশালার মূলমঞ্চে। ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনায় নাটকটির নামকরণ রাখা হয় ‘আউটসাইডার’। এই নাটক মহান ওই লেখকের প্রতি আমার এবং আমাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের স্মারক হয়ে থাক
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৪৩