২০১৩ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা থিয়েটারের ৪০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে আশীর্বচন রাখছেন সৈয়দ শামসুল হক। সঙ্গে দলপ্রধান নাসির উদ্দীন ইউসুফ
মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ধারা নাটক যে তুঙ্গস্পর্শী সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, ঢাকা থিয়েটার সেখানে রেখেছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। স্বাধীন দেশে ১৯৭৩ সালের ২৯ জুলাই কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা থিয়েটার। এই নাট্যদল আজ ৪০ বছরের দুরন্ত সময়ে রেখেছে পা। বলছি ২০১৩ সালের ২৯ জুলাইয়ের কথা।
৪০ বছরের দুর্গমযাত্রায় ঢাকা থিয়েটার হারিয়েছে আটজন আত্মার আত্মীয়কে। নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, অতুল অভিনয়শিল্পী হুমায়ুন ফরিদী, ফওজিয়া ইয়াসমিন শিবলী, আমিনুল ইসলাম তুহিন, আহসান নেওয়াজ বাবু, সোহেল সামাদ, মাহতাব, সাবিনা ইয়াসমিন সাবা, নাজিবুল্লাহ জন কে। তাঁদের স্মরণ করি। যদিও মৌলিক নাট্য জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের অভিপ্রায়ে ঢাকা থিয়েটারের যাত্রা শুরু, তবুও সূচনাপর্বের নাটকে দলটি পাশ্চাত্যের রীতিকেই মান্য করেছিল। একে একে তারা মঞ্চে আনে সংবাদ কার্টুন, সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, বিদায় মোনালিসা। এগুলো মঞ্চে আসে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ কালপর্বে। ১৯৭৬ সালে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে আনে মিউজিক্যাল কমেডি ‘মুনতাসির’। এক সর্বভূক মানুষের আখ্যান। পুরো নাটকটিই সুরে-ছন্দে-সঙ্গীতে উপস্থাপিত হয়েছে। সঙ্গীতপ্রবণ বাঙালির মানস এই নাট্যের শরীরের আভরণে আমরা দেখি না সত্য, কিন্তু গহীনে যে ছিল সে কথা তো স্বীকার করতেই হবে।
৪০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে চাকা নাটকের একটি অংশে রাইসুল ইসলাম আসাদ ও শিমূল ইউসুফ
১৯৭৭ সালে ‘নাচাও রাস্তা নাচাও’ স্লোগানে ‘চর কাঁকড়া’ নামের নাটক রাস্তায় প্রদর্শন করে নিয়মিত পথনাটকের চর্চার যে সূচনা করে ঢাকা থিয়েটার তা আজ একটি স্বতন্ত্র নাট্য আঙ্গিক রূপে প্রতিষ্ঠিত। এখন যে কোন স্বৈরশাসন কিংবা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে শিল্পিত প্রতিবাদ মানেই পথনাটক। এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে পথনাটক কি বিপুল ভূমিকা রেখেছিল তা বিস্মৃত হওয়ার নয়। এ কালপর্বেই হাবিবুল হাসানের ‘কসাই’, বাস্তববাদী নাটকে আঙ্গিক অন্বেষণের চেষ্টা। কিন্তু এরপরই ঢাকা থিয়েটার সাজেদুল আউয়ালের ‘ফণিমনসা’ নাটকের মঞ্চায়নে প্রসেনিয়াম ছাড়িয়ে আরো সম্মুখতল ব্যবহারের যে দৃষ্টান্ত তৈরি করে তাই কালক্রমে দলটির ঐতিহ্যনিষ্ঠ নাট্যভাবনার সঙ্গে মিলেমিশে যায়। সমসময়েই দলটি নাটকের বিষয়ভাবনা ও আঙ্গিক বিনির্মাণে পুরাণ ভাবনাকে আপন করে নিল। ‘শকুন্তলা’ নাটকের মঞ্চায়নে তাই ঢাকা থিয়েটারের দৃপ্ত উচ্চারণ ‘পুরাণ নির্মাণের দৃষ্টান্ত বাংলা কাব্যে যতোটা আছে- বাংলা নাটকে ততোটা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা নাটকে পুরাণ এসেছে ধর্মীয় আবেগ থেকে। স্বর্গ ও মর্ত্যের মিলনের দৃষ্টান্ত শকুন্তলা কিভাবে হতে পারে। যার জন্ম বিশ্বামিত্রের তপস্যাভঙ্গের ফলে স্বর্গ-মর্ত্যরে বিরোধভূমিতে- তার জীবন দ্বন্দ্বহীন গল্প হয় কি করে।’ ঢাকা থিয়েটারের আত্মানুসন্ধানে যাত্রা শুরুর ইশারা প্রথম দেখা যায় ‘কিত্তনখোলা’ নাটকে। দীর্ঘায়তনের, ঘটনাবহুল আর অসংখ্য চরিত্রের সমাহারে রচিত হয় ‘কিত্তনখোলা’। সংলাপাত্মক ধারা অক্ষুন্ন থাকলেও বাংলার লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতির নানা দিক উঠে এসেছে এক মহাকাব্যিক বিস্তারে। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যরীতির প্রেরণাজাত ‘কিত্তনখোলা’ নাটকে দৃশ্যের পরিবর্তে সর্গ বিভাজন এসেছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা নিয়ে। পাশ্চাত্য নাটকের সুতীব্র ঘটনাপ্রবাহের বদলে এ নাটকে এদেশের আখ্যান কাব্যের চিরায়ত বর্ণনাত্মক রীতিটি নতুন আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ নাটকের বিষয়ে এদেশের শ্রমজীবী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্প্রতিক জীবন ভাবনাও একীভূত। জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের প্রথমপর্বে কিত্তনখোলা ধ্রুপদী বাস্তবতার প্রথম নাটক।
৪০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করছেন আফজাল হোসেন ও রাইসুল ইসলাম আসাদ
এরপর ঢাকা থিয়েটার একে একে মঞ্চে নিয়ে আসে ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’, ‘বায়ান্নের শকুন’। একালপর্বে এসে ঢাকা থিয়েটারের নাটকের আঙ্গিক গেল বদলে। পশ্চিমা ক্লিশে অঙ্ক বিভাজরীতি থেকে সরে গেল ঢাকা থিয়েটারের নাটক। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ঢাকা থিয়েটারের সামগ্রিক মঞ্চায়ন শৈলী বদলে গেল। এই সময়ে ঢাকা থিয়েটার নাট্যমঞ্চায়নের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রকাশবাদকে গ্রহণ করেছে বাংলা নাটকের বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতির প্রেক্ষাপটে। এটা যেন বাংলা নাটকের হাজার বছরের শেকড়ের টান। আমরা দেখি নাটকের দৃশ্য বিভাজনের বদলে বৃত্ত পরিকল্পনা, খণ্ডে বিভাজন পাশ্চাত্যের ঘটনা সংঘাতের রীতি থেকে সরিয়ে একটি আলাদা অবয়ব দিয়েছে। আর সেটি শুধুমাত্র লেখ্য মাধ্যমে নয়, উপস্থাপনাতেও এনেছে অভিনবত্ব। নাটক কেরামতমঙ্গল। মহাকাব্যিক বিস্তারে ধ্রুপদী বাস্তবতার দ্বিতীয় প্রযোজনা। তারপর ‘বাসন’, ‘সংকেত’, ‘গম্ভীরা পালা’ মঞ্চে উপস্থাপন করলেও ঢাকা থিয়েটার যেন তার গন্তব্যের ইশারা সুনির্দিষ্ট করার পথে অগ্রসর হয় আঞ্চলিকভাষায় রচিত মহাকাব্যিক বিস্তারে রচিত তৃতীয় নাটক ‘হাতহদাই’র মধ্যদিয়ে। নোয়াখালীর সমুদ্র উপকূলবর্তী মানুষের জীবন ও সংগ্রামগাথাই যেন উঠে এসেছে অভিন্ন ছন্দে। হাতহদাই নাটকের অঙ্ক বিভাজন প্রচলিত নাট্যরীতির নয়। সমুদ্রোপকূলীয় জীবনের গল্প সমুদ্রের জোয়ার ভাটার মতোই। এই জোয়ার ভাটার অনুকরণে নাট্যপর্ব বিভাজিত হয়েছে। নাটকে এমত নিরীক্ষা কখনও হয়নি যে সমুদ্রের জোয়ারভাটা, মহাকাব্যের সর্গ বিভাজন কিংবা দোজখের বৃত্ত পরিকল্পনায় নাটকের দৃশ্য বিভাজন হতে পারে। শুধু যে আঙ্গিক গঠনেই নিরীক্ষা চালু ছিল তা নয়, অভিনয়রীতির দেশজধারার পুনঃসৃজনের বিষয়টিতেও গভীর মনযোগ ছিল। আর অভিনয়শৈলী প্রাচ্য দেশীয় অভিনয় রীতির গীতল ও কাব্যিক বৈশিষ্ট্যকেই ধারণ করেছে। চরিত্র আর বর্ণনাকারীর অভেদাত্মক রূপ আমরা দেখতে পাই। নাটকে প্রাণীকূলও চরিত্ররূপে উঠে আসতে পারে বাংলা নাটকে তার প্রথম আভাস। যে জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণের লক্ষ্যে ঢাকা থিয়েটারের নিরন্তর সংগ্রাম, ‘হাতহদাই’ এ এসে যেন তারই কূলে ভিড়তে যাচ্ছে তরী। এ প্রসঙ্গে সেলিম আল দীনের বক্তব্য থেকে পরবর্তীকালে বর্ণনাত্মক বাংলা নাটকের যে সূচনা তার একটি ইঙ্গিত আমরা পেয়ে যাই। তিনি বলেন- ‘ভবিষ্যতে পাশ্চাত্য বা সংস্কৃত নাট্যের পন্থায় চরিত্রের নাম বামে বসিয়ে ডানে সংলাপ স্থাপনের আদ্যিকেলে রাম-সীতার উপবেশন রীতিটাও পরিত্যাগ করবার বাসনা আছে।’ অর্থাৎ এর মাধ্যমে তিনি পাশ্চাত্য ও সংস্কৃত নাট্যরীতির বাইরে নিজস্বরীতি নির্মাণের দিকে অগ্রসর হওয়ার দিকে যাত্রা শুরু করেন যার সঙ্গী হয় ঢাকা থিয়েটার।
৪০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে প্রাচ্য নাটকের একটি অংশে শিমূল ইউসুফ ও রোজী সিদ্দিকী
কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল ও হাতহদাই-এর মধ্যদিয়ে বাঙালির নতুন আঙ্গিক ধ্রুপদী বাস্তবতার বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির উদ্ভাবনে তৃপ্ত নয় সেলিম আল দীন আর ঢাকা থিয়েটার। তারা থেমে থাকেনি। অচিরেই তারা পেয়ে যায় নতুন নাট্যাঙ্গিক, ‘কথানাট্য’। এ ধারায় সেলিম আল দীনের তিনটি রচনা চাকা, যৈবতী কন্যার মন ও হরগজ। ‘চাকা’ এক অনামা মৃতকে অজানা গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার বৃত্তে বাধা। অন্তিম পরিণতিতে অনামা মৃতের গন্তব্য নিশ্চিত হয় অন্ধকার কবর, স্বজন পরিবৃত্ত হয়ে নয়, শ্রমজীবী মানুষের মানবিক হাতে।
‘যৈবতী কন্যার মন’ এ গীতিকার নারী পরিচয়ে দুইজন্মে দুই নারী মর্ত্যভূমে আবির্ভূত হন। এক নারীর শিল্পী হয়ে ওঠার প্রবল বাসনার অতৃপ্তি বর্ণিত হয় কালিন্দী অংশে অপূর্ণতার বেদনা তাকে আত্মহননে প্ররোচিত করে। অতৃপ্ত বাসনার পূর্ণতা চেয়ে পুনর্বার সেই নারী পৃথিবীতে এসে পরী নাম ধারণ করে। কিন্তু শিল্পের ভেতর দিয়ে অবিরত এক অহং বাসা বাধে যা পরীকে পুনর্বার আত্মবিধ্বংসী করে তোলে। ‘কথানাট্য’ অভিধা সম্পর্কে সেলিম আল দীনের বক্তব্য, ‘আমি কথার শাসনে নাটক রচনা করেছি তাই এর নাম দিয়েছি কথানাট্য।’ প্রকৃতঅর্থেও ঠিক তাই। সৈয়দ শামসুল হক যথার্থই বলেছিলেন, ‘সংলাপ নির্ভর নাটক তাঁর কাছে যথেষ্ট মনে হয় না, আবার কেবল দেহছন্দ-নাচ-অভিনয় সকল কিছু তাকে এঁটে উঠতে পারে না, উপন্যাসের ধারাবর্ণনাও তার নিকট বলে মনে হয় না, সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এবং ব্যক্তি-সমাজ-সংগ্রাম তাকে অবিরাম দুলিয়ে দিতে থাকে ভূত-ভবিষ্যতে, এমত মুহূর্তে আমাদের এই নাট্যকার এক নতুন সাহিত্য মাধ্যম আবিষ্কার করে ফেলেন-কথানাট্য-যা নাটক, কবিতা, নাচ, গীত, উপন্যাস উপকথা ও কথকতার সমাহার।’
৪০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে চাকা নাটকের একটি দৃশ্যে কামাল বায়েজীদ ও শিমূল ইউসুফ
পরবর্তী কালপর্বে ঢাকা থিয়েটার ‘ধূর্ত উই’, ‘ভূত’, ‘এবার শেখার পালা’, ‘একটি মারমা রূপকথা’, ‘একাত্তরের পালা’, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’ শীর্ষক নাটকও মঞ্চায়ন করেছে। পাঁচালি আঙ্গিককে আধুনিক মনস্কতায় পুনর্নির্মাণ করে রচিত নাটক বনপাংশুল ও প্রাচ্য। একালে যার নামকরণ করা হয়েছে নব্যপাঁচালি। ঢাকা থিয়েটার যেনবা সুদীর্ঘকাল এই আঙ্গিকের জন্যই প্রতীক্ষা করেছিল। যে আঙ্গিক বাঙালির, যে আঙ্গিকে হাজার বছরের মানুষের আচরিত জীবনপ্রবাহের অনুকূল, যাতে এক আকাশে বেঁধে ফেলা যায় সর্বকালের সকল সূর্যতারাকে। মধুপুর অঞ্চলের ক্ষয়িষ্ণু নৃগোষ্ঠী সর্বপ্রাণবাদী মান্দাইদের জীবন, সংস্কৃতি, বেদনা, সংগ্রাম আর সংখ্যাগরিষ্ঠের অহমিকায় চালানো বাঙালির নিপীড়নকে উপজীব্য করে রচিত হয় ‘বনপাংশুল’। ঢাকা থিয়েটার শুধু বাঙালির সংস্কৃতিকেই প্রাধান্য দিয়ে নাট্যনির্মাণ করেনি। এ ভূখণ্ডের রোদে-জলে বেড়ে ওঠা আদিবাসী ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীদের সংস্কৃতি ও তাদের বঞ্চনাকেও তুলে এনেছে মঞ্চের আলোআঁধারির মায়ায়। ১৯৯৪ সালে সেলিম আল দীনের রচনা ও নির্দেশনায় নির্মিত একটি মারমা রূপকথাই তার অভিজ্ঞান। যার বিস্তার দেখি ‘বনপাংশুল’ নাট্যে। পাঁচালির গড়ন নির্বাচনের নেপথ্যের ক্রিয়াশীলতা সেলিম আল দীনের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘বাঙলা উপাখ্যানের মডেলেই আধুনিকতা, সমকালীনতা, জীবন ও জগতের নানা স্তরের আন্তঃসম্পর্কের জটিল আবর্তসমূহের ধৃতি সম্ভব কিনা। উপরন্তু সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য নাট্য নির্মাণ কৌশলের অভিজ্ঞতায় পাঁচালির উপস্থাপনাকে একান্তরূপে কাব্য, উপন্যাস ও নাট্যের অনিবার্যস্থলে ন্যাস করা যায় কিনা তাও বুঝে নেয়া।’ ইত্যবসরে মৃত্যু সংবাদ ও হরগজ নামক নাটক মঞ্চায়ন করে ঢাকা থিয়েটার। নব্যপাঁচালি আঙ্গিকের দ্বিতীয় নাটক প্রাচ্য। প্রকৃতি ও ক্ষমা কিংবা প্রচ্ছন্নরূপে শ্রেণীসংগ্রামের আবহ ‘প্রাচ্য’-এ দৃষ্ট। নব্যকালের পাঁচালি ‘প্রাচ্য’তে আমরা দেখি, শ্রমজীবী সয়ফর বাসররাতেই স্ত্রী নোলককে হারায় সাপের দংশনে। এক উল্টোপুরাণ আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে। যেখানে লখিন্দর নয়, বেহুলাই মৃত হয় বিষে। সয়ফর স্ত্রীহত্যার প্রতিশোধ নিতে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। রাতভর ঘাতক সাপের খোঁজে খনন করে চলে উঠোন থেকে ঘরের মাটি পর্যন্ত। ভোরে যখন সাপটিকে খুঁজে পায় উদ্যত ফণাতোলা, তখন হত্যা ভুলে যায় সয়ফর। আর সেই সাপ বিলীন হয় নোলকের কবরের ওপর দিয়ে প্রকৃতির মধ্যে।
৪০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে যৈবতীকন্যার মন নাটকের একটি অংশে ফারুক আহমেদ ও শমী কায়সার
‘গণহত্যাকারীদের ক্ষমা নাই। বাতাসে মৃত্যুচাবুক শব্দ। আকাশে বজ্রবিদ্যুৎ। খুব দ্রুত দাঁতে নুন কামড়ে নিয়ে আসছে সাগর। জোয়ারে জোয়ারে অমাবস্যার ষোলকলা ফলাবে শশী। আর এরা পালাতে চেয়েছিল এ শহর থেকে। আকাশ উল্টে দিয়ে নিজেদের নাম লিখে দিতে চেয়েছিল। এরা নিরস্ত্র মানুষের হত্যাকারী।’ হ্যাঁ, নিমজ্জনের কথাই বলছি। পৃথিবীর তাবৎ গণহত্যাকে উপজীব্য করে নব্যপাঁচালি আর কথানাট্যের মিশেলে সেলিম আল দীন সৃজন করেন এই নাটক। এরমধ্যদিয়ে একটি নতুন শিল্পপরিভাষাও আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়, ফোররিয়ালিজম বা সম্মুখবাস্তববাদ। তবে নিমজ্জনে পৌঁছানোর পূর্বে ঢাকা থিয়েটার মঞ্চায়ন ‘ন নৈরামণি’ ও ‘বিনোদিনী’। এরপর ঢাকা থিয়েটার মঞ্চে আনে ধাবমান। বর্ণনাত্মক বাংলা নাটকের পূর্ণাঙ্গ রূপের প্রকাশ এই নাট্য। তা রচনা থেকে শুরু করে নির্দেশনা, মঞ্চ, অভিনয় সবকিছুকেই একাঙ্গে প্রকাশ করছে। একটি বলদর্পী ষণ্ডমোষ সোহরাবকে ঘিরে নির্মিত হয়েছে এই রচনার বৃত্ত। আমরা দেখি, এক শ্রমজীবী মানুষ নহবতের কাছে সোহরাব সন্তানের মতোই লালিত-পালিত হয়। যৌবনে সোহরাব নহবতের স্বপ্নপূরণ করে মোষের নাড়াই-এ সোনার মেডেল জয়ের মাধ্যমে। কিন্তু একসময় তাকে প্রাণ দিতে হয় কসাইয়ের ছুরির তলে। গৃহপালিত প্রাণীদের এই যেন ভবিষ্যৎ পরিণতি। কিন্তু এই উপরিকাঠামোর অতলে রয়েছে, ক্ষয়িষ্ণু নৃগোষ্ঠী মান্দি, আমরা যাদের বলি গারো, তাদের স্বপ্নভঙ্গ, পরাজয়, কৃত্য আর আত্মযন্ত্রণার মর্মস্পর্শী চিত্র। যে বাঙালি কিছুকাল পূর্বে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তারাই এইসব সর্বপ্রাণবাদী নৃগোষ্ঠীগুলোকে লুপ্তপ্রায় করে দেয়ার কর্মকাণ্ডে নেমেছে।
৪০ বছরপূর্তি অনুষ্ঠানে দ্য টেম্পেস্ট নাটকের একটি অংশে শিমূল ইউসুফ, সামিউন জাহান দোলা, সাজ্জাদ রাজীব, রুবাইয়াৎ আহমেদ ও রফিক মোহাম্মদ
তারপর ঢাকা থিয়েটার একে একে মঞ্চায়ন করে নষ্টনীড়, জিয়ন্তকাল, দ্য টেম্পেস্ট ও সর্বশেষ পঞ্চনারী আখ্যান। এরই মধ্যে ২০১২ সালে লন্ডনের অলিম্পিকের অংশ হিসেবে বিশ্বখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র রচিত ৩৭টি নাটক ৩৭টি ভাষায় শেক্সপিয়র প্রতিষ্ঠিত গ্লোব থিয়েটারে মঞ্চায়িত হয়েছে। বাংলা ভাষায় একমাত্র নাটকটি মঞ্চায়নের গৌরব অর্জন করেছে ঢাকা থিয়েটার। শেক্সপিয়র রচিত ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকটি বাংলার সার্বভৌম নব্যপাঁচালি আঙ্গিকে রূপান্তরিত করে সেটি মঞ্চে উপস্থাপন করে বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করেছে। ঢাকা থিয়েটারের যে স্বপ্ন ছিল ‘বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে ঝংকৃত হোক বাঙলা নাটকের শাশ্বত রূপ’ তাই বাস্তবে এসে ধরা দিয়েছে। এই অর্জন শুধু ঢাকা থিয়েটারের একার অর্জন নয়, বাংলাভাষী সমগ্র মানুষের, বাঙালি ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির, সকল নাট্যকর্মীর অর্জন।
প্রতিষ্ঠাকালে ঢাকা থিয়েটার অঙ্গীকার করেছিল- ‘আমাদের লক্ষ্য জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণ। শহরের মঞ্চে ঢাকা থিয়েটার বাংলাদেশের মৌলিক নাটকের অপ্রতিরোধ্য বৃত্তটি রচনা করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতির মধ্যে ক্রমে তা প্রসারিত করেছে। গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলেছে গ্রাম থিয়েটার। এদেশের মানুষের জীবন ও তার শিল্পিত রূপটি সমাজ রূপের মধ্যদিয়ে একদিন যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে একালের শিল্পসাধনা আগামীকালের মধ্যে পাবে পূর্ণতার আনন্দ।’
আজ এই কালে এসে এ দাবি তারা করতেই পারে, জাতীয় নাট্য আঙ্গিক সম্ভবত তাদের আর অধরা নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৫৪