চিত্র প্রদর্শনীতে জনৈক দর্শণার্থী
আদিমকালে যখন ভাষা মানুষের অধিগত ছিল না, তখনো যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে—অভিব্যক্তি আর নানা ভঙ্গির মধ্য দিয়ে। কিন্তু ওই সামান্য কসরত সবার কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেছে নিয়েছে ভিন্ন পন্থা, ভিন্ন মাধ্যম। আর তখনই সৃষ্টি হয়েছে শিল্পের, তা সে হোক দৃশ্য অথবা শ্রাব্য কিংবা আঁচড়ে। মূলত সেই কালপর্ব থেকেই শিল্পের নানা রূপের বিধিলিপি অলক্ষ্যে নির্ধারিত হয়ে যায়। পরবর্তীকালের মানুষ তার নিজস্ব সৃজনভাবনা আর প্রতিভায় সেই পৃথকত্বকে করে তুলেছে বিশিষ্ট। কিন্তু মূলে সেই একই প্রণোদনা—অন্যদের কাছে নিজেকে প্রকাশক্ষম করে তোলা। অবশ্য সবাই প্রকাশক্ষম নন, কেউ কেউ সেই অতুলনীয় যোগ্যতার অধিকারী হয়ে ওঠেন, নিজস্ব সত্তায় আর চর্চায়।
বলছি মিথুন আহমেদের কথা। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কিংবা শহীদজননী জাহানারা ইমামের একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের অহিংস সংগ্রাম—যুক্ত ছিলেন নানা কিছুতে। ছিলেন বলছি কারণ, এ ভূমির মেধাবী এই সন্তান দুই দশক ধরে বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু তারপরও স্বদেশ তাঁকে আঁকড়ে আছে, তাঁর চিন্তায়-মননে এবং অবশ্যই সৃষ্টিশীলতায়।
মিথুন আহমেদ
নানা মাধ্যমে কাজ করেন মিথুন আহমেদ। তবে এখন বলব তাঁর চিত্রকলা নিয়ে। (২২ নভেম্বর-০৫ ডিসেম্বর ২০১৫) আর্টকনের তত্ত্বাবধানে ধানমন্ডির গ্যালারি টোয়েন্টি ওয়ানে হয়ে গেল তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী। ‘আত্মবিভাজনের খেলা’ শিরোনামে এই প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত চিত্রগুলোয় মূলত শিল্পীর বিমূর্ত লক্ষণই প্রকাশিত। মিথুন এঁকেছেন জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিক, রেখাচিত্র ইত্যাকার নানা মাধ্যমে।
ছবির ক্যানভাসে লাল, সবুজ আর হলুদের প্রাচুর্য আমাদের মনের মধ্যে চিরায়ত বাংলার প্রকৃতির যে মৌলচিত্র, তার আভাস জাগায়। বোঝা যায়, স্থানিক দূরত্ব স্পর্শরহিত করে বটে, তবে মনের গমনাগমন তাতে থেমে থাকে না। রঙের এই সিম্ফনি কখনো কখনো বাংলার সংগ্রামী চৈতন্য আর মানবিক সৌন্দর্যের পাঠও হয়ে ওঠে যেনবা। কোনো কোনো চিত্রে আছে ক্রন্দনের আভাস। আর অপরাপর চিত্রভাষ্যে জেগে ওঠে নানা কালপর্বে আমাদের অন্ধকারযাত্রার কথা। ধর্মে-বর্ণে আর নানা জাতিগোষ্ঠীগত বিভাজন আমাদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে দীর্ঘ সময়। কখনো কখনো আমরা বোধ করেছি নিঃসীম একাকিত্ব আর বিষাদ।
মিথুন আহমেদের তুলি কিংবা কলমের আঁচড়ে জেগে ওঠা চিত্রে সেসব গুপ্তকথন লুপ্ত নয়, এসেছে নানা রঙে, বিচিত্র প্রকাশে। আত্মবিবেচনায় নয় মোটেও, মিথুনের চিত্রকর্ম দেখার পর স্বীয়বোধের তন্ত্রীতে বেজে উঠেছে নানাবিধ সুর। কারণ, কোনো কোনো শিল্প তীব্র ইন্দ্রিয়ের বাইরেও অন্য কোথাও আশ্রয় খোঁজে, সেখানেই ঘটে যায় বোঝাপড়া। অক্ষর কিংবা শব্দের ঝংকারে তার প্রকাশ ক্লিশে, বরং মনের মনোরম উদ্যানে তার নৃত্য অনেক বেশি তাৎপর্যময়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:১৯