somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নারী+পুরুষ= মানুষ

২৮ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


‘জনমাংক’ নাটকের একটি দৃশ্য

নাটক শুরু আগে বার বার মুঠোফোন বন্ধের অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হলো কয়েকজন দর্শকের মুঠোফোনের শব্দে। সেই অপ্রাপ্তমনস্ক জনাকয়েক দর্শকের অবিরল কথোপকথনের উজান ঠেলেই বন্দনা স্তোত্রের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করি দৃশ্যকাব্যে। মানে শুরু হলো নাটক।
সমুদ্রবেষ্টিত এক ছোট্ট জনপদের গল্প। একদিন সেখানে ধেয়ে আসে এক ভয়াল ঝড়-জলোচ্ছ্বাস। নিজেকে বাঁচাতে সবাই ছুটে চলে উঁচু স্থানের সন্ধানে। কিন্তু সেই উঁচু স্থানে জনপদের সবার ঠাঁই সম্ভব ছিল না। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যারা প্রয়োজনীয় শুধু তারাই আশ্রয় নেবে, আর অপ্রয়োজনীয় মানুষ (!) পাবে না আশ্রয়। অর্থাৎ নিশ্চিত মৃত্যু ঘটবে তাদের। প্রথমে বিত্তশালী ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হলেও কিছুক্ষণ পরই তা হয়ে ওঠে নারীবিরোধী। কারণ, গায়ের জোরে পুরুষ খানিকটা অগ্রসর। পুরুষেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওই জনপদের সব নারীকে ছুঁড়ে ফেলে সমুদ্রের জলে। এরপর উঁচু স্থানে নিজেদের আশ্রয় নিশ্চিত করে প্রাণ বাঁচায় পুরুষসম্প্রদায়। এ বাস্তবতায় এক গর্ভবতী নারী ছাড়া সেখানে আর কোনো মানবীর অস্তিত্ব নাই। ওদিকে ঝড়ও থেমে যায় একসময়, নেমে যায় জল। কিন্তু এর মধ্যেই জনপদটি তো নারীশূন্য, ক্রমশ সেখানে বাসা বাঁধে একঘেয়েমি।


‘জনমাংক’ নাটকের একটি দৃশ্য

পুরুষেরাও এ সময় বুঝতে পারে, মানবীহীন জীবন বিবর্ণ, অসহ্য। তারা প্রার্থনা করে নারীর জন্য। একযুগ পর আবার ভয়াল হয়ে ওঠে সমুদ্র। সবাই শুনতে পায় সমুদ্রদেবতার ফরমান- এক অপাপবিদ্ধ সদ্য হয়ে ওঠা নারীই কেবল পারে তাঁর রুদ্ররোষ থামাতে। তখনই জানা যায়, কাহিনির শুরুতে গর্ভবতী ছিল যে নারী, যথাসময়ে সে প্রসব করেছিল এক কন্যাসন্তান; এবং ওই মেয়েটিকে বড় করা হয়েছে ছেলে সন্তান হিসাবে। এই প্রেক্ষাপটে জনপদের পুরুষেরা এবার একতাবদ্ধ, বাঁচাবে মেয়েটিকে, দেবতার অন্যায় ইচ্ছার কাছে করবে না মাথা নত। মোটা দাগে এই হলো পদাতিক নাট্য সংসদের (টিএসসি) ৩২তম প্রযোজনা জনমাংক নাটকের কাহিনি। ২০১৫ সালের ৯ অক্টোবর শুক্রবার ঢাকা শহরের ট্র্যাফিক জ্যাম ঠেলে সন্ধ্যায় এই নাটকটি দেখতেই হাজির হয়েছিলাম জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হলে।
নাটকটির রচয়িতা নাসরীন মুস্তাফা সাফল্যের সঙ্গেই নারীহীন এক জনপদের স্থবির হয়ে পড়া অতঃপর শক্তিধর দেবতার বিরুদ্ধে মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদের চিত্রটি মেলে ধরতে পেরেছেন। সেই সঙ্গে শ্রেণী বৈষম্য, রাজনীতি আর নারী-পুরুষ ভেদাভেদ ইত্যকার বিষয়গুলো কখনো আভাসে আবার কখনো প্রকট হয়ে ডানা মেলেছে কাহিনিতে। পদ্যগন্ধী নাটকটির মধ্যে সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্যের ভাষামাধুর্যের আভাস রয়েছে। আর এ নাসরীনের সামর্থ্যেরই অভিজ্ঞান।


নাসরীন মুস্তাফা

নির্দেশক মীর মেহ্বুব আলম নাহিদ এই দৃশ্যকাব্যের সর্বত্র তাঁর নান্দনিক পরিকল্পনার ছাপ রেখেছেন। তিনদিক খোলা মঞ্চটি প্রায় নিরাভরণ ছিল। একটি খানিক উঁটু পাটাতন দৃশ্যত যা এক টুকরো ভূমির আদল গ্রহণ করে সেটি ছাড়া পুরো মঞ্চই ছিল ফাঁকা। পেছনে অর্থাৎ আপস্টেজে পলিথিনের বিন্যাসে আলোর ব্যবহারে সমুদ্রের অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেছেন নির্দেশক। পুরো মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত একটি ছিন্ন জালের টুকরো বারবার মনে করায়, এ জনপদের অধিবাসীরা মৎস্যজীবী। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক। তবে পরিবেশনায় একটি মাত্র দিককে অভিনয়শিল্পীরা বেশিমাত্রায় ব্যবহার করায় মঞ্চ পরিকল্পনায় তিনদিক খোলা রাখার যৌক্তিকতা খানিকটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। কারণ তাতে করে বিশুদ্ধ প্রসেনিয়াম মঞ্চে এটি পরিবেশিত হলে কী এমন ক্ষতি হতো তার উত্তর মেলে না। বিভিন্ন চরিত্র রূপায়নকারী মসিউর রহমান, শাখাওয়াত হেসেন, ওয়ালিদ, জিনিয়া, কামরুল, জনি, ইকরাম, শুভ, সুমন, চমক, শরিফ, ইমরান, সানজিদা, তুনাজ্জিনা ও স্বরূপ প্রত্যেকের মধ্যে সাবলিলতার ঘাটতি ছিল না বটে, তবে কারো কারো উচ্চারণের জড়তা সেই সঙ্গে দ্রুত বলে যাওয়ার তাড়া বোধগম্যতায় খামতির সৃষ্টি করেছে।


‘জনমাংক’ নাটকের একটি দৃশ্য

পুরুষ চরিত্রের পোশাক ছিল কাছা দেওয়া একরঙা সাদা লুঙ্গি, উর্ধাঙ্গ অনাবৃত; অন্যদিকে নারীরা পরেছিলেন মেটে রঙের শাড়ি। বেশ মানানসই পরিচ্ছদ। আবার স্বপ্ন আর তারুণ্যের প্রতীক হয়ে ওঠা সন্তান চরিত্রের কালো জামা, সবুজ পাজামার সঙ্গে বর্ণিল পাগড়ি এবং দেবতার রক্তবর্ণা পোশাকের পরিকল্পনা বহিরঙ্গিক ও অন্তর্গত তাৎপর্যের বিচারে উত্তীর্ণ। ধারণকৃত সংগীতের সঙ্গে সরাসরি বাদ্য ও গীতের ব্যবহারও মন্দ লাগেনি। কোরিওগ্রাফি বাহুল্যবর্জিত। আলোর প্রয়োগে ছিল পরিমিতি। ফলে একটি বিষয় সহজেই বোঝা গেল, মঞ্চে যান্ত্রিক কলাকৌশলের সমাবেশে কোনো মায়া সৃষ্টি করতে চাননি নির্দেশক। থিয়েটার বা নাট্যের প্রকৃত শক্তি অর্থাৎ কলাকুশলীদের অভিনয় ও দেহভাষার প্রতি আস্থা রাখতে চেয়েছেন তিনি। আর হ্যাঁ, নাট্যকারের মতো নির্দেশকও দর্শককে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দ্বিধায় রাখতে চাননি; বরং স্পষ্টতই জানিয়েছেন, এই পৃথিবী নারী বা পুরুষের শুধু নয়, নির্বিশেষে মানুষের। বোধের এ ঘাটতিটুকু আজও সভ্যতার এতো অগ্রসর সময়েও পৃথিবীর চোখে বেদনার কাজল হয়ে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×