উইলিয়াম শেক্সপিয়র
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালার লবিতে ততক্ষণে ঢাকা থিয়েটারের আয়োজনে লন্ডনের শেক্সপিয়রস গ্লোব থিয়েটারের সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়ে গেছে। গ্লোবের কয়েকজন কলাকুশলীকে পাশে নিয়ে সেই অনুষ্ঠান সঞ্চালন করছেন ঢাকা থিয়েটারের কর্ণধার নাসির উদ্দীন ইউসুফ। লবির পাশে সরু পথ দিয়ে এগোতেই দেখা গেল একজন বিদেশিনী সিঁড়িতে সেলফোন নিয়ে ব্যস্ত। একটু কাছে যেতেই আমার সঙ্গে চোখাচোখি। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত। মেয়েটির নাম বেকি। গ্লোবের কর্মী। আমি ওই মুহূর্তে ফিরে গেলাম তিন বছর আগে। শেক্সপিয়রস গ্লোব থিয়েটারে আমরা ঢাকা থিয়েটার যখন দ্য টেম্পেস্ট মঞ্চায়ন করেছিলাম, তখন ওই মঞ্চের নেপথ্যগৃহে যে কয়েকজনকর্মী প্রতিনিয়ত সাহায্য করেছিলেন, বেকি তাঁদের একজন। বেকি সহাস্যে জড়িয়ে ধরেন আমাকে। তিন বছর আগেকার সেই আন্তরিকতাই যেন ফিরে আসে আবার। মনে মনে তিনি আমাদের খুঁজছিলেন বলেও জানান। আমি বিস্ময় প্রকাশ করি তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ায়। কারণ, এ দলটিতে আসা তিনিই একমাত্র, যাঁকে আমরা পেয়েছিলাম লন্ডনে।
গ্লোবের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব হয় ২০১২ সালে। ওই বছর লন্ডনে খেলাধুলার সর্ববৃহৎ আসর অলিম্পিককে কেন্দ্র করে গ্লোব থিয়েটার আয়োজন করে এক অভিনব নাট্যোৎসবের। তারা সেই আয়োজনকে বলেছিল ‘নাট্য অলিম্পিক’। শেক্সপিয়ারের ৩৭টি নাটকের সবই ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় মঞ্চায়ন হয় লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী থিয়েটার গ্লোবে। বাংলা ভাষায় একমাত্র নাটকটি মঞ্চায়ন করে বাংলাদেশের ঢাকা থিয়েটার। এর মধ্য দিয়ে ৪০০ বছরেরও পুরোনো গ্লোব থিয়েটারে প্রথমবারের মতো মঞ্চায়িত হয় বাংলা ভাষায় কোনো নাটক। আমার অনুবাদ-রূপান্তরে নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। সেই থেকে সখ্যের শুরু।
ঢাকায় গ্লোব থিয়েটার পরিবেশিত ‘হ্যামলেট’ নাটকের একটি দৃশ্য
২০১৫ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যা ঠিক সাড়ে সাতটায় বাদ্যযন্ত্র আর কণ্ঠের যুগল উদ্বোধনে শুরু হয় গ্লোবের নাটক হ্যামলেট । সচরাচর পাশ্চাত্যের নাটকে যেমনটা দেখে থাকি, ধারণকৃত সংগীতায়োজনের মধ্য দিয়ে মঞ্চায়ন, এই নাটকটি তেমন নয়। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই বাদ্যযন্ত্রে সুর তোলার পাশাপাশি গানে কণ্ঠ দেন। বাংলাদেশের নাটকের দর্শকের কাছে এ তেমন অভিনব কোনো দৃশ্য নয়। কারণ দীর্ঘদিন ধরে গীতবাদ্যের মধ্য দিয়েই ঐতিহ্যনিঃসৃত আঙ্গিকে এই ভূখণ্ডে নাট্যাভিনয় চলছে আর দর্শক অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন তাতেই।
ঢাকায় গ্লোব থিয়েটার পরিবেশিত ‘হ্যামলেট’ নাটকের একটি দৃশ্য
কিন্তু চমৎকৃত হতে হয় তাঁদের অভিনয় এবং সংলাপ ছোড়ার পারঙ্গমতায়। প্রায় নির্ভুল কিউ আর সাবলীলতায় তাঁরা ভুলিয়ে দিয়েছেন ভাষার ব্যবধান। দর্শক কি আর জানে না হ্যামলেট নাটকের কাহিনি? এ কারণে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর কিংবা চরিত্রের চলন-বলন-ঘটনা—কোনো কিছুর বোঝাপড়াতে তেমন সমস্যা হয়নি কারও। হ্যামলেটের খানিক অসংলগ্ন আচরণ, বাবার আকস্মিক মৃত্যু (প্রকারান্তরে হত্যা), মাকে চাচার বিয়ে করা, প্রেমিকা ওফেলিয়ার সঙ্গে অসফল পরিণতি, ওফেলিয়ার অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়া, অতঃপর মৃত্যু। পিতৃহত্যার কাহিনি মঞ্চায়ন, পিতার হত্যাকারী প্রার্থনারত চাচা অর্থাৎ সৎ বাবাকে নাগালে পেয়েও প্রতিশোধ নিতে না পারা, তলোয়ার যুদ্ধের আয়োজন এবং হ্যামলেটকে বিষ মেশানো পানীয় পানের আহ্বান, সেই পানীয় পানে মায়ের মৃত্যু, সৎ বাবাকে জোর করে সেই বিষমিশ্রিত পানীয় খাইয়ে হত্যা, অতঃপর সেই বিষাক্ত পানীয় নিজে পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে হ্যামলেট—ইত্যাকার সবকিছুই নিরাভরণ আর স্বল্প আয়োজনে সহজে বুঝিয়ে দেওয়া গেছে।
লন্ডনের বিশ্বখ্যাত ‘গ্লোব থিয়েটার’
পুরোটা সময় মিলনায়তনের সব বাতি জ্বালানোই ছিল। নাটক মঞ্চায়নে ব্যবহার করা হয়নি বিশেষ কোনো লাইট। প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন আলোর এমন প্রয়োগ। গ্লোব থিয়েটার তাদের নাটকে কৃত্রিম অর্থাৎ স্পেশাল কোনো আলোর ব্যবস্থা রাখে না কখনো। কারণ শেক্সপিয়রের সময়ে ছিল না এখনকার মতো আলোর বিশেষ ইফেক্ট। অর্থাৎ মশাল কিংবা লণ্ঠনের আলোতে মঞ্চায়িত হতো নাটক। গ্লোব থিয়েটার অক্ষুণ্ন রেখেছে সেই ঐতিহ্য। এ কারণেই তাদের কোনো প্রযোজনাতেই আলোর চোখ ধাঁধানো প্রয়োগ নেই। সাধারণ দিনের আলোর আবহেই মঞ্চায়ন হয় নাটকের।
গ্লোবে ঢাকা থিয়েটার পরিবেশিত ‘দ্য টেম্পেস্ট’
এই নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনাটি করা হয়েছে গ্লোব থিয়েটারের মঞ্চ কাঠামোকে মাথায় রেখেই। আপ স্টেজের অর্থাৎ পেছনে একটি মাত্র প্রবেশ ও নির্গমন পথ। হালকা শেওলা বর্ণের মোটা কাপড়ে সেটের বিন্যাস। কেন যেন খানিকটা জাহাজের অভিজ্ঞতা দেয়। তবে কি নাটকটি বিশ্ব পরিভ্রমণরত হওয়ার কারণেই এই ইঙ্গিত! কিন্তু সেই জাহাজের রূপ আধুনিক নয়, একটু সাবেকি। সেটে বাক্স-পেটরা মনে করিয়ে দেয় ঢাকা থিয়েটারের দ্য টেম্পেস্ট নাটকের কথা। কারণ ওই নাটকেও সেট বলতে কয়েকটি ছোট ছোট ট্রাংক, যাতে ছিল রিকশা পেইন্টিংয়ের ব্যবহার। তখন আমার কেবলই স্মরণে আসে গ্লোবের পরিচালক ডমিনিক ড্রোমগুলের বলা কথাগুলো। ২০১২ সালের ৮ মে, গ্লোবে দ্য টেম্পেস্ট নাটকের দ্বিতীয় ও শেষ মঞ্চায়ন শেষে রাতের পার্টিতে তিনি বলেছিলেন, বিশ্বে দ্য টেম্পেস্ট নাটকের ২২ ধরনের মঞ্চায়ন তিনি দেখেছেন। কিন্তু তাঁর দেখা সেরা—ঢাকা থিয়েটারের এই অভিনয়। আর এই যে বিশ্ব পরিভ্রমণরত গ্লোব থিয়েটারের হ্যামলেট তার দুই নির্দেশকের একজন ডমিনিক ড্রোমগুল।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:০৭