লাদাখ ভ্রমণ - সবগুলো পর্ব
নুব্রা ভ্যালী
খারদুংলা তে গাড়ির দরজা খুলতেই ঠাণ্ডা একটা বাতাসের ঝটকা গায়ে লাগল। আমি মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে আর কানটুপি ঠিক করে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। এখানে প্রথম পা দেয়ার অনুভূতি ছিল অসাধারণ। নিজের ই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে আমি এভারেস্ট এর বেস ক্যাম্প এর সমান উচ্চতায় দাড়িয়ে আছি। আমি একাই আশে পাশে হেঁটে বেড়ালাম। যারা এখানে এসেছে তারা সবাই সাইনবোর্ড এর কাছে গিয়ে ছবি তুলতেছিল, এক একজন এক এক ভঙ্গিমায়। কোথাও বেড়াতে গেলে মানুষের এই বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলা দেখতে আমার খুবই ভালো লাগে। আমিও কয়েকটা ছবি তুলে সোহাগকে ডেকে এক বাটি নুডলস আনতে বলে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। ১০ মিনিট পর সবাই ফিরে আসলে আমরা নুব্রা ভ্যালী এর দিকে রওনা দিলাম।
খারদুংলা থেকে নামার পথে
খারদুংলা তে ওঠার রাস্তা শেষ দিকে যেমন খারাপ ছিল এখানেও তেমন নামার সময় রাস্তা ভয়ংকর খারাপ ছিল। হাতের বায়ে পাহাড়ের গায়ে বরফের পাতলা আস্তরণ দেখতে পেলাম। কাছ থেকে এটাই আমার বরফ দেখা। মিনিট পনের পর আমরা অনেকখানি নিচের দিকে চলে আসলাম এবং রাস্তা কিছুটা ভালো পেলাম। শরীফ গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। আমরা পেঁচানো পথ ধরে নামতে থাকলাম। প্রায় আধা ঘণ্টা পর আমরা নর্থ পুল্লু নামক একটা আর্মি চেক পোস্ট এর সামনে এসে থামলাম। নুব্রা ভ্যালী যাওয়ার পথে দুইটা চেক পোস্ট এ বিদেশীদের অনুমতি পত্র দেখাতে হয় এর একটা খারদুংলা এর আগে সাউথ পুল্লু এবং আর একটা খারদুংলা এর পরে নর্থ পুল্লু। আমরা শরীফ কে অনুমতি পত্রের ফটোকপি এবং আমাদের পাসপোর্ট দিলাম। কিছুক্ষণ পর শরীফ ফিরে আসলে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। আমি বসেছিলাম সামনে, পিছনে সবাই গল্প করতেছিল এবং আমি শুধু দুই পাশের প্রকৃতি গোগ্রাসে গিলছিলাম আবার মাঝে মাঝে পিছনে গল্পের সাথে যোগ দিচ্ছিলাম। সময় যে কখন পার হয়ে যাচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না। দুপুর ২ টার দিকে আমরা খারদুং নামক গ্রাম এ এসে খাবার বিরতি নিলাম রাস্তার পাশের এক দোকানে। এই গ্রামের নাম অনুসারেই ঐ চুড়ার নামকরণ হয়েছে।
নর্থ পুল্লু
খারদুং গ্রামটি আমার কাছে রুপকথার একটি গ্রাম মনে হয়েছে। রাস্তার পাশে পাহাড়ের কোলে উঁচু জায়গায় বাড়িঘরগুলো সুন্দরভাবে সাজানো, রাস্তার ওপাশে সবুজ শস্য এর সমতল ভূমি, তারপরে পাহাড়ি নদীর অবিরাম ছুটে চলা আবার মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা ধূসর পাহাড়গুলো। মনে হল যেন শিল্পীর হাতে আঁকা কোনও ছবি আমার স্বপ্নে এসে ধরা দিয়েছে। সমগ্র ট্যুর এ যে দুইটি গ্রাম আমার সব থেকে ভালো লেগেছে তার একটি হল এই খারদুং। আমি স্যুপ আর নুডলস অর্ডার দিয়ে দোকানের মালিকের সাথে গল্প করতে লাগলাম। আমরা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি শুনে তারা খুবই আশ্চর্য হল। ছোট একটা বাচ্চা ছিল যে কিনা বাংলাদেশের ক্রিকেটের খুব বড় ফ্যান। দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে হঠাৎ করে নিজের দেশের জন্য একটু মন কেমন করে উঠল।
খারদুং নামক রুপকথার গ্রাম
সবার খাওয়া শেষ করে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। আমরা যতই সামনে আগাই রাস্তাগুলি ততই অসাধারণ হতে থাকে। লাদাখের রাস্তার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমার সমস্ত শব্দ ভাণ্ডার ফুরিয়ে গেছে। শুধু নিজের মনের মধ্যে একটা দুঃখ জেগে উঠত, ওরা এত দুর্গম এলাকায় এত সুন্দর এবং মসৃণ রাস্তা করে রেখেছে আর আমরা আমাদের অসীম সৌন্দর্যের আধার বান্দরবানকে কাজেই লাগাতে পারছি না। কিছুদূর পর রাস্তা একটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে অনেক গুলো আঁকাবাঁকা পথে রূপ নিল, যার একপাশে খাদ আবার এক একটি বাঁক প্রায় ১৮০ ডিগ্রি। এভাবে চলতে চলতে একটা প্রায় ৯০ ডিগ্রি বাঁক নিয়ে আমরা নুব্রা ভ্যালীতে প্রবেশ করলাম। এখানে গাড়ি ঘুরতেই পাহাড়ের উপর থেকে শায়ক নদী এবং এর সৌন্দর্য দেখে সবাই একসাথে গাড়ি থামাতে বললাম। শরীফ রাস্তার পাশে গাড়ি থামাতেই আমরা হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। আধা ঘণ্টার মত সেখানে ব্যয় করে আর অনেকগুলো ছবি তুলে আমরা গাড়িতে উঠলাম।
নুব্রায় প্রবেশ মুহূর্ত
এবার কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি আবারো আঁকা বাঁকা পেঁচানো পথে নিচে নামতে থাকল। এই খানে একটা পথ উপর থেকে খুবই চমৎকার লেগেছে আমার কাছে। উপর থেকে রাস্তা টা দেখে আমার ডাল্টনের পরমাণুবাদ এর কথা মনে পরে গেল। বৃত্তাকার পথে ঘুরে ঘুরে যেভাবে ইলেকট্রন এর কেন্দ্রে মিলে যাওয়ার কথা কিন্তু কখনোই মিলে না, তেমনি আমাদের গাড়ি ও ঘুরতে ঘুরতে কেন্দ্রে চলে না গিয়ে তার পাশের রাস্তা ধরে বৃত্তাকার পথ থেকে বের হয়ে এল। আমরা উপত্যকার প্রায় নিচে চলে এলাম। আমাদের ডান পাশ দিয়ে শায়ক নামক পাহাড়ি নদী তীব্র গর্জন করে ছুটে চলেছে।
বিকেল প্রায় ৪ টার দিকে আমরা নুব্রার ডিস্কিট নামক গ্রামে পৌঁছে গেলাম। এখানে পাহাড়ের উপর একটা বৌদ্ধ উপাসনালয় আছে। রাস্তা থেকে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে স্থাপিত এই বিশাল উপাসনালয়টা দেখতে অসাধারণ লাগে। আমার ভাবতেই অবাক লাগে যে প্রায় ৭০০ বছর আগে এই রকম এক দুর্গম এলাকায় এরকম স্থাপনা কিভাবে তৈরি করেছিল। আর এত বছর পরেও এটা বহাল তবিয়তে টিকে আছে। আমরা গাড়ি থেকে নেমে কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। এরপর আমরা পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে এক বিশাল বুদ্ধ মূর্তি এর চত্বরে চলে এলাম। বুদ্ধ মূর্তি টার উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট এর বেশি এবং এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালে। মূর্তিটিকে পাহাড়ের উপর এ পাকিস্তান এর কারাকোরাম রেঞ্জ অভিমুখে স্থাপন করা হয়েছে এই ভেবে যে, পাকিস্তান এর সাথে যেন এদিকে আর যুদ্ধ না লাগে।
ডিস্কিট মনেস্টারি
১০৬ ফুট উঁচু বুদ্ধ মূর্তি
পাহাড়ের উপর থেকে সমগ্র নুব্রা ভ্যালী দেখতে অপার্থিব মনে হচ্ছিল। বিকেলের সূর্যের আলোয় দূরের পাহাড় চূড়া গুলো সোনালী রঙ ধারণ করেছে, পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা নুব্রা নদীর দুই পাশে সবুজ বৃক্ষের সমারোহ, হাতে আঁকা ছবির মত নীল আকাশে মেঘের ভেলা আর সেই সাথে হিমেল বাতাসের ছোঁয়া যেকোনও মানুষের মনকে এলোমেলো করে দিতে এক মুহূর্ত সময়ও নেবে না। আমার কাছে লাদাখের অন্যতম প্রধান আকর্ষণই মনে হয় এই অনন্য নীল আকাশ এবং পাহাড়ের গায়ে মেঘের ছায়া। সময় স্বল্পতার কারণে আমরা আর মনেস্টারি এর ভিতরে গেলাম না। এবার আমরা রওনা দিলাম নুব্রা ভ্যালী এর আর একটি গ্রাম হান্ডার এর উদ্দেশ্যে।
ডিস্কিট এর পাহাড় চূড়া থেকে নুব্রা ভ্যালী
হাসির কারণটা মনে নেই কিন্তু হাসিগুলো রয়ে গেছে
ডিস্কিট থেকে হান্ডার প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। হান্ডার এ গিয়ে আমরা প্রথমেই নুব্রার বিখ্যাত বালিয়াড়ি যা স্যান্ড ডিউন্স নামে পরিচিত সেখানে চলে গেলাম। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল এই ছোট মরুভূমি সদৃশ বালিয়াড়িতে দুই কুজ বিশিষ্ট উট এর পিঠে ঘুরে বেড়ানো। এই দুই কুজ বিশিষ্ট উটগুলো সাধারণত মঙ্গোলিয়া, কাজাখাস্তান এবং এই নুব্রা ভ্যালীতেই দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন সিল্ক রুট এ সকল উটের পিঠে করেই বণিকরা দেশান্তরে ব্যবসার জন্য মালামাল বহন করত। আমাদের উটের পিঠে উঠার খুব ইচ্ছে থাকলেও মাত্র একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে এই জন্য ৩০০ রুপি অতিরিক্ত মনে হল। তাই আমরা পাঁচ জনই এই প্ল্যান বাদ দিলাম। আমরা ওখানে হেঁটেই এক মাথা থেকে আর এক মাথায় চলে গেলাম, বালির মধ্যে গড়াগড়ি খেলাম, প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা দিলাম। নুব্রার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০০০০ ফুট এর থেকে বেশি হলেও আমার কাছে সমতলের মত মনে হল। এটা আমি আবার সোহাগকে বলেওছিলাম যে, যখন মানুষ ১৮০০০ ফুট উচ্চতা থেকে ১০০০০ ফুট এ নেমে আসে তখন ১০০০০ ফুট উচ্চতাও সমতল মনে হয়।
দুই কুজ বিশিষ্ট উট
হান্ডার এর স্যান্ড ডিউন্স
সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে আমরা আবার হান্ডার গ্রামে ফিরে আসলাম। শরীফ প্রথমে একটা গেস্ট হাউজ এ নিয়ে গেল, কিন্তু ওটায় আমাদের জন্য পর্যাপ্ত রুম ফাঁকা ছিল না, পরে oldgok guest house নামে আর একটা গেস্ট হাউজ এ নিয়ে গেল। ওখানে আমরা জনপ্রতি ৬০০ রুপিতে রাতের খাবার এবং সকালের নাস্তা সহ এক রাতের জন্য তিনটা রুম নিয়ে নিলাম। আমার ধারণা ছিল এই রকম দুর্গম এলাকায় রুম ভাড়া নিশ্চয়ই অনেক বেশি হবে। কিন্তু এত সস্তায় পেয়ে যাব এটা ছিল আশার বাইরে। আর একটা ব্যাপার আমাকে খুবই অবাক করেছে যে এই রকম দুর্গম এলাকায়ও প্রত্যেকটা গেস্ট হাউজ এ ফ্রি ওয়াইফাই ছিল, যার স্পীড ও অনেক বেশি। এসকল কারণেই ভারত পর্যটন এ আমাদের থেকে যোজন যোজন এগিয়ে আছে।
গেস্ট হাউজের বাগান থেকে
গেস্ট হাউজটা আমাদের সবার কাছেই খুব ভালো লেগেছিল। সামনে বাগানে আপেল সহ বিভিন্ন ফুলের গাছ ছিল। আর সন্ধ্যায় গেস্ট হাউজ এর ছাদ থেকে দুই পাহাড়ের মাঝ থেকে মেঘের লুকোচুরির মধ্যে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত সমগ্র উপত্যকাকে উপন্যাসের কোনও পটভূমি মনে হল, যা কেবল লেখকের কল্পনায় সম্ভব। সেদিন রাতে ঐ গ্রামে একটা স্থানীয় সাংস্কৃতিক উৎসব চলছিল। সন্ধ্যার পর সোহাগ, মঞ্জুনাথ এবং ভাস্কর গেল ওখানে। আমি বাগানে বসে রাতের নিস্তব্ধতা উপভোগ করছিলাম। এক ঘণ্টা পর ওরা ফিরে এলে আমরা রাতের খাবার খেয়ে প্রায় ১১ টা পর্যন্ত বাইরে আড্ডা আর গল্প করে অসাধারণ একটা দিন শেষ করলাম।
গেস্ট হাউজের ছাদে চাঁদকে ক্যামেরায় ধরার চেষ্টা
বাগানে বসে মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি দেখা
নিচে আরও কিছু ছবি
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:৫৯