লাদাখ ভ্রমনঃ(৬ষ্ঠ পর্ব) – সোলাং ভ্যালী এবং রোথাং পাস এর অপূর্ণতা
লাদাখ ভ্রমণ - সবগুলো পর্ব
মানালি থেকে লাদাখ এর শহর লেহ এর দূরত্ব প্রায় ৪৭০ কিলোমিটার। এই রাস্তা সাধারণত এক দিনে যাওয়া সম্ভব হয় না। মানালি থেকে যারা লেহ শহরে যায় তারা সবাই সাধারণত তিনটা জনপদের যে কোনও একটায় এক রাত অবস্থান করে। এগুলো যথাক্রমে কিলং, জিস্পা এবং সারচু জনপদ। এর মধ্যে কিলং আর জিস্পা তেই অধিক সংখ্যক লোক অবস্থান করে।
আমরা যখন গাড়ি ঠিক করছিলাম তখন আমাদের কে সবাই বলেছিল যে জিস্পা তে থাকতে, কারন তাহলে আরো ২০ কিলোমিটার সামনে এগিয়ে থাকা যাবে, এছাড়া জিস্পা ভাগা নদীর তীরে অনেক নিরবিলি একটা শহর। কিন্তু আমরা কিলং এ থাকব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। এর কারণ ছিল কিলং এ ১৪ থেকে ১৬ আগস্ট ওদের বাৎসরিক ট্রাইবাল উৎসব চলছিল এবং আমরা কোনভাবেই তা মিস করতে চাই নাই। মানালি থেকে কিলং এর দূরত্ব ১১৫ কিলোমিটার। আমাদের পরিকল্পনা ছিল দুপুরের মধ্যে কিলং পৌঁছে ঘুরে বেড়াব। কিন্তু বৈরি আবহাওয়া এবং রোথাং পাস এর আগে ভূমিধ্বস এর কারণে আমাদের পরিকল্পনায় গুড়েবালি। তার উপর আবার রোথাং পাস এ কোনও বরফ ও পাই নাই এবং ঐখানে বৃষ্টির কারণে নামতেও পারি নাই।
খোকসার যাওয়ার পথে রোথাং পাস এর পরে
রোথাং পাস এ নামতে না পারার দুঃখ নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম আজকের গন্তব্যের দিকে। ভাঙা রাস্তা দিয়ে গাড়ি ক্রমান্বয়ে নিচে নামতে লাগল। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর আমরা খোকসার নাম এ একটা জনপদ এ গিয়ে পৌঁছাই। এখানে আমরা গাড়ি থেকে নেমে চা খেলাম। এতক্ষণে বৃষ্টি একেবারে কমে গেছে। খোকসার এর পাশ দিয়ে চেনাব নদী বয়ে গেছে। আরও একটি পাহাড়ি নদী এবং তার তীব্র স্রোত আমাকে আনমনা করে দিল। চা খেতে গিয়েই প্রায় ১৫ মিনিট পার হয়ে গেল। ড্রাইভার এসে তাড়া দিয়ে গেল যে দেরি হয়ে যাচ্ছে, না হলে সন্ধ্যার আগে গিয়ে পৌঁছাইতে পারবো না। অগত্যা কি আর করা, উঠতে হল।
খোকসার
চা এর দোকানের জানালা থেকে আমি
নদীর উপরে একটা সেতু আছে, যা আমাদের পার হতে হবে। সেতু পার হওয়ার পর রাস্তা খুব ই চমৎকার পেলাম এবং গাড়ি খুব দ্রুত চলতে লাগল। হাতের বাম এ পাহাড়ি নদীটি এবং ডান পাশে বিশাল সব পাহাড়ের মাঝ দিয়ে আমরা চলতে থাকলাম। ডান পাশে একটা পাহাড়ের চূড়ায় অল্প কিছু বরফ জমে ছিল, এত কাছাকাছি বরফ দেখা আমার জন্য এই প্রথম। আমি খুব উৎসাহী হয়ে ছবি তুললাম। কিছুদূর গিয়ে হাতের ডান পাশে পাহাড়ের উপর থেকে একটা ঝর্ণা দেখতে পেলাম। আমরা ঐখানে গাড়ি থেকে ছবি তুললাম।
খোকসার থেকে কিলং এর পথে
এভাবে চলতে চলতে একসময় আমরা চন্দ্রভাগা সঙ্গম এর নিকট এ পৌঁছে গেলাম। এই জায়গায় এসে চেনাব এবং ভাগা নদী মিলিত হয়েছে। আমরা যখন ঐখানে পৌঁছাই তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা। তাই আমরা আর গাড়ি থেকে নামি নাই। এবং আমাদের ড্রাইভার তাশি জানায় যে সে কখনও কিলং এ যায় নাই। কিলং ঠিক মত চিনে না। তখন সূর্য অস্ত গিয়েছে এবং আমরা সন্ধ্যার আলো আধারি তে ছুটে চলেছি। বাকি দুইজন আমার দিকে তাকালো। আমি কি বলব খুঁজে পাচ্ছিলাম না, এমনিতেই আমার হিন্দি যথেষ্ট খারাপ আবার ঠিক মত বুঝিও না। আমি খোকনকে বললাম ড্রাইভার যেন চলতে থাকে, আমার যত দূর মনে পরছিল যে ঐ রাস্তা সোজা কিলং এর দিকেই গেছে। এক সময় অন্ধকার হয়ে এল এবং আমি অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তায় চিন্তা করতে থাকলাম যদি রাস্তা ভুল হয় তাহলে কি হবে। অবশ্য তেমন ভয় ও লাগছিল না, কারণ সামনে পিছনে কয়েকটা গাড়ি ও ট্রাক ছিল।
চন্দ্রভাগা সঙ্গম
এভাবে চলতে চলতে প্রায় সাড়ে ৭ টার দিকে আমরা কিলং এর কাছাকাছি চলে এলাম। রাস্তার পাশে এক দোকানে জিজ্ঞেস করে কিলং বাস স্ট্যান্ড এ আমরা যখন পৌঁছে গেলাম তখন প্রায় পৌনে ৮ টা বাজে। আমরা কোথাও কোনও হোটেল বুক করে যাই নাই। এবার শুরু হল হোটেল খোঁজার পালা। কিন্তু আমরা আধা ঘণ্টা খুঁজেও কোনও হোটেল এ রুম খালি পেলাম না। একবার চিন্তা করছিলাম যে জিস্পা চলে যাব নাকি, কারণ বাৎসরিক ট্রাইবাল অনুষ্ঠানের জন্য এখানে কোনও হোটেল ফাঁকা নেই। এর মধ্যে দেখলাম দুইজন ইন্ডিয়ান ছেলে কথা বলতে বলতে যাচ্ছে যে উপরের দিকে একটা হোটেল এ রুম পাইছে। ওরাও আমাদের মত রুম খুঁজছিল। আমি শেষ চেষ্টা হিসেবে ওদের পিছু পিছু গেলাম এবং ঐ হোটেল এ ১৫০০ রুপি তে একটা রুম পেয়ে গেলাম। দুই জনের জন্য রুম এবং অতিরিক্ত ম্যাট্রেস ও দিবে না। আমরা তারপর ও নিয়ে নিলাম কারণ হোটেল তো পাওয়া গেল।
এই হোটেলেই রাত যাপন এর সুযোগ পেয়েছিলাম
কিলং প্রায় ১০০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত একটি পাহাড়ি জনপদ, যা হিমাচল প্রদেশের অন্তর্গত। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে বাড়িঘর নিয়ে এই ছোট শহরটি গড়ে উঠেছে। তাই এখানে চলাচল করতে গেলে বারবার উপরে উঠতে হয় আর নিচে নামতে হয়। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা অনুষ্ঠান দেখতে শহরের নিচে চলে গেলাম, কারণ আমাদের হোটেল ছিল একেবারে উপরে। একটা খোলা মাঠের মধ্যে মঞ্চ সাজিয়ে অনুষ্ঠান চলছিল। এবং সামনে সবাই চেয়ার এ বসেছিল। কেউ কেউ আবার পিছনে মাঠের গ্যালারী তে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছিল। একদল ছেলে আবার মঞ্চের পাশে গানের তালে নাচতেছিল। এটাও আমার দেখা প্রথম ট্রাইবাল অনুষ্ঠান, তাও আবার দেশ থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে ভিনদেশের মাটিতে। হটাৎ ঘড়িতে দেখলাম যে ১০ টা বেজে গেছে এবং তখন ও রাতের খাওয়া হয় নাই।
কিলং শহরের লোকজ উৎসব
আমরা অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে দেখলাম খাবার দোকান সব বন্ধ হয়ে গেছে, অগত্যা কিছু শুকনা খাবার আর পাহাড়ি খোবানি কিনে আমরা হোটেল এ আসলাম। হোটেল এ এসে ভাবলাম একটু খোঁজ নিয়ে দেখি খাবার পাওয়া যায় কি না। ওরা জানাল যে খাবার অর্ডার দিলে বানিয়ে দিবে। আমি আর খোকন রুটি আর পনির বাটার মাসালা অর্ডার দিলাম। রাত ১১ টার দিকে খেয়ে রুম এ যখন আসলাম তখন ও নিচ থেকে অনুষ্ঠানের গানের শব্দ কানে আসছিল। আমি বারান্দায় গিয়ে বসলাম, মেঘমুক্ত আকাশে রুপালি চাঁদের আলো পর্বতের চূড়ায় এসে এক অপার্থিব অবয়ব এর সৃষ্টি করেছিল, সেই সাথে শীতল বাতাস। আহা! জীবন বড়ই সুন্দর এবং বিচিত্র।
সকালে হোটেলের বারান্দা থেকে কিলং এর রূপ
লাদাখ ভ্রমনঃ(৮ম পর্ব) – লেহ এর পথে-স্বপ্নযাত্রার পূর্ণতা
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৭ রাত ১১:১৫