লাদাখ ভ্রমন(৫ম পর্ব): হিমাচলের প্রাণ অপরুপা মানালি
লাদাখ ভ্রমণ - সবগুলো পর্ব
মানালির প্রতিটা সকাল যেন ভিন্ন ভিন্ন রুপ নিয়ে আসে। দিনের শুরুটা এত বর্ণিল হতে পারে তা এখানে আসলে ভালো মতো উপলব্ধি করা যায়। সূর্য ওঠার সাথে সাথে সকাল ৮ টা বা ৯ টা পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে এর সৌন্দর্য বদলায়। যথারীতি আজ ও সকালে ঘুম থেকে উঠেই বারান্দায় গিয়ে অনেকটা সময় চুপ করে বসে রইলাম। মনটা একটু খারাপ লাগছিল যে আজই এত মায়াবী একটা শহর থেকে চলে যাব।
সকালের মানালি শহর
সকাল ৮ টা বাজে রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে নিচে পাউরুটি, ডিম দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। আমাদের কে কুশাল বলেছে সকাল ৯ টা বাজে ওনার অফিস এ যেতে। আমি আর সোহাগ চিন্তা করে দেখলাম তখন ও বনবিহার টা দেখা বাকি আছে এবং আমাদের হাতে সময় আছে ১ ঘণ্টা। আমরা দুইজন নাস্তা করেই বনবিহার এর দিকে হাঁটা দিলাম। বনবিহার ম্যাল রোডের পাশেই বিয়াস নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থিত। বনবিহার দর্শনার্থীদের জন্য খোলে সকাল ৯ টায়, আর আমরা বনবিহার এর গেট এ গিয়ে পৌঁছাই সাড়ে ৮ টায়। আধা ঘণ্টা আর কি করবো, আমরা একটু হাঁটাহাঁটি করলাম এবং কুশাল ভাই কে ফোন দিলাম যে আমাদের গাড়ি কখন আসবে? কুশাল ভাই জানালো যে ১০ টা বাজে গাড়ি আসবে, আমরাও খুশি মনে ৯ টা বাজে ২০ রুপি দিয়ে বনবিহার এ প্রবেশ করলাম।
বনবিহার
বনবিহার মূলত এক কিলোমিটার লম্বা একটি উদ্যান, যেখানে আকাশ ছোঁয়া সব পাইন গাছের সারি, মাঝে অল্প কিছু রাস্তা। আমাদের হাতে বেশি সময় ছিল না এবং একজন স্থানীয় লোকের সাথে কথা বলে জানলাম যে, পুরোটাই এই রকম পাইন গাছের সারি। আমরা কিছুক্ষণ হেঁটে ভিতরের দিকে গেলাম। আমার কাছে এটা তেমন কোনও আহামরি লাগে নাই। সকাল প্রায় পৌনে ১০ টায় আমরা হোটেল এ ফিরে আসলাম। আমি সকালে বের হবার আগেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে সবাই নিচে নেমে আসলাম। হোটেল এর বিল পরিশোধ করে আমরা ম্যাল রোড এর দিকে হাঁটা দিলাম। কুশাল ভাই এর অফিস এ গিয়ে শুনলাম যে তখন ও রোথাং পাস যাওয়ার অনুমতি পত্র এর জন্য কুশাল ভাই জেলা অফিস এ আছেন। আমরা প্রায় ৩০ মিনিট এর মতো বসেছিলাম। কুশাল ভাই যখন আমাদের জন্য অনুমতি পত্র নিয়ে ফেরত আসলেন তখন বেলা প্রায় ১১ টা বাজে। আসলে ঐদিন ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস এবং সরকারি ছুটির দিন। তাই অনেক ভিড় ছিল। কুশাল ভাই গাড়ির ড্রাইভার এর সাথে আমাদের কে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর আমরা ঐখান থেকে বিদায় নিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এ চলে আসি।
মানালি থেকে আমরা রওনা দেই ১১ টা ১৫ মিনিটে এবং আমাদের বিদায় দেয়ার জন্য পুরো আকাশ বেদনার নীল রঙ ধারণ করে আছে। আমাদের প্রথম গন্তব্য বিখ্যাত সোলাং ভ্যালী। আমরা যখন ট্যাক্সি ঠিক করেছিলাম তখনই কথা বলে নিয়েছিলাম যে, আমাদের কে প্রথম সোলাং ভ্যালী নিয়ে যাবে, তারপর রোথাং পাস হয়ে আমরা কিলং এ এক রাত থাকব, এবং পরের দিন আমাদের কে লেহ নিয়ে যাবে। আমাদের ড্রাইভার এর নাম ছিল তাশি। আমরা তাশির সাথে একটা বিশাল ইনোভা গাড়িতে করে তিনজন ছুটলাম সোলাং ভ্যালী এর উদ্দেশ্যে। ইনোভা গাড়িটাকে বিশাল বললাম কারণ এই গাড়িতে ৭ জন ভালোভাবে বসা যায়, ৫ জন আরাম করে বসা যায়, কিন্তু আমরা ৩ জন ছিলাম মাত্র।
সোলাং ভ্যালীর পথে
সোলাং ভ্যালী মানালি ম্যাল রোড থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি মূলত শীতকালে স্কিইং এবং প্যারাগ্লাইডিং এর জন্য বিখ্যাত। মানালি থেকে বের হয়ে হাতের বাম পাশে বিয়াস এর বয়ে চলা দেখতে দেখতে আমরা ২০ মিনিটের মধ্যে সোলাং ভ্যালী পৌঁছে গেলাম। যে ভ্যালী টা শীতে বরফ দিয়ে ঢাকা থাকে, সেখানে সবুজ ঘাসের চাঁদর। আমরা কিছুদূর হেঁটে মূল ভ্যালী তে চলে গেলাম, যেখানে প্যারাগ্লাইডিং করা যায়। আমার ইচ্ছা ছিল প্যারাগ্লাইডিং করার, কিন্তু গিয়ে দেখলাম যে খুব অল্প সময়ের জন্য ১০০০ রুপি চাইতেছে, আর বেশি উঁচু থেকেও না। আমাদের সামনে একজন করল মাত্র ১ মিনিটের মাথায় নিচে নেমে এল। তাই প্যারাগ্লাইডিং এর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আমরা গেলাম রোপওয়ে এর কাছে। কিন্তু এখানেও আমাদের আশা পূরণ হল না। কারণ রোপওয়ের টিকেট এর দাম ৮৫০ রুপি করে। আসলে এটা মূলত স্কিইং এর জন্য, ৮৫০ রুপি তে সারাদিন যত খুশি তত ওঠা যায়। কিন্তু আমরা তো একবার এর জন্য এতগুলো টাকা খরচ করতে রাজি নই। যাই হোক আমরা ফেরার পথ ধরলাম। তবে ফেরার আগে একটা টানেল নির্মাণ এর কাজ দেখলাম। টানেলটার নাম রোথাং টানেল, যা নির্মাণ করা হলে কিলং বা সারচু যাওয়ার জন্য আর রোথাং পাস পার হওয়া লাগবে না। এটি সম্ভবত ভারতের সর্ববৃহৎ টানেল হবে। আমরা আর বেশি সময় ঐখানে নষ্ট না করে রোথাং পাস এর উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলাম।
সোলাং ভ্যালী এবং প্যারাগ্লাইডিং
সোলাং ভ্যালী থেকে বের হয়ে আমরা ক্রমাগত উপরের দিকে উঠতে থাকলাম। এ সময় অনেক লোক দেখলাম সাইকেল চালিয়ে রোথাং এর দিকে যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর আমরা যানজটের কবলে পরলাম। আগেই বলেছি যে ঐদিন ছিল ভারতের জাতীয় দিবস এবং সরকারি ছুটির দিন। আমার মনে হল পুরো মানালি যেন রোথাং পাস এর দিকে ছুটে চলছে। আমি গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম, এই রকম রাস্তায় হাঁটতেও আনন্দ। প্রথমে ভেবছিলাম সামনে মনে হয় কোনও ভূমিধ্বস হয়েছে, কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে অনেক টা দূর গিয়ে দেখলাম যে ঐখানে একটা চেকপোস্ট আছে, যেখানে সকল গাড়ির অনুমতি পত্র চেক করে দেখা হচ্ছে। এবং রাস্তায় প্রায় ২ কিলোমিটার এর লম্বা যানজট হয়ে গেছে। প্রায় ১ ঘণ্টা পর আমাদের গাড়ি এসে পৌঁছায়। তাশি অনুমতি পত্র দেখিয়ে চেক পোস্ট থেকে বের হলে আমরা গাড়িতে উঠলাম। দূরে অন্যান্য গাড়িগুলোকে দেখা যাচ্ছিল উপরের দিকে উঠে যাচ্ছিল। এখান থেকে মূলত লুপ বেয়ে ওঠা শুরু হয়। আমরা চারপাশ দেখতে গিয়ে এতই বিমোহিত ছিলাম যে ছবি তুলতেই ভুলে গিয়েছিলাম। পুরো ট্যুরেই অনেকবার এই রকম হয়েছে।
রোথাং পাস এর পথে
আমরা প্রায় ১ টার দিকে মারহি নামক একটা অস্থায়ী বাজার এ পৌঁছালাম। এখানে অনেকগুলো খাবার এর দোকান আছে। আর আছে একটা মন্দির। প্রথমে আমরা মন্দির এর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে যেতে পারি নাই। এখানে আমরা রুটি আর পনির বাটার মসলা দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের ড্রাইভার তাশি এসে তাড়া দিল যে, আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করেছে তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হবে। আসলে মারহি এর উচ্চতা ১১২০০ ফুট এবং আমরা পৌঁছানোর পর ঠাণ্ডা দেখছিলাম, তাই আমাদের কাছে আবহাওয়া নিয়ে তেমন কিছু মনে হয় নাই। এছাড়া আমার জীবনের প্রথম এত উচ্চতায় অবস্থান করা, তাই মনে মনে অনেক উত্তেজিত ছিলাম।
মারহি বাজার এর আশে পাশে
আমরা ড্রাইভার এর কথা শুনে দ্রুত খাবার খেয়ে গাড়িতে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরে আমরা মেঘের ভিতরে প্রবেশ করলাম। সামনের গাড়িও দেখা যাচ্ছে না, মেঘের মধ্য দিয়ে। কয়েকটা লুপ উঠে আমরা আবার যানজট এ পড়লাম। গাড়ি থেকে নেমে বুঝার চেষ্টা করলাম যে কি হইছে, কিন্তু বুঝার কোনও অপশন নাই। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসে জ্যাকেট আর কানটুপি বের করে বাইরে হাঁটাহাঁটি করলাম। কিন্তু আমাদের হাঁটাহাঁটি বন্ধ করে দিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। আমরা আবার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। বৃষ্টি যখন প্রায় শেষের দিকে তখন গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। আমরা যখন যানজট এর কারণটাকে পাশ কাটিয়ে এলাম তখন আসলে ভয় ই লেগেছিল। গাড়ি পুরো স্পীড এ চলতে শুরু করল আর বেরসিক বৃষ্টি আবার শুরু হল। ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা রোথাং পাস পৌঁছে গেলাম। কিন্তু বাইরে তখন ও প্রচণ্ড বৃষ্টি। আমরা আরও ১০ মিনিট অপেক্ষা করলাম বৃষ্টি কমার। কিন্তু বৃষ্টি যেন আমাদের অপেক্ষার সাথে সাথে ঝড়ো বাতাস সহ পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল। মানালি যাওয়ার আগে গল্প শুনেছিলাম যে, রোথাং পাস এ সারা বছর ই বরফ থাকে, কিন্তু আমরা বরফ এর কিছুই দেখতে পেলাম না। অবশ্য দূরের পাহাড় চূড়ায় অল্প কিছু বরফ দেখা গেলেও রোথাং পাস এর আশে পাশে কোনও বরফ পেলাম না। আমরা বৃষ্টির মধ্যে আর নামতে পারলাম না।
মেঘের ভেতর দিয়ে চলা
মেঘ মুক্ত রাস্তা (নেট থেকে সংগৃহীত)
রোথাং পাস
রোথাং থেকে নিচে নামার সময়
হিমালয়ের রাস্তাগুলোতে কোনও পাস বা টপ মানে হল এটা ঐ রাস্তার সব থেকে উঁচু জায়গা। এর আগে বা পরে উচ্চতা কমতে থাকবে অর্থাৎ নিচের দিকে নামতে হবে। রোথাং পাস এর উচ্চতা হল ১৩০৫৮ ফুট। আমরা এবার নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম। রাস্তার এই অংশের অবস্থা খুব ই খারাপ ছিল। তাশি ধীরে ধীরে অনেক ধৈর্য নিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল। অনেক জায়গায় রাস্তা ভাঙ্গাও ছিল সেই সাথে প্রায় ১৮০ ডিগ্রি বাঁক, দুই পাশে মাথা উঁচু করা আকাশ ছোঁয়া পর্বত সারি, নিচে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী, কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে ঝুম বৃষ্টি। আমার মনে হচ্ছিল স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কোনও মায়াবী পথ ধরে ছুটে চলেছি। যে পথের শেষ হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।
মায়াবী পথ ধরে ছুটে চলা
আরও কিছু ছবি
রোথাং টানেল এর কাজ চলছে
লাদাখ ভ্রমনঃ(৭ম পর্ব) – হিমাচলের ছোট কিলং শহরে
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৭ রাত ১১:১৩