লাদাখ ভ্রমণ - ৪র্থ পর্ব
লাদাখ ভ্রমণ - সবগুলো পর্ব
শিমলা পাহাড়ের উপরের একটা শহর হলেও মানালি একটা উপত্যকা শহর। দুই পাশে উঁচু পাহাড় এবং পাশ দিয়ে বয়ে চলা খরস্রোতা বিপাশা নদী, মাঝে স্বপ্নের মতো সাজানো একটা শহর। শিমলা থেকে মানালির দূরত্ব ২৮০ কিলোমিটার এর কাছাকাছি এবং বাস এ প্রায় ১০ ঘণ্টার মতো লাগে।
আমরা তিন বন্ধু লাদাখ যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকা থেকে দিল্লী, কালকা, শিমলা হয়ে মানালি এসে পৌঁছাতে সময় লাগে ৪ দিন। ট্যুর শুরু করার পর মানালি তে এসে প্রথম বার এর মতো আমরা এক দিন বিশ্রাম পাই। মানালিতে আমরা যখন পৌঁছাই তখন প্রায় সন্ধ্যা। মানালিতে তখন বর্ষাকাল, আমরা আসার আগে টানা ৩-৪ দিন এর মতো বৃষ্টি হয়েছে, যা আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় এর রুমমেট এর কাছে জানতে পেরেছিলাম। ওরা আমি যাওয়ার ৭ দিন আগে মানালির হাম্পতা পাস ট্রেক এ গিয়েছিল। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল আমরা যে দুই দিন মানালি তে ছিলাম তেমন বৃষ্টির কবলে পরি নাই এবং মানালি মোটামুটি ঘুরতে পেরেছি।
মানালিতে প্রথম দিন সন্ধ্যাবেলা আমরা শুধু ম্যাল রোড এ হেঁটে বেরিয়েছিলাম এবং পরেরদিন এর জন্য আমাদের কোনও নির্দিষ্ট প্ল্যান ছিল না। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম, দূরের পর্বতগুলো মনে হচ্ছিল কোনও শিল্পীর আঁকা ছবি। বাইরে বের হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও আবার কেন জানি ঘুমাতে চলে গেলাম। সকাল ৮ টা বাজে ঘুম থেকে উঠে বাইরে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। আমাদের হোটেল এর নিচে একটা চায়ের দোকান ছিল। ওখানে চা আর নাস্তা খেতে খেতে দোকান এর চা বিক্রেতার সাথে আমি আর সোহাগ গল্প করতে গিয়ে একটা ঝর্ণার কথা জানতে পারলাম। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে সকালে ঐ ঝর্না দেখতে যাব। তার কাছ থেকে কিভাবে যেতে হয় তা জেনে নিয়ে আমরা রুম এ চলে আসলাম।
সকাল বেলা হোটেল এর বারান্দা থেকে
সকাল বেলার ম্যাল রোড
ভাসিস্থা মন্দির এর পথে
আমরা রুম থেকে বের হয়ে ম্যাল রোড এর পিছনে গিয়ে ১০০ রুপি করে একটা অটো নিলাম ভাসিস্থা মন্দির এর জন্য। আমরা যে ঝর্না দেখতে যাব তার নাম যোগিনী ঝর্না এবং তা মন্দির এর পাশ দিয়ে যেতে হয়। ম্যাল রোড থেকে মন্দির এর সামনে পর্যন্ত যেতে ১০ মিনিট এর মতো সময় লাগে। আমরা মন্দির এর সামনে নামলাম, কারণ এর পর আর অটো যেতে দেয় না। মন্দির টি পাহাড়ের উপর মাঝামাঝি অবস্থিত, যে কেউ চাইলে হেঁটেও যেতে পারবে। কিন্তু উপরে উঠতে হবে বলে একটু কষ্ট হবে। ১০-১৫ মিনিট মন্দির এর আশে পাশে ঘুরে দেখলাম, তারপর স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞেস করে যোগিনী ঝর্নার রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলাম।
ভাসিস্থা মন্দির
মন্দির থেকে আশে পাশের স্থানীয় বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে আমরা হেঁটে চললাম। কিছু দূর যাওয়ার পর একটা গ্রাম্য রাস্তা শুরু হোল। রাস্তার ডানদিকে উঁচু পাহাড় এবং বাম দিকে অদূরে বয়ে চলা বিপাশা নদীর গর্জন, আমি গুনগুন করে গান গাইতে থাকলাম, এই পথ যদি না শেষ হয়। কিছুদূর হাঁটার পর রাস্তার দুই পাশে আপেল বাগান এর সারি চোখে পড়ল, একবার ইচ্ছে হোল গাছ থেকে আপেল পেড়ে খাওয়া শুরু করি, পরে সেই চিন্তা বাদ দিলাম। আমরা কিছুদূর যাওয়ার পর ছোট একটা পানির স্রোত এর সামনে গিয়ে কতক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। আরও প্রায় ১০ মিনিট হাঁটার পর পাইন বনের পাশ দিয়ে ঝর্ণার কাছে পৌঁছে গেলাম।
গ্রামের ভিতরে পাহাড়ি পথ ধরে
আমরা ঝর্না ভ্রমণকারিরা
পাইন বনের পাশ দিয়ে ঝর্ণার পথে
যোগিনী ঝর্না
ঝর্ণার কাছে গিয়ে পানিতে পা ভিজিয়েই একটা লাফ দিলাম, কারণ পানি অনেক ঠাণ্ডা। একটু পর ঠাণ্ডা সয়ে এল। আমি আর একটু সামনে এগিয়ে একটা বিশাল পাথরের উপর গিয়ে শুয়ে পরলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হল আমি পৃথিবীর থেকে দূরে অন্য কোথাও চলে গিয়েছি, যেখানে শুধু নীল আকাশ, আর পানির কলকল ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই নেই। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। এভাবে কখন যে এক ঘণ্টার ও বেশি সময় পার হয়ে গেল তা বলতে পারব না। হাল্কা বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর আমার সম্বিত ফিরে এল। আমি আর খোকন তাড়াতাড়ি উঠে ঝর্না থেকে একটু দূরে একটা চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলাম। সোহাগ যে কোথায় গেছে, তা জানি না। চায়ের দোকানে বৃষ্টির মধ্যে আমরা চা খেলাম এবং ঐখানে এক জার্মান লেখক এর সাথে কথা হচ্ছিল। উনি প্রায় ২ মাস ধরে মানালিতে পরে আছেন। অনেক গল্পই হল, বাংলাদেশ নিয়ে ওনার অনেক আগ্রহ দেখেছি, কিন্তু আসার সাহস করে উঠেন নাই। আমি যতটুকু পারি টাকে অভয় দিয়ে আসছি, কিন্তু ঠিকমতো বুঝলাম না আসবেন কি না।
ঝর্ণার উপর থেকে
ঝর্ণার উপরে যাওয়ার সময়
ঝর্ণার উপর থেকে নামার সময়
আমি আর খোকন ঐখানে প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করে ফেরার পথ ধরলাম, কারণ দুপুর হয়ে যাচ্ছিল এবং খোকনের মাথা ব্যাথা করতেছিল। আমি আর খোকন যখন ম্যাল রোড এ ফেরত আসি তখন প্রায় দেড়টা বাজে। আমরা একবারে দুপুরে খেয়ে হোটেল এ ফিরলাম। তার কিছুক্ষণ পরেই সোহাগ রুম এ আসল। খোকনের ভালো না লাগায় খোকন কে রেখে এবার আমি আর সোহাগ দুইজন বাকি শহর ঘুরতে বেড়িয়ে গেলাম।
এবার আমরা প্রথমে গেলাম ওল্ড মানালিতে যেটাকে ক্লাব হাউজ বলে। ক্লাব হাউজ মূলত মানস নদীর তীরে একটি ছোট পার্ক যা ওল্ড মানালিতে অবস্থিত। মানস নদী কিছুদূর গিয়েই বিয়াস এর সাথে মিশে গেছে যেখানে আমরা সন্ধ্যা বেলায় গিয়েছিলাম। এখানে এসে পাহাড়ি নদীর স্রোত যে কত তীব্র হতে পারে তা দেখতে পেলাম। দড়ি বেয়ে নদী পার হওয়ার একটা ইভেন্ট ছিল যেটা বন্ধ দেখতে পেলাম। ঐখানে আমরা প্রায় ৩০ মিনিট ধরে ছবি তুললাম আর নদীর স্রোতের সৌন্দর্য অবলোকন করলাম। এরপর আমরা ঐখান থেকে অটো নিয়ে গেলাম হাদিম্বা মন্দির।
ক্লাব হাউজ
হাদিম্বা মন্দির ওল্ড মানালি এর অন্য দিকে অবস্থিত। এটি মহাভারত এর দেবী হাদিম্বা এর নামে নামকরণ করা হয়েছে। এই মন্দির এর প্রধান বিশেষত্ব হল প্রায় ৪৫০ বছর পূর্বে সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে একটি গুহার উপরে এটি তৈরি করা হয়েছে। চারপাশে ঘন পাইন জঙ্গল এর মাঝে চৌচালা মন্দিরটির বাইরের দেয়ালে বিভিন্ন প্রানির মাথা, শিং ইত্যাদি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আমি লম্বা লাইন দেখে মন্দির এর ভিতরে প্রবেশের লাইন এ দাঁড়ালাম না। সোহাগ ভিতরে প্রবেশ এর জন্য লাইন এ দাঁড়ালো এবং আমি আশে পাশে পাইন বনের ভিতরে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালাম। কিছুক্ষণ পর সোহাগ চলে এলে আমরা আবার ম্যাল রোড এর দিকে হাঁটা শুরু করলাম। যে কেউ চাইলে পুরো এলাকাটা হেঁটে ঘুরতে পারবে, কিন্তু আমাদের হাত এ সময় ছিল না বলে অটো নিয়েছিলাম।
হাদিম্বা মন্দির
আমরা দ্রুত ম্যাল রোড এ চলে এসে আরও এক কিলোমিটার এর মতো হেঁটে যেখানে মানস নদী বিয়াস এর সাথে মিশেছে ঐখানে চলে গেলাম। এই জায়গার আমি কোনও নাম খুঁজে পাই নাই, তাই নিজেই নাম দিয়েছিলাম তিনমাথা। আমি আর সোহাগ রাস্তা থেকে নিচে নেমে পাথরের উপর দিয়ে অনেক খানি হেঁটে যখন নদীর স্রোতের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছালাম ঠিক তখন ই বৃষ্টি শুরু হল। এইবার অবশ্য আমি খোকনের ছাতা নিয়ে গেছিলাম। বৃষ্টির মধ্যে আমি আর সোহাগ ছাতা মাথায় নিয়ে নদীর পাড়ে পাথরের উপর প্রায় ১০ মিনিটের মতো বসেছিলাম। ১০ মিনিট পর বৃষ্টি থেমে গেলে সোহাগ ছবি তুলতে ব্যস্ত হল এবং আমিও কিছু ছবি তুললাম। পাথরের উপরে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত বসেছিলাম আর ভাবছিলাম যদি অনন্তকাল ধরে এই জায়গায় এভাবে বসে থাকতে পারতাম। কিন্তু তা তো আর সম্ভব না তাই যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণ বিয়াস এর স্রোতের সাথে মিতালী করে এলাম। যখন অন্ধকার হয়ে এল আমরা উঠে ফেরার পথ ধরলাম।
আহা ! বিয়াস এর রুপ
৭ টা নাগাদ আমরা আবার হোটেল এ ফিরে আসলাম। এবার হোটেল থেকে তিনজন একসাথে বের হয়ে একটা রেস্টুরেন্ট এ গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। পরদিন আমাদের লাদাখের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার কথা কিন্তু আমরা এখন ও গাড়ি ঠিক করি নাই। গতদিন যে সকল ট্যুর অপারেটর দের কাছ থেকে ট্যাক্সি ভাড়া জেনেছিলাম, তাদের মধ্যে মোনাল ট্যুরস এর ভাড়া ই সব থেকে কম ছিল এছাড়া ওখানের কুশাল দা কে অনেক ভালো লেগেছিল। আমরা সরাসরি ওখানে চলে গেলাম ট্যাক্সি বুকিং দেয়ার জন্য। কিন্তু কুশাল দা প্রথমে জানালেন যে ওনার কাছে এই মুহূর্তে টয়োটা ইনোভা হবে না, মাহিন্দ্রা জাইলো চলবে কি না? কিন্তু আমি ইনোভা সম্পর্কে জানতাম, জাইলো সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। তাই ওনাকে বললাম যে আমাদের ইনোভাই লাগবে। পরে অবশ্য আমরা ইনোভা এর থেকে জাইলোকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলাম। এরপর উনি আধা ঘণ্টা সময় নিয়ে আমাদের জন্য টয়োটা ইনোভা গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা ৬০০০ রুপি অগ্রিম দিয়ে আসলাম। বাকি ৮০০০ রুপি লাদাখ পৌঁছানোর পর ড্রাইভার কে দিলেই হবে। পরদিন সকাল ৯ টায় তাদের অফিস এর সামনে উপস্থিত থাকতে বলল আমাদেরকে। আমরা আরও আগে রওনা দিতে চাইছিলাম কিন্তু রোথাং পাস যাওয়ার জন্য অনুমতি লাগবে, এবং তা সকাল ৯ টার আগে পাওয়া সম্ভব না। অগত্যা কি আর করা আমরা সকাল ৯ টায় আসব বলে সেখান থেকে চলে আসলাম। ম্যাল রোড এ কিছুক্ষণ ঘুরলাম। রাতের বেলা বিয়াস এর তীরে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম। আসলে আমি বিয়াস এর প্রেমে পরে গিয়েছিলাম। কেউ যদি বিয়াস এর সত্যিকারের যৌবন দেখতে চায় তবে তাকে অবশ্যই জুলাই-অগাস্ট মাস এ একবার হলেও মানালি যেতে হবে।
হোটেল এ ফেরার পথে একটা মিষ্টির দোকান থেকে গোলাব জামুন নামে রসগোল্লা খেলাম। আরও দুই তিন রকমের মিষ্টি খেয়েছিলাম। তবে গোলাব জামুন এর স্বাদ মনে হয় এখন ও মুখে লেগে আছে। ম্যাল রোড এ রাস্তায় ও ছোট আকারের গোলাব জামুন পাওয়া যায়, ঐটার স্বাদ তেমন ভালো লাগে নাই। এছাড়া রসমালাই এর মতো একটা মিষ্টি খেয়েছিলাম, সেটাও অনেক ভালো ছিল। এর মধ্যে সোহাগ আবার কোথা থেকে যেন ইয়াক এর পনির নিয়ে আসল। ইয়াক হল এক প্রকার গৃহপালিত প্রাণী। এদের কে মূলত পাহাড়ি অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। আমার কাছে ইয়াক এর পনির তেমন ভালো লাগে নাই। আমি একটু খানি মুখে দিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। এভাবে ঘুরে ফিরে আমরা রাত ১১ টার দিকে হোটেলে ফিরে আসলাম।
ইয়াক এর পনির
লাদাখ ভ্রমনঃ(৬ষ্ঠ পর্ব) – সোলাং ভ্যালী এবং রোথাং পাস এর অপূর্ণতা
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৭ রাত ১১:১১