লাদাখ ভ্রমণ - ২য় পর্ব
লাদাখ ভ্রমণ - সবগুলো পর্ব
২০০৯ সালে থ্রি ইডিয়টস সিনেমায় আমার প্রথম শিমলা দেখা। শিমলার অপরূপ সৌন্দর্যে আমি বিমোহিত ছিলাম। সাধারণত আমি মুভি দেখার সময় গানের ভিডিও দেখি না, কিন্তু যতবারই এই মুভি টা দেখেছি প্রথমের গান টার ভিডিও সবসময় দেখেছি। অবশেষে স্বপ্ন সত্যি করে শিমলা যাচ্ছি। পুরো টয় ট্রেন এর সময়টা বেহতি হাওয়া গানটা গুন গুন করতেছিলাম আর মাথায় সাইলেন্সার এর ঐ কথা টা বাজতেছিল, হি ইজ ইন শিমলা।
শিমলা রেল ষ্টেশন
অতি অল্প ৬ ঘণ্টা টয় ট্রেন এর অসাধারণ ভ্রমণ শেষে আমরা যখন শিমলা এসে পৌঁছালাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল প্রায় ৪ টা। ষ্টেশন এ নামার সাথে সাথেই এক দল দালাল আমাদের ঘিরে ধরল হোটেল এর জন্য। আমরা আগে থেকে হোটেল ঠিক করে যাই নাই। প্ল্যান ছিল মল রোড এ গিয়ে যে কোনও হোটেল এ উঠবো। দালালদের এরিয়ে ষ্টেশন এর ট্যুরিস্ট সেন্টার এ গেলাম মল রোড এ কিভাবে যাওয়া যাবে জানার জন্য। ট্যুরিস্ট সেন্টার থেকে নির্দেশনা নিয়ে আমরা ষ্টেশন এর বাইরে বেড়িয়ে এলাম।
বাইরে বেরোতেই একটা ছেলে আমাদের কাছে এসে বলল যে, সে কোনও দালাল নয়, একটা হোটেল এর পক্ষ থেকে এসেছে। তাদের হোটেল টা একবার দেখতে বলল, পছন্দ হইলে হবে না হইলে বাদ। এবং আমরা দিনের সব থেকে বড় ভুলটা করলাম। আমরা ঐ ছেলেটার সাথে ওদের হোটেল এ গেলাম। খেয়াল করি নাই যে আমাদের পিছনে দুই জন দালাল আমাদের কে ফলো করতেছে। তো ঐ ছেলের সাথে ওদের হোটেল এ গেলাম। তিন জনের জন্য একটা রুম পছন্দ হইল কিন্তু ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করলে বলল নিচে চলেন। খেয়াল করলাম আমাদের কে রিসিপশন এ না নিয়ে নিচে একটা ট্যুর এজেন্সির অফিস এ নিয়ে আসল। এইবার শুরু করল শিমলা - মানালি প্যাকেজ এর কথা। আমরা যতই বলি আমাদের শুধু এক রাতের জন্য রুম লাগবে ততই তারা একের পর এক প্যাকেজ এর কথা বলতে থাকে। শেষে বাধ্য হয়ে যখন বললাম যে, আমরা কোনও প্যাকেজ চাই না, তখন বলল যে এক রাতের রুম ভাড়া পড়বে ২৫০০ রুপি। আমরা ১০০০ রুপি বলে বাইরে চলে আসলাম।
বাইরে এসে মল রোড এর দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এর মধ্যে আর এক দালাল এসে হাজির। আমরা যতই বলি আমাদের রুম লাগবে না, ততই আমাদের কে বলে সস্তায় রুম দিতে পারবে। আমি ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে সামনে হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু ঐ দুই জনের একজন পিছু ছাড়ল না। শেষ এ বাধ্য হয়ে গেলাম ওর সাথে একটা হোটেল এ। রুম দেখার পর সেইখানেও একি অবস্থা। শিমলা-মানালির প্যাকেজ নিতে হবে। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। প্রায় ৫ টা বেজে গেছে, ব্যাটা দালাল আমাদের পিছু ছাড়ছে না, আমরাও রুম পাচ্ছি না। শেষ এ বাধ্য হয়ে মল রোড এ একটা বেঞ্চ এ বসে পড়লাম। অপেক্ষা করতেছি দালাল ব্যাটা কখন আমাদের পিছু ছাড়বে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এবার যদি কোনও হোটেলে প্যাকেজ এর কথা বলে বলব যে, আমরা মানালি থেকে এসেছি।
ব্যাটা দালাল আরও ১৫ মিনিট আমাদের সাথে বকবক করে চলে গেল। এরপর আমি বসে বসে ব্যাগ পাহারা দিলাম, সোহাগ আর খোকন গেল হোটেল খুঁজতে। অবশেষে প্রায় ৬ টার দিকে সোহাগ হোটেল সিতা প্যালেস নামক একটা হোটেলে এ তিনজনের জন্য একটা রুম ১০০০ রুপিতে পেল। এমনিতেই আমাদের প্ল্যান ছিল শিমলায় মাত্র এক রাত থাকার। ঠিক করে এসেছিলাম বিকালের মধ্যে হোটেল এ চেক ইন করে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিমলা শহর টা ঘুরে দেখব। কিন্তু দালাল এর উৎপাতে আমাদের আড়াই ঘণ্টা এবং পুরো বিকালটাই নষ্ট হল।
হোটেল এ গিয়ে আমাদের প্ল্যান ছিল তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বের হব। সারাদিনে তেমন কিছুই খাওয়া হয় নাই, খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছিল। আমরা যখন রেডি হয়ে বের হতে যাব, আমাদের সকল প্ল্যান ভেস্তে দিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। এদিকে শুধু খোকন ছাড়া আর কারো কাছে ছাতা ছিল না। এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে আছে তার উপর এই বৃষ্টি, যন্ত্রণার ষোলকলা পূর্ণ হল যেন।
আমরা হোটেল এর লবিতে বসে বসে মাছি মারছি আর বৃষ্টি কমার প্রার্থনা করতেছি। কিছুক্ষণ পর এক ইন্ডিয়ান মধ্য বয়স্ক দম্পতি বাইরে থেকে আমাদের হোটেলে আসলেন। তারা আমাদের পাশের রুম এই উঠেছিল এবং তাদের দুই জনের হাত এ দুইটা ছাতা ছিল। আমি সোহাগ কে বললাম তাদের কাছ থেকে ছাতা টা কিছু সময় এর জন্য ধার চাইতে। সোহাগ তাদের সাথে কথা বলে ছাতা আনতে গেল কিন্তু একটা ছাতা নিয়ে ফেরত আসল। অগত্যা আমি আবার গেলাম আরও একটা ছাতা আনতে।
অবশেষে তিন জন তিনটা ছাতা নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে বের হলাম। আমাদের হোটেল থেকে মল খানিকটা দূরে। আমরা তিনজন কথা বলতে বলতে অন্ধকার এর মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছিলাম। এতক্ষন যে বৃষ্টিটাকে অসহ্য মনে হচ্ছিল, এখন আবার সেইটাই বেশ ভালো লাগছে। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই, ঝুম বৃষ্টিতে অন্ধকার পাহাড়ি পথে তিনজনের হেঁটে চলার এই সময়টা আসলেই অসাধারণ ছিল। মনে হচ্ছিল কোনও রোমাঞ্চ গল্পের দৃশ্যে অভিনয় করছি। মিনিট দশেকের মধ্যে আমরা মল এর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম।
মল এ পৌঁছে প্রথমে একটা দোকান এ মম খেলাম আমরা তিনজন মিলে। কিন্তু এই মম টা আমার ভালো লাগে নাই। এর থেকে দার্জিলিং এর মম অনেক ভালো ছিল। এরপর খোকন আর সোহাগ এর মাথায় বিরিয়ানি খাবার ভূত চাপল। এ ভূত সিন্দবাদ এর ভূত থেকে কম নয়। আমি যতই বোঝাই, নতুন জায়গায় আসছি এইখানের লোকাল খাবার টেস্ট করি, না তারা বিরিয়ানিই খাবে। পেটে ক্ষুদা নিয়ে ওরা বিরিয়ানির দোকান খুঁজতে থাকল। আর আমি ওদের পিছনে পিছনে আশেপাশে দোকানগুলো দেখতে দেখতে চলতে লাগলাম। আমরা একবার নিচে নামছি, আর একবার উপরে উঠছি। বিরিয়ানির দোকান খুঁজতে আমরা কোথায় না গেলাম, রিজ-মল রোড, লোয়ার বাজার রোড, গঞ্জ রোড, হিলকার্ট রোড। কিন্তু বেচারারা বিরিয়ানির দোকান আর খুঁজে পায় না। ক্ষুদা থাকায় আমার মেজাজ যে একটু গরম হয় নাই একেবারে তা নয়, কিন্তু শিমলার অলিগলি ঘুরছিলাম দেখে ভালই লাগছিল। হয়ত বিরিয়ানির দোকান না খুজলে এরকম অনেক অলিগলিতেই হাঁটা হত না।
মল এ আসার ২০ মিনিটের মধ্যেই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছিল। অনেকক্ষণ ঘুরে শেষ পর্যন্ত ওরা বিরিয়ানির দোকান খোঁজা বাদ দিল। আমরা একটা মিষ্টির দোকান থেকে ১ কেজি লাড্ডু কিনলাম। লাড্ডুর স্বাদটা চমৎকার ছিল। এরপর আমরা মল এ শিমলার বিখ্যাত রিজ দেখতে গেলাম। এইখানে এসে আমরা রাস্তার পাশে একটা দোকান থেকে টমেটো সুপ, ভেজ বার্গার, চিপস, ড্রিংকস খেলাম।
শিমলার বিখ্যাত এই চার্চ এর একটা ছবি না তুললেই নয়..
ম্যাল এর উপরে রাত ১০ টায়
ম্যাল রোড এর একটি ভাস্কর্য
এই রাতের বেলা মল এর এই খোলা পরিবেশ এক কথায় অপার্থিব মনে হচ্ছিল। সেই সাথে একটু পর পর মেঘের দল এসে আমাদের কে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। শিমলা আসার পর মনের যত ক্ষোভ ছিল, তা যেন মেঘের সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ধীরে ধীরে লোকজন কমে যেতে থাকল। আমরা ঘড়ির দিকে খেয়াল করলাম প্রায় ১১ টা বেজে গেছে। হোটেল এ যেতে ইচ্ছা না করলেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে হোটেলের পথ ধরলাম। কারণ কাল সকালেই আবার মানালি চলে যেতে হবে। আমাদের মূল গন্তব্য তো লাদাখ। হোটেল এ ফিরে বিছানায় গা এলিয়েই ঘুম।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠি ভোর ৬ টায়। ভেবেছিলাম উঠে একটু হাঁটতে বের হব। কিন্তু জানালা খুলেই দেখি বৃষ্টি পড়ছে। কি আর করা একজন করে ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় এবং ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। হোটেল এর বিল মিটিয়ে আমরা যখন বের হলাম বৃষ্টি থেমে গেছে। বাইরে বের হয়ে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করছিল। আমরা শিমলার কোনও জায়গায় ঘুরতে পারলাম না এই জন্য খোকন মন খারাপ করেছিল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা ওল্ড বাস স্ট্যান্ড এ চলে আসলাম। কিন্তু মানালি যাওয়ার বাস ছাড়ে নিউ বাস স্ট্যান্ড থেকে। ভারতের যোগাযোগ ব্যাবস্থা আমাকে দারুন মুগ্ধ করেছে। সব কিছু খুব সাজানো। আমার দেখা সব শহর গুলোতে দুইটা করে বাস স্ট্যান্ড।
মেঘের চাঁদরে ঢাকা সকাল
সকাল এ বৃষ্টির পর আমরা তিনজন
আমরা নিউ বাস স্ট্যান্ড এ যাওয়ার লোকাল বাস এ উঠে পড়লাম। ওল্ড বাস স্ট্যান্ড থেকে নিউ বাস স্ট্যান্ড এ যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। নিউ বাস স্ট্যান্ড এ নেমেই হিমাচল প্রদেশ এর বাস কাউন্টার এ চলে গেলাম। গিয়ে শুনলাম ৮ টা বাজে মানালির একটা বাস ছেড়ে গেছে। পরের বাস সকাল সাড়ে ৯ টায়। খোকন আর সোহাগ কে নিচে রেখে আমি দোতলায় গেলাম অন্য কোনও বাস এর খোঁজ নিতে। খুঁজতে খুঁজতে একটা বাস পেলাম, যেটা মাত্র ছেড়ে দোতলা থেকে ছেড়ে গেছে। আমি কাউন্টার এর এক লোক কে সাথে নিয়ে দৌড় দিলাম বাস থামাতে। বাস থামিয়ে কন্ট্রাক্টর কে জিজ্ঞেস করলাম যে ৩ টা সীট খালি হবে কি না? সীট হবে শুনে আবার দৌড়ে সোহাগ আর খোকন এর কাছে গেলাম। ওদের কে সাথে নিয়ে যখন বাস এ উঠলাম আমি রীতিমত হাঁপাচ্ছি। বাস এর পিছনের সীট এ গিয়ে বসে পড়লাম এবং বললাম যে দৌড় এর আর শেষ হবে না মনে হয় ।
শিমলা কে পেছনে ফেলে আমরা চললাম মানালির উদ্দেশ্যে।
লাদাখ ভ্রমনঃ(৪র্থ পর্ব) - মানালির পথে
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৭ রাত ১১:০৯