লাদাখ ভ্রমণ - ১ম পর্ব
লাদাখ ভ্রমণ - সবগুলো পর্ব
আমরা ওল্ড দিল্লী রেল ষ্টেশন এ পৌঁছাই রাত ১০ টায়। ষ্টেশন এ পৌঁছে যখন জানতে পারলাম ট্রেন প্রায় ২ ঘণ্টা লেট, আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। তখন আমাদের মাথায় এল ব্যাটা ট্যাক্সি ড্রাইভার শুধু শুধু আমাদের কে অতিরিক্ত ১৫-২০ কিমি ঘুরিয়ে ওর মিটার এর বিল বেশি করেছে। আবার এয়ারপোর্ট এর পুলিশ ভাড়া বলছিল ৩৫০ রুপির মধ্যে হয়ে যাবে, সেখানে আমাদের ১১০০ রুপি লেগেছে। যাত্রার শুরতেই এত গুলা টাকা গচ্চা গেল এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই ষ্টেশন এর পাশের থানাতে গেলাম অভিযোগ করতে। ঐখানে গিয়ে আসলে কোনও লাভ হল না। কারণ আমরা যে ট্যাক্সি ঠিক করেছিলাম সেটা আমাদের ঢাকার মত প্রাইভেট ট্যাক্সি। আর অতিরিক্ত ঘুরিয়ে আনার ব্যাপারে বলল যে, ঐ সময় দিল্লিতে পিক আওয়ার, তাই জ্যাম পরিহার করতে এবং তাড়াতাড়ি আসার জন্য ট্যাক্সি ড্রাইভার হয়ত ঘুর পথে আসছে।
থানা থেকে বের হয়ে আবার স্টেশন এ আসলাম। তখনও রাতের খাওয়া হয় নাই। আমাকে ষ্টেশন এ রেখে খোকন আর সোহাগ গেল বিরিয়ানি আনতে। ওদের দিল্লীর বিরিয়ানি খাওয়ার শখ হয়েছিল। বিরিয়ানি কিনে ওরা ষ্টেশন এ আসল রাত ১১ টায়। ওদের কাছে বিরিয়ানি খুব ভালো লাগলেও আমার কাছে মনে হয়েছে এর থেকে জঘন্য বিরিয়ানি আমি আর কখনো খাই নাই। অর্ধেক এর মত বিরিয়ানি ফেলে দিয়ে আমি ষ্টেশন এর ম্যাকডোনাল্ডস এ ভেজ বার্গার আর কফি খেয়ে ট্রেন এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। অপেক্ষার প্রহর ফুরিয়ে গেলেও ট্রেন আসার নাম নেই। আমরা কিছু সময় অন্তর তথ্য কেন্দ্রে গিয়ে ট্রেন এর কথা জিজ্ঞেস করি। কিন্তু ট্রেন এর সময় শুধু বার বার পিছিয়েই যায়। এভাবে অনেক অপেক্ষার পর রাত ২ টা ৩০ মিনিটের দিকে ভারত এর অন্যতম পুরনো ট্রেন হাওড়া-দিল্লী কালকা মেইল ষ্টেশন এ এসে পৌঁছায়। ব্যাগ নিয়ে ট্রেন এ উঠে আমাদের নির্ধারিত বগিতে গিয়ে দেখি অর্ধেক প্রায় খালি। আগের রাত এ বাস জার্নি সাথে সারা দিনের ধকল শেষ এ বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
চণ্ডীগড় রেল ষ্টেশন
যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় ৬ টা। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় ট্রেন কালকার উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। আমি জানালা দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। ট্রেন আমবালা ক্যান্ট ষ্টেশন পার হয়ে সাড়ে ৭ টার দিকে চণ্ডীগড় ষ্টেশন এ পৌঁছায়। সেখানে প্রায় ১৫ মিনিট বিরতি দেয়। আমি আর সোহাগ ট্রেন থেকে নেমে চা খাই। এরপর ট্রেন চণ্ডী মন্দির ষ্টেশন পার হয়ে যখন কালকা এসে পৌঁছায় তখন সকাল সাড়ে ৮ টা।
কালকা রেল ষ্টেশন
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য টয় ট্রেন এ করে হিমাচল প্রদেশ এর রাজধানী শিমলা। খোঁজ খবর নিয়ে গেছিলাম যে ট্রেন থেকে নেমেই টয় ট্রেন এর টিকেট পাওয়া যায়, তাই ট্রেন থেকে নেমে দৌড় দিলাম টয় ট্রেন এর টিকেট কাটতে। কাউন্টার এ গিয়ে ৩ টা টিকেট কাটলাম ৬০ রুপি করে জন প্রতি। কিন্তু ট্রেন যেখান থেকে ছাড়ে ঐখানে গিয়ে মাথায় বাজ পড়ল।
কারণ দুইটা লাইন এ দুইটা ট্রেন দাঁড়ানো ছিল, এর মধ্যে একটা ট্রেন ১৫ মিনিট পর ছাড়বে, কিন্তু আমি যে টিকেট কাটছি তা এই ট্রেন এর না। এবং আমি কাটছি ২য় ট্রেন এর টিকেট যেটা ছাড়বে আরও এক ঘণ্টা পর। এটা একটা লোকাল ট্রেন। এবং এর ভিতরে কোনও সীট ফাঁকা ছিল না। মানুষজন যে যেভাবে পেড়েছে বসে পড়েছে, যারা সীট পায় নাই তারা দাড়িয়ে আছে। ট্রেন এর ভিতরে কোনও জায়গাই নাই। ফলে আমাদের যেতে হবে এই ট্রেন এর ও ১ ঘণ্টা পর আর একটা ট্রেন ছাড়বে ঐ ট্রেন এ। চিন্তা করে দেখলাম ৩য় ট্রেন ছাড়বে বেলা ১১ টায়। কালকা থেকে শিমলা টয় ট্রেন এ যেতে লাগবে প্রায় ৫ ঘণ্টার বেশি। আবার এর মধ্যে যদি ট্রেন লাইন কোনও কারণে ক্লিয়ার না থাকে তাহলে আরও দেরি হবে।
আমরা ১ম ট্রেন এর টিকেট কিভাবে পাওয়া যাবে সেই চেষ্টা করতে লাগলাম। একবার ট্রেন এর টিকেট চেকার কে জিজ্ঞেস করি তো আর একবার কাউন্টার এ ঘুরে আসি। আসলে এই ট্রেন টা কালকা মেইল এর সাথে সংযুক্ত। কালকা মেইল না আসা পর্যন্ত এটা ছাড়ে না। আর এর টিকেট আগে থেকে রিজার্ভ করে রাখতে হয়। ঐ দিন কোনও টিকেট ই ফাঁকা ছিল না। এর মধ্যে এক দালাল জুটে গেল, যে বলল যে এই প্রথম ট্রেন এর টিকেট জোগাড় করে দিবে কিন্তু জন প্রতি ৫০০ রুপি লাগবে। আমি ট্রেন এর সামনে থেকে টিটির কাছে টিকেট এর দাম জেনে এসেছিলাম। এই ট্রেন এর টিকেট ৪২০ রুপি জন প্রতি। ঐ ব্যাটা ৫০০ রুপি চাচ্ছিল, সাথে আবার আমরা ৬০ রুপির টিকেট কেটে ফেলেছি। ঐ দালাল যে টিকেট ঠিক দিতে পারবে এই ভরসাও পাচ্ছিলাম না, কারণ প্রত্যেকটা বগির গেট এর সামনে যাত্রী দের নাম লেখা কাগজ আঠা দিয়ে লাগানো আছে। আমরা কি করব এই চিন্তায় সকালের নাস্তাও করি নাই তখনও।
সাড়ে ৯ টা বাজে প্রায়। কিন্তু ১ম ট্রেন ছাড়ার নাম নেই। আমরা হতাশ হয়ে চেয়ার এ বসে রইলাম। ততক্ষনে টয় ট্রেন এর প্রায় সকল রেল কর্মকর্তা-কর্মচারী আমাদের কে চিনে ফেলেছে। হঠাৎ করে রেল এর একজন লোক এসে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করল আমরা ১ম ট্রেন এ শিমলা যাব কিনা? আমরা তো যেতেই চাই কিন্তু টিকেট কে দিবে? সে আমাদের কে তার সাথে যেতে বললে আমরা চেয়ার ছেড়ে তার পিছনে চললাম। ট্রেন এর ইঞ্জিনের ঠিক পিছনে একটা ছোট বগির গেট প্রথম থেকে বন্ধ ছিল যার ভিতরে কোনও লোক ছিল না। ঐ লোক আমাদের সহ আরও কয়েকজন কে ঐ বগিতে তুলে দিল। আমরা সীট এ বসলাম এর মধ্যে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাদের বগি তে এসে সবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে টিকেট দিতে লাগল। আমি ৬০ রুপির টিকেট এর কথা বললাম তাকে। সে তখন জন প্রতি অবশিষ্ট ৩৬০ রুপির টিকেট দিল আমাদের তিনজন কে। আমরা সীট এ বসে পড়লাম। ট্রেন থেকে আমাদের কে পানি দিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর ই ট্রেন ছেড়ে দিল। আমরা আল্লাহ এর রহমতে ১ম ট্রেন এ করেই শিমলার উদ্দেশ্যে চললাম।
টয় ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর
এতক্ষন টেনশন এ খাবার এর কথা মনে পরে নাই। ট্রেন ছাড়ার পর মনে পড়ল আমরা সকালের নাস্তা করি নাই, এমন কি খাবার কিছু কিনিও নাই। গত রাতে দিল্লী ষ্টেশন এ আমি দুই প্যাকেট বিস্কুট কিনেছিলাম শুধু সেইটাই আছে। তাই তিনজন এ ভাগ করে খেলাম।
কালকা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২১৫০ ফুট উপরে এবং শিমলা প্রায় ৭২০০ ফুট উচ্চতায় এবং কালকা থেকে শিমলা রেল পথের দূরত্ব ৯৬ কি.মি.। আমরা এই ছোট ট্রেন এ করে প্রায় ৫০০০ ফুট উপরে উঠবো এটা ভেবেই রোমাঞ্চিত লাগছিল। কালকা থেকে শিমলা টয় ট্রেন এ যেতে হাতের ডান দিকের সীট এ বসলে সব থেকে বেশি প্রকৃতির ভিউ দেখা যায়, এটা আমাদের কে কালকা রেল ষ্টেশন এ এক চা বিক্রেতা বলেছিল। আমি আর সোহাগ বগির ডান দিকের দরজা খুলে জায়গা দখল নিলাম, খোকন আগেই ডান দিকের সীট দখল করেছিল। আমি দরজার সামনে বাইরে পা ঝুলিয়ে বসলাম এবং নীল আকাশ, পাহাড় এবং মেঘের ভেলায় হারিয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ চলার পর ট্রেন পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে উপরে উঠতে শুরু করল।
ট্রেনের দরজায় আমি আর সোহাগ
একটা টানেল থেকে বের হওয়ার পর
আমাদের ছোট খেলনা ট্রেন আঁকাবাঁকা পথে পাহাড়ের গা বেয়ে চলতে লাগল। দূরের পাহাড়ের চূড়ায় সাদা শুভ্র মেঘ জমে অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। সোহাগ ছবি তুলতে থাকল এবং আমি বগির পা দানিতে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মত একবার ডানে তাকাচ্ছিলাম আর একবার বামে তাকাচ্ছিলাম।
টয় ট্রেন থেকে প্রকৃতি
ট্রেন প্রায় এক ঘণ্টার মত চলার পর গুম্মান নামে একটা ষ্টেশন এ এসে থেমে গেল। আমরা প্রায় ৫ মিনিট অপেক্ষার পর ও যখন দেখলাম ট্রেন ছাড়ছে না, তখন সবাই নেমে ছবি তুলতে লাগলাম। একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম যে ট্রেন ছাড়তে একটু দেরি হবে, এই ফাঁকে আমি আর সোহাগ আশে পাশে একটু ঘুরে আসলাম। খোকন ট্রেন এ বসে ব্যাগ পাহারা দিচ্ছিল। এক ঘণ্টার ও বেশি সময় পর ট্রেন ছাড়ল। আমরা আবার চলতে শুরু করলাম।
গুম্মান ষ্টেশন এর আশপাশ থেকে
কালকা থেকে শিমলা রেল পথে প্রায় ১০৩ টার মত ছোট বড় টানেল এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ট্রেন একটা করে টানেল এ প্রবেশ করে আর আমরা সবাই চিৎকার শুরু করি। সে এক অন্য রকম আনন্দ। এর মধ্যে সব থেকে বড় বারোগ টানেল প্রায় ১ কিমি এর বেশি লম্বা। দুপুর প্রায় সাড়ে ১২ টার দিকে ট্রেন বারোগ টানেল পার হয়ে বারোগ ষ্টেশন এ এসে থামল।
বারোগ ষ্টেশন থেকে
সোলান ষ্টেশন
সোলান ষ্টেশন এ অপর দিক থেকে আসা ট্রেন (এই ছবিটা আমার খুব ই প্রিয়, মনে হয় একটা অ্যানাকোন্ডা গুহা থেকে বের হয়ে আসছে)
গতকাল রাতের পর এখন পর্যন্ত শুধু কয়েক টুকরা বিস্কুট খেয়েছি, ক্ষুদায় পেট চোঁ চোঁ করছিল। আমি ষ্টেশন এ নেমে খাবার কিছু আছে কি না খুজতে গেলাম। কয়েক প্যাকেট চিপস ও বিস্কুট কিনে বগিতে এসে দেখি ট্রেন থেকে নাস্তার প্যাকেট ও জুস দিয়ে গিয়েছে কমপ্লিমেন্টারি হিসেবে। এমন ভাবে নাস্তার প্যাকেট এর উপর হামলে পড়লাম যেন অনেক দিন কিছু খাই নাই। খাবার ভালই ছিল- একটা স্যান্ডউইচ, দুইটা চপ এবং জুস। একটু পর আবার চা দিয়ে গেল। পাহাড়ি হিমেল ঠাণ্ডা হাওয়ায় পেট পুজোর পরে এক কাপ গরম চা, আহা! আজীবন এভাবে চলতে পারলে মন্দ হত না।
মেঘের ভিতর দিয়ে চলা
চা দেয়ার কিছুক্ষণ পর ট্রেন আবার চলতে শুরু করল। সেই সাথে আশে পাশের প্রকৃতি যেন আরও অপূর্ব হয়ে উঠতে লাগল। আমি আর সোহাগ ছবি তুলতে তুলতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও প্রকৃতির অপরূপ সুধা যেন শেষ হতে চায় না। যতই সময় যায় ততই ভিন্ন ভিন্ন রুপ আমাদের সামনে এসে পরে। সাথে কিছু সময় পর পর ট্রেন মেঘের ভিতরে প্রবেশ করে। এভাবে চলতে চলতে আমরা বেলা সাড়ে ৩ টার দিকে শিমলা রেল ষ্টেশন এ পৌঁছে গেলাম।
দূরে পাহাড়ের চূড়ায় শিমলা শহর
আরও কিছু ছবি
এই জায়গায় আমরা ছবি তুলতে পারি নাই, তাই নেট থেকে ২ টা ছবি ধার নিলাম
লাদাখ ভ্রমনঃ(৩য় পর্ব)- শিমলার যন্ত্রণা(দালাল এবং বৃষ্টি)
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৭ রাত ১১:০৬