সে প্রায় এক বছর আগে এক ভাই এর একটা ব্লগ পড়েছিলাম। তার পর থেকে প্রায় এক বছর ধরে এই ট্যুর এর প্ল্যান করেছি। শুরুতেই সেই মহান ভাই কে ধন্যবাদ। জানি তার মত লিখতে পারব না তবুও তার কথাতেই ভাবলাম আমার অভিজ্ঞতার কথা একটু শেয়ার করি।
যখন ট্যুর এর প্ল্যান করলাম আমার সাথে ট্যুর এ যেতে রাজি হল একজন, বন্ধু সোহাগ। এর আগেও ও আমার সাথে দার্জিলিং গিয়েছিল। আমরা দুই জন ই যেহেতু চাকরি করি তাই এত দিনের ছুটি পাওয়া নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। এছাড়া পুরো ট্যুর বাই রোড এ করলে আরও অনেক দিন লাগবে, তাই আমরা কিছু ক্ষেত্রে এয়ার এ ট্রাভেল করার সিদ্ধান্ত নেই। যা পরবর্তীতে বিস্তারিত লিখব।
আমরা এপ্রিল এ দার্জিলিং গিয়েছিলাম বুড়িমারী দিয়ে এবং আমাদের ভিসার মেয়াদ ছিল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাই আমরা আগস্ট মাসে এই ট্যুর করার সিদ্ধান্ত নেই। আর এক বন্ধু খোকন ও ভিসা পেয়ে আমাদের সাথে যোগ দেয়।
আমরা তিনজন ই জুলাই মাসের মধ্যে এয়ার টিকেট, ট্রেন টিকেট কেটে ফেলি। আমাদের যাত্রা শুরুর ডেট ছিল আগস্ট এর ২য় সপ্তাহে। আমি ৭ দিন আগে আরামবাগ এ গিয়ে শিলিগুড়ি পর্যন্ত শ্যামলী বাস এর টিকেট কেটে আনি, সব ঠিকঠাক। এবার তাহলে দৌড়ের গল্প টা শুরু করি।
যাত্রা শুরুর আগের দিন সন্ধ্যা বেলা আমি অফিস থেকে ফিরতেছি এই সময় এ খোকনের ফোন। শ্যামলী বাস এর টিকেট এ ওর নাম্বার দিয়ে আসছিলাম। ব্যাটারা সন্ধ্যা ৭টায় ফোন দিয়ে বলে যে ওদের বাস যাবে না। কাউন্টার এ গিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে আসতে। এদিকে আমরা যেদিন শিলিগুড়ি পৌঁছাব ঐ দিন বিকালেই আমাদের বাগডোগরা থেকে দিল্লির এয়ার টিকেট কনফার্ম করা। এখন কি আর করা। বাসায় এসে কোনও রকমে ফ্রেশ হয়ে রাত ৯ টায় আমি আর খোকন ছুটলাম কল্যাণপুর এ। গিয়ে যদি বুড়িমারী পর্যন্ত কোনও বাস এর টিকেট পাওয়া যায়। রাত ১১ টা বাজে কল্যাণপুর গিয়ে পৌছালাম। আমাদের ভাগ্যের দিকে আল্লাহ মুখ তুলে চাইল এবং এসআর প্লাস এর তিনটে টিকেট পেলাম। সোহাগ কে জানিয়ে দিলাম যে টিকেট পাওয়া গেছে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১২ টা পার হয়ে যায়। একটা দৌড় শেষ হল, কিন্তু তখন ও যে দৌড়ের অনেক বাকি।
পর দিন আমাদের বাস ছিল রাত ৮ টায়। আমি অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়েও বাসায় আসতে দেরি হয়ে গেল। আমাদের যেখানে রওনা দেয়ার কথা ছিল ৬ টা বাজে। সেখানে আমি আর খোকন যখন সিএনজি তে উঠলাম ঘড়িতে তখন ৭ টা ১০ বাজে। ৪০ মিনিটে পুরান ঢাকা থেকে কল্যাণপুর যাওয়া টা কতটা ভাগ্যের বিষয় টা শুধু যারা ঐ সময় এ ঐদিকে যায় তারাই জানে। খোকন তো আমার উপর এক চোট নিল দেরি করার কারণে। এদিকে সোহাগ আসবে টঙ্গী থেকে। ও বিকাল ৫ টা বাজে রওনা দিছে। আমরা সিএনজি তে উঠে সোহাগ কে ফোন দিয়ে বললাম যে, বাস যদি ছেড়ে দিতে চায় তাহলে আমাদের জন্য যেন একটু অপেক্ষা করে। কিন্তু স্যার জানাইলেন যে তিনি তখন ও এয়ারপোর্ট এ জ্যাম এ আটকা পড়ে আছেন। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, ট্যুর বোধহয় গেল। কারণ বাস মিস করলে পরেরদিন এর দিল্লীর ফ্লাইট মিস, ফ্লাইট মিস হইলে ঐদিন রাতের ট্রেন মিস। পুরো রাস্তা মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে আসলাম। সিএনজি যখন ই কোনও সিগন্যাল এ আটকায় আমাদের মুখ আর কলজে দুটাই শুকিয়ে যায়। আর সাথে তো ৫ মিনিট পর পর সোহাগ কে ফোন, ঐ তুই কোথায়। আমরা যখন কল্যাণপুর এ পৌঁছাইলাম তখন ঘড়িতে ৮ টা বেজে ৫ মিনিট, এবং আমাদের বাস কাউন্টার এর সামনে দাড়িয়ে। কিন্তু সোহাগ তখন ও মিরপুর-২ এর জ্যাম এ। বাস এর সুপারভাইজার কে বলে ৫ মিনিট দেরি করালাম, আর এর মধ্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে নিলাম। কিন্তু সোহাগ তখন ও মিরপুর-১ এ। সুপারভাইজার আমাদের জোর করে বাস এ উঠিয়ে বাস ছেড়ে দিল এবং বলল যে টেকনিক্যাল এর পেট্রোল পাম্প থেকে পানির বোতল নিবে, আমাদের বন্ধু কে ওইখানে চলে যেতে। আমি ফোন এ সোহাগ এর সাথে কথা বলতেছিলাম আর কোথায় আছি এটা জানাচ্ছিলাম। আমাদের বাস যখন টেকনিক্যাল মোড় এর সিগন্যাল এ থামল, ঐ একই সময়ে সোহাগ টেকনিক্যাল এ পৌঁছায়। ও ঐ সিগন্যাল এ রাস্তা ক্রস করে বাস এর কাছে আসে এবং সাথে সাথে সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। আমরা বাস থামিয়ে ওকে বাস এ তুলে নেই। বাস এ বসার পর আমার প্রথম কথা ছিল,“গতকাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত যে দৌড় করলাম, এই ট্যুর এ আরও কত যে দৌড় করা লাগবে তা আল্লাহ ই জানেন”।
বাস পরদিন ভোর ৭ টা বাজে বুড়িমারী তে পৌঁছায়। এরপর আগের মতই বর্ডার ক্রস করে ঐপারে সকল ডলার-টাকা রুপিতে নিয়ে আমরা ৬ জন একটা জীপ ভাড়া করি।
বর্ডার ক্রস করার আগের গল্প
জীপ এর তিনজন আমরা তিন বন্ধু, একজন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী আর দুই জন ছাত্র যারা আসাম এ পড়াশুনা করে। আমাদের শিলিগুড়ি পর্যন্ত মোট ভাড়া ৯০০ রুপি এবং ওদের কে শিলিগুড়ি তে নামিয়ে আমাদের বাগডোগ্রা এয়ারপোর্ট নামিয়ে দিয়ে আসার জন্য আরও ৩০০ রুপি। আমরা শিলিগুড়ি পৌঁছে ঢাকা হোটেলে গোগ্রাসে দুপুরের খাবার খেয়ে যখন বাগডোগ্রা পৌছালাম তখন দুপুর প্রায় ২ টা এবং আমাদের দিল্লীর ফ্লাইট বিকাল ৩ টা ৪৫ মিনিটে। কিন্তু এয়ারপোর্ট এ গিয়েই আর একটা দুঃসংবাদ শুনলাম স্পাইসজেট এর ঐ ফ্লাইট ২ ঘণ্টা দেরি করে ৬ টায় ছাড়বে। এদিকে রাত ৯ টা ২৫ মিনিটে ওল্ড দিল্লী রেল ষ্টেশন থেকে আমাদের ট্রেন এর শিডিউল। বাগডোগ্রা থেকে দিল্লী যেতে সময় লাগে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের মত। আমরা চিন্তায় পরে গেলাম, কি করব। একবার ভাবলাম টিকেট ক্যানসেল করে অন্য কোনও এয়ারলাইনে যাই। কিন্তু অন্য এয়ারলাইন এর ঐদিনের ভাড়া অনেক বেশি ছিল। অগত্যা আমরা এয়ারপোর্ট এ বসে বসে মাছি মারতে লাগলাম। আর মনে মনে হিসাব করতে থাকলাম দিল্লী এয়ারপোর্ট এ কখন পৌঁছাব, এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে কিভাবে রেল ষ্টেশন এ পৌঁছাব, ট্রেন কি লেট থাকবে, ট্রেন মিস করলে কি করব ইত্যাদি। এভাবেই ২-৩ ঘণ্টা সময় পার করে দিলাম।
বাগডোগ্রা এয়ারপোর্ট এ আমি এবং সোহাগ প্লেনে ওঠার আগে
প্লেনের ভিতর আমরা তিনজন
প্লেন টেক অফ করার কিছু সময় পর
প্লেন থেকে সন্ধ্যার আকাশ এ মেঘের ছুটে চলা
৬ টার সময় আমাদের ফ্লাইট যখন টেক অফ করল, সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে দিগন্তের সাথে মিশে যাচ্ছে। ৮ টা ২০ মিনিটে আমাদের ফ্লাইট দিল্লী ইন্ধিরা গান্ধী এয়ারপোর্ট এ ল্যান্ড করল এবং আমরা ৮ টা ৩০ মিনিটে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে আসলাম। বের হতে হতে চিন্তা করতে লাগলাম হাত এ সময় আছে এক ঘণ্টা, এর মধ্যে কিভাবে রেল স্টেশনে পোঁছানো যায়। সোহাগ একজন পুলিশ এর কাছে জিজ্ঞেস করতেছিল কিভাবে যাওয়া যাবে, পুলিশ ভাই আমাদের কে প্রথমে মেট্রো এর কথা বলল(ঢাকা থেকে প্ল্যান করে এসেছিলাম দিল্লী এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রো ধরে ওল্ড দিল্লী যাব, ওইখানে বিরিয়ানি এবং কাবাব খেয়ে রেল ষ্টেশন এ গিয়ে ট্রেন ধরব।সেই প্ল্যান এ গুড়েবালি, এখন ট্রেন মিস না করলেই হয়।) অথবা ট্যাক্সি এর কথা বলল। কোনটায় তাড়াতাড়ি হবে আমার এই প্রশ্নের জবাবে সেই পুলিশ ভাই ট্যাক্সির কথা বললেন এবং ভাড়ার কথা বললেন ৩০০-৩৫০ রুপি। আমরা আর কোনও দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে হাতের সামনে একটা ট্যাক্সি পেয়ে ওইটাতেই উঠে পরলাম(যা পরে আমাদেরকে দিল্লীর ঠকবাজদের কথা মনে করিয়ে দিছিল, আর একটা শিক্ষা দিছিল যে উপমহাদেশে রাস্তা না চিনলে ট্যাক্সি তে মিটারে কখনোই যেতে নেই)। ব্যাটা ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদেরকে পুরো দিল্লী ৪০ কিমি ঘুরিয়ে যখন ওল্ড দিল্লী রেল ষ্টেশন এ পৌছাল তখন ঘড়িতে বাজে রাত ১০ টা। এর মধ্যে আমার বাকি দুই বন্ধু ট্রেন আশা ছেড়ে দিয়েছে। সোহাগ জিজ্ঞেস করতে লাগল আমরা বাস এ কালকা যেতে পারব কি না? আমি ব্লগে কালকা মেইল এর ডিলে করার কথা জানলেও ওদেরকে বললাম না, ক্ষীণ একটা আশা নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করতেছিলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে ওদের কে ভাড়া দিতে বলে আমি দৌড় দিলাম ইনফরমেশন সেন্টার এর দিকে। দেখি ওইখানে অনেক ভিড়। ভিড় ঠেলে যখন সামনে গিয়ে কালকা মেইল এর কথা জিজ্ঞেস করলাম আমার হার্টবিট তখন বন্ধ হবার জোগাড়। কিন্তু আমার হার্টবিট টা কে সচল রেখে ওরা জানালো যে কালকা মেইল ২ ঘণ্টা লেট। এবং সেই সাথে ঢাকা থেকে দিল্লী পর্যন্ত দৌড়ের সমাপ্তি ঘটল।
পুনশ্চঃ আপনারা যদি ভাবেন দৌড় শেষ, তাহলে আমার কিছু করার নাই......
দিল্লী তে ট্যাক্সি ভাড়া উঠেছিল ১১০০ রুপি।
দৌড়াতে দৌড়াতে সময় শেষ তাই আর ছবি তোলা হয় নাই, পরের পর্বে আশা করি ছবি দিতে পারব।
এবং যে মহান ভাই এর ব্লগ পরে আমার এই লাদাখ ভ্রমণ এর পরিকল্পনা তার নাম সারাফাত রাজ।
লাদাখ ভ্রমনঃ শতাব্দী প্রাচীন কালকা মেইল এবং টয় ট্রেন
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১২:৩১