৩য় পর্ব
দার্জিলিং এ আমরা এসেছিলাম তিন জন। পরে আরও ৬ জন মিলে মোট ৯ জনের গ্রুপ হয়ে গিয়েছিল। এবং আমরা গত দিন ঘুরেছিলাম রক গার্ডেন, রোপওয়ে, চা বাগান, তেনজিং রক, চিড়িয়াখানা এবং হিমালয়ান মাউন্টেইনিং ইন্সিটিউট।
২৮ এপ্রিল, ২০১৬
আজ আমাদের প্রথম গন্তব্য টাইগার হিল। আগের দিন রাতেই হোটেল এর সাথে কথা বলে আমরা ১৫০০ রুপি তে গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলাম। গাড়ি আমাদের হোটেল থেকে পিক করার কথা ভোর ৪ টায়। আজকের অবশ্য আমরা ৫ জন। মামুন ভাই, ভাবী, ইকবাল ভাই, আর সজিব ভাই আজকের সকালে শিলিগুড়ি চলে যাবে। ভোর সাড়ে তিন টায় ঘুম থেকে উঠে হোটেল বয় কে গাড়ির ড্রাইভার কে ডাকতে বলে আমরা রেডি হলাম। শুভ, রাফি আর সোহাগ এর মধ্যে চলে এল। কিন্তু ড্রাইভার ব্যাটা এসে যে আবার কই গেল আমরা ফোন দিয়ে ও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। প্রায় সোয়া ৪ টায় হারামজাদা( গালি দিলাম বলে সরি) এসে গাড়ি বের করল। মেজাজ টা চরম গরম হয়ে ছিল। আমরা টাইগার হিল এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আশে পাশে দেখে মনে হচ্ছিল যে পুরো দার্জিলিংবাসী টাইগার হিল এর উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। এবং রাস্তায় গাড়ির সারি যার ফলে দ্রুত আগানো যাচ্ছে না। একবার মনে হয়েছিল যে আজকের আর যাব না, গিয়ে হয়ত সূর্যোদয় দেখতে পারব না, ফিরে যাই, কাল যাব। কিন্তু পরের দিন আবার ভোর সাড়ে ৩ টায় উঠতে হবে এই ভেবে ঐ ভাবনা বাদ দিয়ে দিলাম।
আমাদের আজকের গাড়ি
প্রায় ৫ টার দিকে আমাদের গাড়ি যখন থেমে যায় তখন ও আমরা টাইগার হিল থেকে অনেক দূরে। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে হু হু ঠাণ্ডার মধ্যে জোরে হাঁটা শুরু করলাম। বাকি রা দৌড়ে উপরে উঠে গেলেও আমি আর আমার বউ একটু পিছিয়ে পরলাম। যখন পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম, ততক্ষণে সূর্য্যি মামা উঠে গিয়েছে, এবং দূরে মেঘের জন্য কাঞ্চনঝঙ্গা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র অল্প ছায়ার মত দেখা যাচ্ছিল। ঐ ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে আমরা কফি খেলাম। ওদের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসে কাঞ্চনঝঙ্গা অনেক স্পষ্ট দেখা যায়। আমরা ওইখানে প্রায় সাড়ে ৭ টা পর্যন্ত ছবি তুলে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসলাম।
টাইগার হিল এ সূর্যোদয়
সূর্য ওঠার পর আশপাশ
দূরে কাঞ্চনঝঙ্গা
আমাদের পরের গন্তব্য ঘুম বৌদ্ধ মন্দির। এই মন্দির টি ঘুম রেল স্টেশন এর থেকে একটু খানি দূরে রাস্তার পাশে অবস্থিত। এইখানে আমি তেমন কোনও আগ্রহ পাই নাই। একটু খানি নেমে কয়েকটা ছবি তুলে বেড়িয়ে আসলাম। কিন্তু আমাদের সাথের বাকি তিন জন ওইখানে এক গাদা শাল কিনল। আমি সোহাগ কে মানা করেছিলাম ঐখান থেকে কিনতে, কারন দাম টা আমার কাছে বেশি মনে হচ্ছিল। তবুও সোহাগ, রাফি আর শুভ প্রত্যেকে প্রায় ৫-৬ টি করে শাল কিনল। পরে সোহাগ অবশ্য আফসোস করেছিল। কারন আমরা বিগ বাজার এর সামনের মার্কেট থেকে এর প্রায় অর্ধেক দাম এ শাল কিনেছিলাম।
ঘুম মনাস্ট্রি
মন্দির থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম বাতাসিয়া লুপ।এন্ট্রি টিকেট জন প্রতি ১৫ রুপি। বাতাসিয়া লুপ হল একটা পার্কের মত, মাঝে গোর্খা জাতির একটা ওয়ার মেমোরিয়াল, এবং এইখানে টয় ট্রেন লুপ নিয়ে ঘুরে যায়। এখানে এসে এত মানুষের ভিড় দেখে ভালো লাগে নাই। আমরা ১৫ মিনিটের মধ্যে ছবি তুলে এই স্পট ভ্রমণ শেষ করলাম। তবে বাতাসিয়া লুপ জায়গাটা আমার ধারনা বিকাল বা সন্ধায় খুব ভালো লাগবে। আর এখান থেকে কাঞ্চনঝঙ্গা কে আরও স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাবে (তবে অবশ্যই মেঘ কম থাকলে)।
বাতাসিয়া লুপ
বাতাসিয়া লুপ থেকে দেখা মেঘের ভেলা
দার্জিলিং এ যারা ঘুরতে আসে তারা সবাই সকালে থ্রি পয়েন্ট নামে উপরের তিন টা স্পট ভ্রমণ করে। কিন্তু আমরা গাড়ির সাথে কথা বলে আরও একটি স্পট বেশি নিয়েছিলাম। কিন্তু এর জন্য কোনও এক্সট্রা চার্জ ছিল না। বাতাসিয়া লুপ থেকে বের হয়ে আমরা ছুটলাম জাপানিজ পিস প্যাগোডা দেখতে। পিস প্যাগোডা দার্জিলিং শহরের অন্যতম উঁচু জায়গায় অবস্থিত। আমরা আবার পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠা শুরু করলাম। এখানে এসে সব থেকে যে জিনিস টা ভালো লেগেছে সেটা হল, একদম উপরে দাড়িয়ে পুরো দার্জিলিং শহরের বার্ডস আই ভিউ পাওয়া যায়, এক কথায় অসাধারণ।
জাপানিজ পিস প্যাগোডা
পিস প্যাগোডা থেকে দার্জিলিং শহরের ভিউ
আমাদের ৪ টি স্পট ঘুরে হোটেল এ ফিরতে প্রায় সাড়ে ৯ টা বেজে গিয়েছিল। আজকের সকালে আমরা ব্রেকফাস্ট এর জন্য গেলাম আর ও একটি বিখ্যাত দোকান Glenary's এ। এটা মূলত ফাস্ট ফুড আর কুকিজ এর জন্য বিখ্যাত। এর বারান্দায় বসে এক কাপ কফি পান করা টা অসাধারণ লাগে। তবে সকালে আমরা কফি খাই নাই। আমরা চিকেন রোল এবং পাই খেয়েছিলাম। আমাদের নাস্তার বিল আসছিল জন প্রতি ৫৫ রুপি।
Glenary's
নাস্তা করতে করতে সাড়ে ১০ টা বেজে যায়। এদিকে ১১ টা বাজে আমাদের টয় ট্রেন জয় রাইড এর টিকেট কাটা। নাস্তা শেষ করে হোটেল এ কোনও রকম ফ্রেশ হয়ে আমরা পড়িমরি করে ছুটলাম রেল স্টেশন এর দিকে। আমাদের হোটেল এর ঠিক বিপরীতেই Glenary's এবং হোটেল থেকে রেল স্টেশন হেঁটে যেতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট। ১০ টা ৫৫ মিনিটে আমরা রেল স্টেশন পৌঁছাই।
দার্জিলিং রেল ষ্টেশন এর সামনে থেকে
১১ টায় শুরু হয় আমাদের টয় ট্রেন জয় রাইড। এটা নাম এ জয় রাইড হলেও আমাদের সবার কাছে মনে হয়েছে টর্চার রাইড।
যারা টয় ট্রেন এ উঠতে চান তারা ঘুম থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত লোকাল টয় ট্রেন এ যেতে পারেন। ঘুম থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত সপ্তাহে তিন দিন টয় ট্রেন চলে এবং যেতে সময় লাগে ৫ ঘণ্টার মত। সেই সাথে এর টিকেট এর দাম ও এত বেশি না, যতদূর মনে পড়ে ৩০০-৩৫০ রুপির মত।
ঘুম থেকে শিলিগুড়ি টয় ট্রেন এর রুট
দার্জিলিং এর জয় রাইড দুই ধরনের ইঞ্জিন দিয়ে পরিচালনা করা হয়। একটা পুরনো ষ্টীম ইঞ্জিন আর একটা ডিজেল ইঞ্জিন। ষ্টীম ইঞ্জিনচালিত ট্রেন এর ভাড়া ছিল ১১০০ রুপি জন প্রতি, আর আমরা নিয়েছিলাম ৬৩০ রুপির ডিজেল ইঞ্জিনচালিত ট্রেন এর টিকেট। আমাদের দুর্ভাগ্য ছিল আমাদের ১০ মিনিট আগেই ষ্টীম ইঞ্জিনচালিত ট্রেন টি ছেড়ে যায় এবং কিছুদূর গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের ট্রেন ছেড়ে ঐ ট্রেন এর পিছে গিয়ে প্রায় ১ ঘণ্টা থেমে থাকে। তারপর ও ঐ ট্রেন ঠিক না হওয়ায় এবার আমাদের ট্রেন টি সামনের ষ্টীম ইঞ্জিন এর ট্রেনটিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়।
সামনের ট্রেন ইঞ্জিন বিকল অবস্থায়
ঘুম রেল ষ্টেশন
টয় ট্রেন যাওয়ার সময় বাতাসিয়া লুপ এ ১০ মিনিটের বিরতি দেয়। এরপর ঘুম রেল স্টেশন এ গিয়ে আধা ঘণ্টা বিরতি দিয়ে আবার দার্জিলিং ফেরত আসে। আসলে গত পরশু থেকে আজ পর্যন্ত এইটুকু রাস্তায় আমরা প্রায় ৫ বার এর মত আসা যাওয়া করছি। ফলে এই রাস্তার নতুনত্ব কিছু তো নাই ই আবার আমাদের সময় এবং ৬৩০ রুপি পুরাই নষ্ট হল। আমরা টয় ট্রেন রাইড শেষে যখন দার্জিলিং ফেরত আসি তখন ঘড়িতে প্রায় ২ টা বাজে। এবং সেই সাথে আমাদের রোপওয়ে তে চড়ার সমস্ত প্ল্যান নষ্ট হল। (পুনশ্চঃ আমাদের প্ল্যান ছিল ১১ টা থেকে ১ টা পর্যন্ত টয় ট্রেন এ ঘুরে আমরা ২ টার মধ্যে রোপওয়ে তে যাব। কারন রোপওয়ের লাস্ট বগি টা ২ টার সময় ছাড়ে।)
টয় ট্রেন এবং ষ্টীম ইঞ্জিন
ট্রেন থেকে নামতেই শুরু হল বৃষ্টি। প্রথমে অল্প একটু পর থেমে গেলে আমরা কোনও মতে হেঁটে চৌরাস্তায় আসতে না আসতেই আবার বৃষ্টি শুরু হল। শুধু বৃষ্টি বললে ভুল হবে, একেবারে আকাশ ফুটো করে শিলা কে নিয়ে অঝোর ধারায় পরতে লাগল। আমরা রাস্তার পাশে একটা হোটেল এ আশ্রয় নিলাম। এক ঘণ্টা পর বৃষ্টি থামলে আমরা দুপুরের খাবারের জন্য আজকের গেলাম চকবাজার এর ইসলামিয়া হোটেল এ। দার্জিলিং এর মসজিদ এর পাশে এটা একটা মুসলিম হোটেল। সেখানে অনেক দিন পর বিরিয়ানি খেলাম। এছাড়া ওদের গরুর ভুনা ও খুব মজা। জন প্রতি খাবার বিল আসল ১০০ রুপি করে।
যেহেতু রোপওয়ে তে ওঠা হয় নাই, তাই আমাদের প্ল্যান ছিল দুপুরের খাবার খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে Happy Valley Tea Estate এ যাব। কিন্তু বিধি বাম হোটেল এ ফিরতেই শুরু হল আবার বৃষ্টি।
হোটেল রুম এর জানালা থেকে বৃষ্টি(বিকাল ৪ টা)
এক ঘণ্টা পর বৃষ্টি থামলে আমরা নিচে নামলাম আবার শুরু হল বৃষ্টি। আমি আর আমার বউ বাধ্য হয়ে Glenary's এ বসে দুই কাপ কফি খেলাম ৭৫ রুপি করে জন প্রতি।
বিকালে Glenary's এর বারান্দায় বৃষ্টিতে
৬ টার দিকে বৃষ্টি একটু কমলে আমরা হেঁটে হেঁটে বিগ বাজার এ গেলাম কিছু কেনা কাটা করতে। বিগ বাজার এ গেলাম আবার শুরু হল শিলাবৃষ্টি। ঐখান থেকে আমরা চা আর অল্প কিছু কেনাকাটা করলাম। এতেই রাত প্রায় ১০ টা বেজে গেল। তখন ও আমাদের রাত এর খাওয়া হয় নাই। আজকের ও দৌড়াতে দৌড়াতে ম্যাল এর স্ট্রীট ফুড এর দোকান গুলোতে আসলাম, কিন্তু আজ সকাল থেকেই ভাগ্য আমাদের প্রতি সুপ্রসন্ন না, ফলে দোকান পাট সব বন্ধ পেলাম। আবার হেঁটে চৌরাস্তায় গেলাম, ওইখানে একটা হোটেল এর নিচে রেস্টুরেন্ট এ ভাত আর মুরগি পাওয়া যাচ্ছিল, আমি আর আমার বউ তাই খেলাম। সোহাগ কিছুই খায় নাই। আমাদের দুই জনের বিল আসল ১৬০ রুপি। আজকের ই আমাদের দার্জিলিং এ এই ট্যুর এর শেষ রাত। তাই প্ল্যান করছিলাম যে ম্যাল এ গিয়ে আড্ডা দিব। কিন্তু যাওয়ার পথে আবার বৃষ্টি নামলে বাধ্য হয়ে আমরা হোটেল এ ফিরে আসলাম।
মেঘ পাহাড়ের দেশ - দার্জিলিং এ কয়েকদিন ( ৫ম পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:৪৮