২য় পর্ব
আমরা দার্জিলিং এসে পৌঁছাই ২৬ এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল সাড়ে ৫ টায়। এরপর হোটেল ঠিক করে ঐ রাতে শুধু ম্যাল এ হাঁটাহাঁটি করে রাত হয়ে যায়।
২৭ এপ্রিল
সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলতেই ঠাণ্ডা বাতাসের হিমেল ছোঁয়ায় দেহ মন জুরিয়ে যায়। ঝটপট রেডি হয়ে হোটেল এর নিচে নেমে ম্যাল রোড ধরে হাঁটতে থাকি।এই সকাল বেলা শহরের বৃদ্ধ, যুবক, পুরুষ, মহিলা সবাই হাঁটতে বেড়িয়েছে। ম্যাল রোড এ গিয়ে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। দার্জিলিং এ সকাল সাড়ে ৭ টা - ৮ টা নাগাদ খাবারের দোকানগুলো খোলে। আজকের কোনও প্ল্যান এখন ও করা হয় নাই। তাই চিন্তা করলাম সকালের নাস্তা করতে করতে প্ল্যান করে ফেলব। সকালের নাস্তা করার জন্য আমরা Keventers এ গেলাম।
Keventers এ নাস্তার সময় সোহাগ
এই রেস্টুরেন্ট টি মূলত দার্জিলিং এর সব থেকে পুরাতন গুলর মধ্যে একটি এবং ইংলিশ ব্রেকফাস্ট এর জন্য বিখ্যাত। আমরা দোতলায় উঠে একদম পিছনের দিকের টেবিল এ বসলাম। এই টেবিলটির বিশেষত্ব হচ্ছে দার্জিলিং এ যত মুভি এর শুটিং হইছে প্রায় সব গুলোতে এই টেবিল টি ছিল। এখানে কিভাবে খাবার অর্ডার দেব এই নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। কারন বাজেট ট্রাভেলার দের জন্য সকালের নাস্তার খরচ টা একটু বেশি হয়ে যাবে। আমাদের সমস্যা সমাধান করে দিল পাশের টেবিল এর এক লোক। সে বেচারা একটা চিকেন সসেজ অর্ডার দিয়ে শেষ করতে পারছিল না। আর আমরাও বুঝে গেলাম কি করতে হবে। আমরা তিনজনের জন্য একটা সসেজ, প্রত্যেকের জন্য টোস্ট, অমলেট এবং কফির অর্ডার করলাম। সকালের নাস্তায় তিন জনের বিল আসছিল ৩৭৫ রুপি।
নাস্তা করার ফাঁকে আমরা আমাদের ট্যুর প্ল্যান টা করে ফেললাম। যদিও ঐ প্ল্যান টা কোনও কাজেই আসে নাই। কারন আমাদের ঐ দিনের প্ল্যান ছিল হেঁটে হেঁটে অনেকগুলো স্পট কাভার করা। আসলে একটু হাঁটলেই দার্জিলিং এর অনেকগুলা স্পট ঘুরে শেষ করা যায়। এ নিয়ে পরে আলোচনা করবো। আমাদের প্ল্যান ছিল যেহেতু হাঁটা, তাই নাস্তা শেষ করে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। ১০ মিনিট হেঁটে যখন আমরা ম্যাল এর পেছনে ভানু ভবন এর সামনে এসে পৌঁছালাম, তখন দেখা হয়ে গেল মামুন ভাই, ভাবী, ইকবাল ভাই, সজিব ভাই, রাফি আর শুভর সাথে।
ভানু ভবন
আমরা শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং একসাথে এসেছিলাম। তারপর গত রাত এ আলাদা হোটেল এ থাকার ফলে এবং কোনও কন্টাক্ট নাম্বার না থাকার কারনে তাদের প্ল্যান সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। আমরা তিন জন আমাদের মত প্ল্যান করেছিলাম। তাদের সাথে দেখা হওয়ার পর জানা গেল তারা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতেছিলেন। তারা ঐ দিন সাত টি স্পট ঘোরার জন্য গাড়ি ঠিক করে ছিলেন। তো আমরাও তাদের সাথে যোগদান করলাম। এতে এক দিয়ে খুব এ ভালো হয়েছিল, একসাথে বেরানো গেছে এবং খরচ ও কম হয়েছিল।
আমাদের আজকের গাড়ি
একটু পর গাড়ি আসল এবং আমরা প্রথমেই চললাম রক গার্ডেন এর উদ্দেশ্যে। রক গার্ডেন মূলত পাহাড়ের নিচে কত গুলো পাথরের উপর দিয়ে প্রবাহিত একটা ঝর্না যা দার্জিলিং এর ম্যাল থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। রক গার্ডেন এ যেতে হলে পাহাড়ের নিচে নামতে হয়। রক গার্ডেন যাওয়ার রাস্তাও অসম্ভব রকমের সুন্দর। আমরা ক্রমাগত একটা করে তীক্ষ্ণ বাঁক পেরিয়ে নিচে নামতেছি আর আগের দিনের মত ইকবাল ভাই কে তার উচ্চতাভীতির জন্য পচাচ্ছি। পথিমধ্যে আমরা একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে কিছুক্ষণ ফটোসেশন করে নিলাম। এক পাশে পাহাড়ি রাস্তা, আর এক পাশে চা বাগান, দূরে পাহাড়ের উপর মেঘমালা ঘনীভূত হতে শুরু করেছে তার সাথে হিমেল হাওয়া, আহা সে যেন এক অপার্থিব পরিবেশ।
রক গার্ডেন যাওয়ার পথে
ফটোসেশন শেষে আমরা আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। এবং গল্প করতে করতে আমরা এক সময় পৌঁছে গেলাম রক গার্ডেন। রক গার্ডেন এ এন্ট্রি ফি জন প্রতি ১০ টাকা। আমরা টিকেট কেটে রক গার্ডেন এ প্রবেশ করলাম। দার্জিলিং এর একটা বিষয় আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে সেটা হল ওরা পরিবেশের পরিচ্ছনতা নিয়ে অনেক সচেতন। আমি রক গার্ডেন এর কোথাও কোনও আবর্জনা, চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল পাই নাই। সবাই ময়লা নির্দিষ্ট ডাস্টবিন এ ফেলছে। আমরা প্রায় ৪০ মিনিটের মত রক গার্ডেন এ ফটোসেশন করে যখন বের হলাম তখন সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে, এবং একটু গরম ও লাগছিল। রক গার্ডেন থেকে বের হয়ে আমরা নুডলস খেলাম।
রক গার্ডেন
আমরা ৯ জন, একমাত্র গ্রুপ ছবি
রক গার্ডেন থেকে ফেরার পথে আমরা পরদিন দার্জিলিং এর বিখ্যাত টয় ট্রেন এ জয় রাইড এর জন্য টিকেট কেটে নিলাম। টয় ট্রেন এ অবশ্য আমরা তিন জন এবং রাফি আর শুভ আমাদের সাথে ছিল। দুই ঘণ্টা জয় রাইড এর জন্য জন প্রতি টিকেট ছিল ৬৩০ রুপি করে।(অবশ্য এই টা ছিল চরম বাজে অভিজ্ঞতা যার জন্য আমরা রোপওয়ে তে উঠতে পাড়ি নাই)।
টয় ট্রেন এর তখনকার শিডিউল
রেল স্টেশন থেকে টয় ট্রেন এর টিকেট কেটে আমরা গেলাম রোপওয়ে তে। কিন্তু গিয়ে দেখি সেদিন সংস্কার কাজের জন্য রোপওয়ে বন্ধ ছিল। এর পর আমরা গেলাম চা বাগান দেখতে। চা বাগান বলতে রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান থেকে দুই পাহাড়ের নিচে চা বাগান দেখা, যা আমাদের কাছে তেমন আকর্ষণীয় লাগে নাই। আসলে আমাদের দেখার কথা ছিল Happy Valley Tea Estate. যেখানে চা এর প্রসেসিং দেখা যেত। কিন্তু সাধারণত ড্রাইভার রা ওইখানে নিয়ে যায় না। যারা চা বাগান দেখতে চান তারা Happy Valley Tea Estate এ যাবেন। এইটা আরও কাছে। আমি পরদিন ট্যুরিস্ট ইনফো সেন্টার থেকে ওইখানে যাওয়ার পরামর্শ নিয়েছিলাম। যদিও যাওয়া হয় নি। তবে চা প্রসেসিং দেখতে হলে অবশ্যই সকালে যেতে হবে।
চা বাগান দেখা শেষ করে আমরা গেলাম তেনজিং রক দেখতে। এটা আসলে হিমালয়ান মাউন্টেইনিং ইন্সিটিউট এর ট্রেনিং এর প্রথম ধাপ হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং নরগে এর স্মরণে এর নাম দেয়া হয়েছে তেনজিং রক। দর্শনার্থীরা ৫০ রুপির বিনিময়ে ইচ্ছা করলে উপরে উঠতে পারে। এতে অল্প ক্লাইম্বিং এর মজা পাওয়া যায়। আমরা অবশ্য কেউ ই ৫০ রুপি খরচ করি নাই। ঐখান থেকে আমরা এরপর গেলাম চিড়িয়াখানা এবং হিমালয়ান মাউন্টেইনিং ইন্সিটিউট এ। আমার কাছে হিমালয়ান মাউন্টেইনিং ইন্সিটিউট এর জাদুঘর টা অনেক ভালো লেগেছে। দুইটা স্পট এ এন্ট্রি একটাই এবং টিকেট ৪০ রুপি জন প্রতি। চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করেই আমরা পাখির খাঁচার দিকে গেলাম। এরপর একটা ভালুক কে দেখলাম গম্ভির মনে পায়চারি করছে। ভালুক টাকে আমাদের খুব ই পছন্দ হয়েছিল। খুব গাম্ভীর্য নিয়ে একবার সামনে আসছিল আবার অদ্ভুতভাবে ঘুরে পিছনে যাচ্ছিল।
ভালুক মামা
আমরা চিড়িয়াখানার কিছু অংশ ঘুরে চলে গেলাম হিমালয়ান মাউন্টেইনিং ইন্সিটিউট এর জাদুঘরে। জাদুঘরে অবশ্য আমি , আমার বউ এবং সোহাগ ছাড়া কেউ যায় নাই। সবাই চিড়িয়াখানায় ব্যাস্ত ছিল। জাদুঘরে এসে মনে হল আমরা হিমালয়ের পর্বতমালার মধ্যে হারিয়ে গেলাম। এর নিচ তলায় পুরো হিমালয় এর বিভিন্ন পর্বত বিষয়ে এবং দ্বিতীয় তলা শুধুমাত্র দ্য বস এভারেস্ট এর বিভিন্ন বিষয় দিয়ে সাজানো।
হিমালয়ান মাউন্টেইনিং ইন্সিটিউট এ আমি আর সোহাগ
আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা ঘুরে যখন বের হলাম তখন বিকাল প্রায় ৪ টা বাজে। তখন খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। কিন্তু তখন ও চিড়িয়াখানা অর্ধেক দেখা বাকি।
লাল পাণ্ডা
আমরা খুব তাড়াতাড়ি ৩০ মিনিটের মধ্যে বাকিটুকু ঘুরে যখন বের হলাম তখন গাড়িসহ সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এরপর আমরা ১০ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেই ভানু ভবন এর সামনে।আজকের সারাদিন এর জন্য গাড়ি ভাড়া ছিল ১৪০০ রুপি। ৯ জনের জন প্রতি খরচ পড়ল ১৬০ রুপি করে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা, শুভ এবং রাফি গেলাম আমাদের হোটেল এর সামনে এক রেস্টুরেন্ট এ ইন্ডিয়ান থালি খাবার খেতে। বিকাল ৫ টায় খেলাম দুপুরের খাবার। ১৩০ রুপির সাউথ ইন্ডিয়ান থালি নামক জঘন্য খাবার খেলাম। খাবার খেয়ে শুভ , রাফি আর সোহাগ গেল মুভির টিকেট নিতে আর আমি হোটেল এ ফিরে আসলাম পরদিন ভোরবেলায় টাইগার হিল এ যাওয়ার গাড়ি ঠিক করতে। ১৫০০ রুপি দিয়ে পরদিন ভোর এর জন্য গাড়ি ঠিক করে আমরাও বিগ বাজার এ সিনেমা হল এ চলে গেলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় তখন ওইখানের সিনেমা হল এ শাহরুখ খান এর ফ্যান মুভি চলছিল। ১৫০ রুপি জন প্রতি টিকেট এ হল এ গিয়ে দেখি আমরা ৫ জন সহ মোট দর্শক ১২ জন। পুরো সিনেমা হল এ মাত্র ১২ জন একটু কেমন কেমন লাগছিল। রাত সাড়ে ৯ টায় মুভি দেখা শেষ করে যখন বের হলাম তখন দার্জিলিং শহর ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমাদের তখন ও রাতের খাওয়া হয় নাই। বের হয়ে দেখি সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। দৌড়ে ম্যাল এর স্ট্রিট ফুড এর দোকানগুলোতে গেলাম। আমাদের সৌভাগ্য যে তখন ও ওইখানে দুইটা দোকান বন্ধ হয় নাই। আমরা ওইখানে নুডলস, মম খেয়ে ডিনার শেষ করলাম।এবং কিছু স্ন্যাক্স কিনে নিলাম রাতের খাবার এর জন্য। এরপর রাৎ ১১ টা পর্যন্ত ম্যাল এ সময় কাটিয়ে হোটেল এ ফিরে গেলাম।
রাতের ম্যাল রোড
পরদিন আবার ভোর ৪ টায় উঠতে হবে
মেঘ পাহাড়ের দেশ - দার্জিলিং এ কয়েকদিন ( ৪র্থ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:৪৫