কবি ফ্রাঞ্জ রাইট-এর একটি সাক্ষাৎকার (১ম পর্ব)
কবি ফ্রাঞ্জ রাইট-এর সাক্ষাৎকার (২য় পর্ব)
কবি ফ্রাঞ্জ রাইট-এর সাক্ষাৎকার (৩য় পর্ব)
তৃতীয় পর্বের পর ...
সাক্ষাৎকারী : আপনার সর্বশেষ বইটির নাম ‘গড'স সাইলেন্স’ কেন দিয়েছেন? ‘গড'স সাইলেন্স’ কথাটির অর্থ কি আপনার কাছে?
ফ্রাঞ্জ রাইট : নিরবতা মানেই অনুপস্থিতি বোঝায় না। এটা প্রকৃতপক্ষে আমাদের সেই মুক্তির দিকে ইঙ্গিত করে, যেন আরও উচ্চ পর্যায়ের আত্মিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি। যেমনটি চাই তেমনি যেন করতে পারি। ঈশ্বর কোনো মন্তব্য করেন না। মুক্ত ইচ্ছে বা কামনার প্রতিফলন যেন। হ্যাঁ, মানুষের জন্য সব চেয়ে বড় কথা হলো নিজেকে সমর্পণ করা, আপন ইচ্ছেকে বলি দিয়ে পরম ঈশ্বরের ইচ্ছের আলোয় বাঁচা, কিন্তু এই একটি ব্যাপার যেখানে আমরা সবসময় ব্যর্থ হই। যদি আমরা আপন চাওয়াকে ত্যাগ করি, আমরা এক শাশ্বত সম্ভাবনাময় জগতে প্রবেশ করি যেন, কিন্তু বহাল থাকতে পারি না। খ্রীষ্টিয় গূঢ়ার্থ এই নিরবতার কথা বলে যেন তা ঈশ্বরের ভাষা। আমার প্রথা হচ্ছে, থমাস ক্যাটিং এর প্রবর্তিত প্রথা, মার্টনের সাথে কিছুটা মিলিয়ে, যাকে বলা যায় কেন্দ্রীয় প্রার্থনা। বৌদ্ধীয় মনোসংযোগ পদ্ধতি ধার করে অনেকটা। সমস্ত ছবি, চিন্তা, ভাষা পরিত্যাগ করে এমনভাবে আসন নিয়ে বসতে হবে যেন মনে হয় আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে সচেতন। তিনি আমার সামনেই উপস্থিত আছেন। ভাষা মানে হচ্ছে সেই ব্যপার যাকে অপেক্ষায় থাকতে হয়। প্রথমে ঈশ্বরের নিরব অস্তিত্বে যাপন করতে হয় আমাদের, আর তারপর ধীরে ধীরে আমাদের মনের সমস্ত ভার নির্ভার হয়ে যায়।
যখন লিখতে শুরু করি, জানি না কী লিখি আমি। শুরুতে কিছুই জানা থাকে না। হয়তো বুঝতে পারি একেবারে শেষে। কিন্তু আমি শুনি। শুনতে থাকি। লিখা যেন একপ্রকার শোনা। ধর্মীয় অভিজ্ঞতা যেন এক নিঃশব্দে শ্রবণ ও লিখন প্রক্রিয়া। আমি বলতে পারবো কোন লিখাটা স্বতঃস্ফূর্ত আর কোনটা মগজের কর্ষিত। পার্থক্যটা অনুভব করতে পারি, দেখতে পারি, আর স্বাদ নিতে পারি, কিন্তু আমি জানি না কীভাবে পারি। লিখা এমন নয় যে চাইলেই লিখতে পারি। আমি কেবল এর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি এবং লিখা এসে যায় আপনাআপনি।
সাক্ষাৎকারী : সেন্টার ফ গ্রিভিং চিল্ড্রেন এ আপনার কাজ নিয়ে কিছু বলুন।
ফ্রাঞ্জ রাইট : যখন বেথ-কে বিয়ে করি, প্রথম দিকে যখন চার্চে যাওয়া শুরু হয় আমার এটা তখনকার কথা। কিছু দিন চিল্ড্রেন সেন্টারের সাথে যুক্ত ছিলাম। সুখ তখন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মতোই বয়ে যাচ্ছিলো আমার জীবনে। আর সেটা একসময় দারুণ একটা ইচ্ছের আকার ধারণ করে, যেন কিছু একটা করি, ভালো পবিত্র কিছু, যা আগে কখনও করার সামর্থ্য হয় নি আমার। আমার মতোই যারা দুঃখ কষ্টের ভেতর দিয়ে জীবন যাপন করছে, যারা মানসিক ভাবে অসুস্থ অবস্থায় আছে, নেশাগ্রস্ত যারা, আর চেয়েছিলাম বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে যারা আপনজন হারিয়েছে। কেননা আমার শৈশবও ওইরকম ভাবে কেটেছে।
আমার বাবার অবর্তমানের শোক হচ্ছে আমার শৈশব আর কৈশোর। সবসময় তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছি। সেন্টারের যেসব ছেলেমেয়েদের বাবা-মা নেই তাদের মধ্যে আমি সেই শোক দেখতে পেয়েছিলাম। যাদের বয়স ছিল সাত কি আট তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করেছি। যাদের বাবা-মায়ের কেউ একজন নেই তাদের সাথে কাজ করেছি। কারণ, আমার ওই বয়সেই বাবা আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন। ওদের নিয়ে কবিতা লিখিনি। কাজ করেছি শুধু। ওই প্রোগ্রাম ছিল খুবই সংগঠিত। ছেলেমেয়েদের নিরাপদ আশ্রয় ছিল ওটা। ওদের মনে হতো সবসময় সহকর্মীদের সহচর্যে আছে। অন্য বাচ্চাদের মতো হাসি খুশি, উচ্ছ্বল। এভাবেই অনেকটা এলকোহলের আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার মতোই ছিল এটা আমার। হারানোর বেদনাই ছিল সাধারণ মান সেখানে, অন্যদিকে স্কুলে বা অন্য যেকোনো জায়গায় ওরা ছিল কিম্ভূত হিসেবে পরিচিত।
সাক্ষাৎকারী : আপনার লেখায় একটি বিষয়ের বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটে, সেটা হচ্ছে মৃত্যু। যেমন আপনি লিখেছেন :
“কিন্তু কীভাবে
কেমন করেইবা
যেতে পারে কেউ মৃত্যুর পথে?
কে আছো পৃথিবীতে
শেখাবে আমায়—
মানুষে পরিপূর্ণ এই বিশ্ব এমন
যাদের মৃত্যু নেই।”
ফ্রাঞ্জ রাইট : দারুণ একটা বিষয়ের অবতারণা করলেন। আমিও আসলে এ বিষয়ে এমন সচেতন ছিলাম না। যখন আমরা মৃত্যু নিয়ে কথা বলি, এর মানে মৃত্যু নিয়ে বিষাদে তন্ময় হওয়া নয়। বরং আরও গভীর ভাবে প্রাণময় হয়ে ওঠা, আরও গভীর ভাবে সচেতন হওয়া। “মৃত্যুই সৌন্দর্যের প্রসূতি,” বলেছিলেন ওয়ালেস স্টিভেন্স। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যেন আমরা ভেবে দেখি, কারো পরম না-থাকা ব্যপারটা এমন প্রভাব ফেলতে পারে যেন মনে হয় সে আরও দ্বিগুণ আরও গভীরভাবে উপস্থিত আছেন। এটা আরো বিশদ আকারে জেন বৌদ্ধবাদে পাওয়া যায়। এক বৌদ্ধ ভিক্ষু বলেছেন, “এই যে গ্লাসটি দেখছো, পানি খাচ্ছি? আমার চোখে, যদিও এটা ভাঙা, কিন্তু আমি এতে বিচলিত নই। মানে হচ্ছে আগের চেয়েও অনেক ভালো ভাবে একে উপভোগ করতে পারছি।” তিনি আসলে তাঁর দেহের কথা বলছিলেন। ইতিমধ্যে আমরা সবাই মৃত। যা কিছু অনুভব করেছি, বলেছি, চিন্তা করেছি, যা কিছু ঘটেছে আমাদের সাথে, এই মুহূর্তে যা ঘটছে, একেবারে সম্পূর্ণ রূপে মুছে যাবে যেন কখনো ঘটেনি। এই সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। আমার জন্য, এটা একটা শক্তির উৎস। দশগুণ বেশি গভীর ও সচেতন করে তোলে এটা। প্রাণবন্ত করে তোলে। ভয় পাওয়ায় না। সবকিছু আলোকিত করে তোলে।
এইরকম কিছু মৃত্যুর মুহূর্ত কবিতা লেখার প্রেরণা হয়ে উঠতে পারে। আমি হলফ করে বলতে পারি না এই রকম আনন্দময় অভিজ্ঞতা আমার আবারও হবে। সবসময় মনে হয়েছে, প্রতিটি কবিতা, সে যতো ছোটই হোক, যা বলতে চাই পুরোটাই যেন বলা হয়, যেন এ-ই শেষ সুযোগ। আমার কাছে, একটি কবিতা শেষ করার মূহুর্ত মানে, আমি অনুভব করি এই মূহুর্তটা আর আসবে না আমার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমার সেই সব এলোমেলো পদক্ষেপ যেন ওই মূহুর্তটুকুতে পৌঁছুতে পারি যেন নিজেকে নিঃসঙ্গ করি আর লিখে ফেলি একটি কবিতা। ওই অবস্থায় কীভাবে ফিরে যেতে হয় জানা নেই আমার, জানি না কীভাবে আবারো ঘটানো যায় ওটা। চেষ্টা করেছি অনেক বার। ভেবেছিলাম হয়তো কোনো উপায় পেয়ে গেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা কাজ করে নি। প্রত্যেকবার আমাকে শিখতে হয় কীভাবে সেটা ফিরিয়ে আনা যায় আবার। কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সাক্ষাৎকারী : সাহিত্যের জগতে বহুবছর আপনাকে বহিরাগত হিসেবে দেখা হয়েছে। আপনার কাজের উপর এর কোনো প্রভাব রয়েছে কি?
ফ্রাঞ্জ রাইট : এখনও আমি বহিরাগত, এবং তা-ই থাকতে চাই। একাডেমিক বিশ্ব একজন শিল্পীর জন্য মৃত্যুর নামান্তর। প্রতিদিন মামুলি জায়গায় অসাধারণ মূহুর্তের অবতারণার চেষ্টা যেন। কিন্তু আমার পৃথিবী, যেখানে আমার যাপন, সেখানে কবি হওয়া মানে সবার ধারণার বাইরের সবচেয়ে অসাধারণ একটি ব্যপার। আমি এভাবেই রাখতে চাই এটা। এটাই আমার নিজস্বতা আমার সর্বোস্ব। এ নিয়ে খেলার কিংবা কেড়ে নেয়ার সুযোগ দিচ্ছি না কাউকে।
সাক্ষাৎকারী : অধুনা আপনার কাজগুলো ভূয়সী প্রশংসায় গৃহীত হয়েছে সবার কাছে, তাই আপনি কি মনে করেন এখনো নিজেকে বহিরাগত হিসেবেই গণ্য রাখতে পারবেন?
ফ্রাঞ্জ রাইট : প্রশংসিত হওয়া মানে তো মনে মনে আরও সংরূদ্ধ আর সংগঠিত অনুভব করা যেন তোমার কাজ মহামূল্যবান সম্পদ, একে রক্ষা করতে হবে, যেন সবাই একে ধ্বংস করতে চায়। নিদারুণভাবে আত্মসুখে জর্জরিত আর অরক্ষিত আমি। তবে একধরনের মানসিক শক্তিও বলা যায় একে। কখনো মনে হবে না যা করতে চেয়েছি তা করে ফেলেছি। চোখের সামনে সর্বদা অপসৃত হতে থাকবে। ধরতে চাইবে কিন্তু পাবে না। আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।
আমার আত্মমর্যাদাবোধ এতো দূর্বল যে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েই তা ভেঙে পড়েছে। মনে হচ্ছে হুম, আমিও আছি। আর রাস্তায় এখন মাথা উঁচু করে হাঁটি। বাতাসে ভেসে একটুকরো কাগজ এসে পায়ের কাছে হুমড়ি খায় আমার, বিল নট যেমন বলেছিলেন, এমনকি আমার মৃত্যুর জন্য কোনো আবেদন পত্রও নয় এটা। আমার শশুর বাড়িতে আমাকে আগের চেয়ে বেশি পছন্দ করতে শুরু করে সবাই। অনেক টাকা পেয়েছি। কিন্তু এগুলো আমার লেখন পদ্ধতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। বরাবরের মতোই দারুণ রহস্য আর বেদনা, অনিশ্চিয়তা আর নিরাশার নিদারুণ এক উৎসই হয়ে আছে।
সাক্ষাৎকারী : যদি জানতে চাওয়া হয় তবে নতুন প্রজন্মের কবিদের জন্য আপনি কী উপদেশ দিতে চাইবেন?
ফ্রাঞ্জ রাইট : প্রথমেই যে তাড়নাটা দিতে চাই তা হচ্ছে, “ভিন্ন কিছু করো।” সত্যি বলতে, প্রথম থেকে যে ব্যপারটা আমাকে তাড়িত করেছে সেটা প্রেম। উচ্চাশা নয়, ভালোবাসা। যদি তোমার মধ্যে কোনো কিছুর জন্য প্রতিভা থেকে থাকে, যেকোনো কিছু, সেটা যা-ই হোক, তুমি এটা এতো ভালোবাসো যে সবসময় লেগে থাকবে, অন্বেষণে থাকবে, মতো ঝড়-ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন, যতো হতাশা, যন্ত্রণা আর প্রত্যাখ্যানের ভেতর দিয়েই যাও না কেন, দারুণ এক প্রেরণায় আচ্ছন্ন হবে তুমি। যদি সৎ হও, যদি এর জন্য তোমার অভিপ্সা হয় ভালোবাসা, তবে অবশ্যই প্রেরণা তোমাকে খুঁজে নেবে। যদি তুমি এ নিয়ে কাজ করো, যদি ভালোবাসো আর যত্ন নাও—উচ্চাশা নয়, শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা তোমার সহায়ক হবে। এবং সাফল্য আসবে, যদিও জানি অনেক আশা থাকে এর জন্য। আমরা জানি, এমিলি ডিকিনসন কিংবা ভ্যান গগের সাফল্য আসেনি। কিংবা হয়তো এসেছিল। হয়তো সেই চুড়ান্ত সাফল্য অর্জিত হয়েছিল ঠিকই। হয়তো তাঁদের আনন্দ মিলে মিশে একাকার হয়েছিল পার্থিব সাফল্যে। যেমন আমার হয়েছে। একটা বিপর্যয়। ঘটার আগে বুঝতে পারা যায় না, আর যখন বুঝবে তখন অনেক দেরী হয়ে যাবে। ফিরে যেতে পারবে না আর আগের অবস্থায়। নিজস্ব, একান্ত আর অজানা ভালোবাসার কিছুই আর ফিরে পাওয়া যায় না। হয়তো তাঁরা খুব ভাগ্যবান ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে ছিলেন যেখান থেকে হয় প্রকৃত শিল্পের বিকাশ। খ্যাতি অর্জন করে ফেললে, আত্ম-সচেতনতার এমন একটা দিক আছে, যা আর এড়ানো যায় না।
বয়স হয়েছে তাই হয়তো, নিজের সাথেই বোঝাপড়া করেছি যেন মেনে নিই, সবকিছু নিয়ে এতো আদর্শিক হতে নেই, মেনে নেই একেকজন একসাথে অনেক কিছু করতে পারে। অনুশীলনের মাধ্যমে একটি কবিতা লিখার গোপন চেষ্টাকারী মাত্র আমি, চেষ্টা করতে পারি কাব্যশিল্পের একজন প্রতিনিধি হতে। কিন্তু সার্থক কবিতা লিখতে না পারার যন্ত্রণা আর ব্যার্থতার অনুভব থেকে এগুলোর কেউ আমাকে মুক্তি দিতে পারবে না। কিছুতেই এই যন্ত্রণার উপশম নেই। কেউ এটা দূর করতে পারবে না। এই ব্যাথাটাই আমার সর্বস্ব এখন।
ছবি : ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:৩৮