কবি ফ্রাঞ্জ রাইট-এর সাক্ষাৎকার (১ম পর্ব)
কবি ফ্রাঞ্জ রাইট-এর সাক্ষাৎকার (২য় পর্ব)
২য় পর্বের পর..
সাক্ষাৎকারী : এই পরিবর্তন আপনার লিখায় কেমন প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে আপনার স্বর ও ভঙ্গিতে?
ফ্রাঞ্জ রাইট : লোকে যেভাবে বলে আমি অবশ্য তেমন কোনো পরিবর্তন দেখি না আমার লেখায়। হ্যাঁ, কিছুটা বিষয়ভিত্তিক আর স্বর সম্পর্কিত পরিবর্তন আছে বলা যায়—যদিও শেষ তিনটি বইয়ে কিছু অশুভ ব্যাপার রয়েছে আর এর আগের গুলোয় আছে আনন্দের কবিতা। ভেবেছিলাম আর কখনো পারবো না, কিন্তু এই সবটাই হতে পেরেছে কারণ আমি আবারও লিখতে পারছিলাম। সেই শক্তি আর উদ্যম সত্যি উৎসাহ উদ্দীপক আর বিষ্ময়কর। যা এর মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসে। একধরনের আনন্দ এবং উদ্যম আছে, এমনকি অশুভ কাজের ভেতরেও তা থাকে, কেবল একটু আলাদা রকম।
আমার সদ্য প্রকাশিত বইগুলোয় লক্ষ্য করেছি, এই যেমন 'গড'স সাইলেন্স’এ, ‘আলো’ শব্দটি বহুবার এসেছে। এর আগে ছিল 'আঁধার’, 'আঁধার’, 'আঁধার’। যদিও জানি ধর্মীয় অভিজ্ঞতা মানুষের লিখায় রং চড়ায়, আমার ক্ষেত্রে তার উল্টো, আমার মনে হয় আমার লেখা আর আমার ধর্মীয় অনুভূতি দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। বলা যায়, লেখা হচ্ছে অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানকে সংরক্ষণ, একটা স্থায়ী কাঠামো দান, শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও জীবনের ভেতর দিয়ে একে বয়ে নিয়ে যাওয়া। সাত বছর আগে আবার লিখতে শুরু করার পূর্বে, মনে হোতো কবিতা একধরনের ধর্ম। ভাবতাম, কবিতা স্বর্গীয়, সমস্ত কিছুর লক্ষ্য কবিতা। পরিবর্তন যদি কিছু হয়ে থাকে তা হচ্ছে আমি এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছি: কবিতাকে লিখে শেষ করে ফেলার আর কোনো প্রয়োজন নেই। কবিতা আসলে এক জায়গা থেকে পরবর্তী জায়গায় পৌঁছার একটি ধাপ। ওই কবিতা গুলো ছিল এমন একটি জায়গা খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা যেখানে বাস্তব জীবনের পরম আবেগ, সঙ্গতি আর উদারতার আনন্দ আর নিশ্চয়তাকে সংগ্রহ করা যাবে।
এই নিশ্চয়তার অভিজ্ঞতা আমার ছিল, কেবল প্রয়োজন ছিল একে অক্ষুণ্ন রাখার, কেননা এর জন্য আমি তেমন ভালো গোছানো ছিলাম না কখনো। হতে পারতো লেখালেখি একেবারে ছেড়ে দিয়ে অলস সময় কাটাতাম সারাদিন আর কেবল ধর্মীয় চিন্তায় মগ্ন থাকতাম। তা না করে আমি যা করেছি, হয়তো তার চেয়ে সেটার আরো ভালো প্রভাব থাকতো সমাজে। আসলে সাহিত্যের প্রতি আমার ভালবাসাকে কখনো উৎরে যেতে পারিনি। যেন আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে চির প্রোথিত। পরম ভক্তির ব্যপার। কীভাবে করতে হয়, যা আমি জানি,। সেটাই কেবল করতে পারি। কবিতা লেখা এমনই একটি কাজ, আমি করতে জানি।
সাক্ষাৎকারী : আর একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন কি স্বপ্নদর্শী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কীভাবে একটি কবিতার জন্ম হয়ে ওঠে?
ফ্রাঞ্জ রাইট : এক্ষেত্রে অবশ্যই ভালোবাসার বিহ্বলকারী অনুভূতি, অথবা এমনই কোনো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে যেখানে কবিতা লেখা বা নথি হয়ে থাকে। এটা শুধু ওই প্রেমের কোনো বিষয় নয়। যদি কেবল তা-ই হয়, যদি শুধুই ভাষা সর্বস্ব হয়, তবে সেই কবিতা টিকবে না বেশি দিন। মহৎ কবিতা হচ্ছে সেই কবিতা যেটা মানুষের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা লব্ধ সুর থেকে উৎসারিত হয়। আপন সৌন্দর্যে মুগ্ধ নয় কেবল। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভাষাগত স্বভাবকে আমাদের আয়ত্তে নিয়ে এর চর্চা আর উন্মেষ ঘটানোর প্রতিভা থাকা প্রয়োজন। কবিতা বরং, প্রকৃত শিল্প সৌন্দর্যের সেই স্তর থেকেও অনেক উর্ধ্বের। নৈঃশব্দ্যের অনুভুতি আর পূর্ব অভিজ্ঞতার এক বাচনিক প্রকাশ যেন। যেমনটি আমি খুঁজছিলাম এদ্দিন: কবিতা, শব্দের ভেতর দিয়ে আমাদের নৈঃশব্দ্যের অনুভুতিকে উজ্জ্বল করে তোলে।
সাক্ষাৎকারী : আপনি কি নিজেকে খ্রীষ্টান কবি বলে মনে করেন?
ফ্রাঞ্জ রাইট : খুব সম্মানিত বোধ করতাম যদি খ্রীষ্টান কবি হতে পারতাম, আসলে এখনও ভালো একজন ধার্মিক হতে পারি নি আমি। আমার নিবিষ্ট চিত্ত খ্রীষ্টীয় অনুভবে আবিষ্ট হয়ে এর বাস্তবতায় উপলব্ধ রয়েছে। প্রচলিত প্রথা বিরোধী এক উপলব্ধি। বলতে গেলে এভাবে বলা যায় যেমন আমার কাছে খ্রীষ্ট বলতে এমন এক ভাবমূর্তিকে বুঝি যা আমাকে দারুণ এক চেতনায় উজ্জীবিত করে আর তা হচ্ছে পৃথিবীর সব প্রাণী আসলে ঈশ্বরের একেকটি রূপ। শুধু খ্রীষ্টের ভেতরই নয়, প্রতিটি মানুষের শারীরিক অস্তিত্বের ভেতর ঈশ্বরের একটি করে অংশ স্থাপন করা আছে। যীশু হচ্ছেন একটি সূর্য যিনি অন্য সবাইকে গ্রহণে গ্রাস করে ফেলেন, কিন্তু আমরাও আছি, অংশগ্রহণ করছি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। এই বিষয়ে সচেতন থাকাই আমাদের জন্য দারুণ একটি প্রচেষ্টা। কদাচিৎ-ই এমন বিষয়ে সচেতন হই আমরা। কাফকা যেমন বলেছিলেন, আমরা স্বপ্নচর।
যীশু কে আমি আর সংকেত হিসেবে দেখি না। অবতারত্ব সম্পূর্ণ ও আক্ষরিক অর্থেই মূর্ত ও বাস্তব। আমি জ্ঞানবাদী নই। তবে আমি মনে করি এই জ্ঞানবাদ যে বৈধর্মের অবতারণা করে তা ভালোর জন্যই। সবাই আমরা খ্রীষ্টের এমনটা মানি না আমি। এরকম বোঝাতেও চাচ্ছি না। আমি বলতে চাচ্ছি আমরা সবাই অবতারত্বের অংশ। আমরা এর একেকটি স্ফুলিঙ্গ। আমাদের সর্বোত্তম আর সর্বোচ্চ চৈতন্যে সেই রকম শক্তির অধিকারী আমরা, যা যীশু তাঁর বাণীতে বারবার বলে গেছেন। বৌদ্ধধর্মে আছে জেগে ওঠার সংকেত। আর খ্রীষ্টান ধর্মে আছে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া।
প্রকৃতপক্ষে আত্মজাগরণ আর এই স্বপ্নদর্শী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা মানিয়ে চলতে পারিনা বেশিক্ষণ। বারবার ফিরে আসে আমাদের বস্তুগত অবস্থা যা আমরা দেখতে পাই, ছুঁতে পারি। এজন্যই বোধহয় যীশুর ভাবমূর্তি এতোটা প্রভাবশালী। এমন নয় যে—শুধু আধ্যাত্মিকভাবে—তিনি একটি চেতনা। না, আসলে তিনিও আমাদের মতোই বাস্তব, রক্তমাংসের একজন মানুষ,—এইজন্য। আমার কাছে, সবচেয়ে আধুনিক ও গতিশীল উপলব্ধি হচ্ছে, মহাবিশ্বের এইসব স্বপ্নদর্শী বিকল্প বাস্তব, কেননা মানুষের রূপ নিয়ে ঈশ্বর দূঃখ কষ্টকে আপন কাঁধে তুলে নিয়েছেন এইটুকু জেনে তা বুঝতে পেরেছি। আসলে মানুষের জন্য রয়েছে তাঁর অসীম ক্ষমাশীলতা যেন তিনি নিজেই এর মধ্যে থেকে বুঝে নিতে চান সন্ত্রস্ত, পরাভূত ও বিচূর্ণ শারীরিক অস্তিত্বের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলতে কী বুঝায়। যীশুর এইরকম ভাবমূর্তিকে অনুধাবন করতে পারা বা এর সম্ভাবনা হচ্ছে মানব জাতির জন্য দারুণ এক অর্জন। মানুষের কোনো প্রচেষ্টা এই অর্জনের চেয়ে মহৎ নয় যেখানে আমরা দেখতে পাই আমাদের ভয়, কষ্ট আর পরাজয়ের মধ্যেও সেই অসীম অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে।
সাক্ষাৎকারী : আপনি বলেছিলেন যদিও খ্রীষ্টান ধর্মই আপনার পথ, কিন্তু সব ধর্ম একই অভিজ্ঞতার প্রকাশ। তবে, এখন পর্যন্ত যীশু সম্পর্কে আর ইনকারনেশান বিষয়ে যা বললেন তাতে মনে হচ্ছে খ্রীষ্টান ধর্ম সম্পূর্ণ আলাদা কিছু। অন্য কোনো ধর্মে এমনটা নেই যে ঈশ্বর পৃথিবীতে নেমে আসেন মানুষ রূপে আর মানুষকে রক্ষা করতে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
ফ্রাঞ্জ রাইট : আমার বিশ্বাস পৃথিবীর সব মূখ্য ধর্ম একই অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ, আর আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে যীশুই হচ্ছেন এই সবের চূড়ান্ত পর্যায় যিনি সবাইকে প্রেরণা যোগান ও আলোকিত করেন। বৌদ্ধধর্মের বোধিসত্বের দিকে দেখুন। অন্য ধর্মেও এর কিছুটা পাবেন। কিন্তু পরিপূর্ণ ভাবে পাবেন না এই নগ্ন উদ্ঘাটন, এই মেনে নেয়ার অযোগ্য, এমনকি মৃত্যুর স্বাদ নিতে মনুষ্য শরীরে প্রবেশ করার ঈশ্বর সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদ্ভট এই ধারণা। এর চাইতে অদ্ভুত আর ভয়াবহ আর কিছুই হতে পারে না।
সাক্ষাৎকারী : এইরকম বিশ্বাস নিয়ে এই যে আপনি ইউনাইটেড স্টেটস এর একজন লেখক, যেখানে আপনার অধিকাংশ সহ-লেখকই সম্ভবত ভিন্নমত পোষণ করবেন, আপনি কি মনে করেন এ ব্যাপারে? কেমন অনুভব করেন আপনি?
ফ্রাঞ্জ রাইট : ঠিক আছে আমার জন্য। কিন্তু আমার মনে হয় উল্টোটাই আপত্তির। কিছু মানুষ আছে নিজেকে খ্রীষ্টান বলে দাবি করেন। ভেবে দেখেছি ওরা আসলে খ্রীষ্টান নন। এরাই আমাকে বেশি বিরক্ত করেন। খ্রীষ্টান এইসব মৌলবাদীরা মুসলিম মৌলবাদীদের মতোই অসহ্য, চরিত্রহীন ও ভন্ড। এরাই এখন এই দেশের নেতৃত্বে। দুরদর্শী বাস্তব আর ধর্মের এই দুই মৌলবাদী গোষ্ঠীর সংঘাত আজ খুবই ভয়ংকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলাম, অবশ্যই, খ্রীষ্টিয় ব্যবস্থার চেয়ে একধাপ এগুনো হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে যদিও, যীশু খ্রিস্টকে আরও বড়ো পবিত্র পরিমন্ডলে গন্য করে, যা আমরা হতে পারি। এক্ষেত্রে ইসলাম সত্যি আকর্ষণীয়। কিন্তু শেষ ধাপ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে না আমাদের। যীশু খ্রিস্টের ত্যাগ, নিজেকে উৎসর্গ ও তাঁর মৃত্যু কে মানে না তারা। এটা অর্থহীন। তবে, ইসলামে যীশু উপস্থিত আছেন আপন মহিমায়।
সাক্ষাৎকারী : সমসাময়িক সাহিত্যে 'বিদ্রুপ’এর প্রভাব নিয়ে কিছু বলুন।
ফ্রাঞ্জ রাইট : সবসময়ই এটা একটা সমস্যা। সবচেয়ে দুর্বল সমালোচনা হলো বিদ্রুপ। সবচেয়ে সহজ কাজ। যে কাউকে অপমান করা যায়। কোন ব্যাপারটা কঠিন—কোনটা সত্যি অসম্ভব—সেটা আলাদা বিষয়। হ্যাঁ, আমাদের সংস্কৃতি বিদ্রুপের হেঁয়ালিতে আচ্ছন্ন। অসুস্থ চর্চা। জঘন্য ব্যাধি। খুবই নাদান আর গোঁড়া। বিব্রতকরভাবে নাদান এবং অজাত। দূঃখজনক অর্থবোধ একেবারে নেই। অন্য সংস্কৃতিতে জীবনের দুঃখ দুর্দশাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে মানুষ। জীবন সেখানে ভোগান্তির ভেতর দিয়েই প্রস্ফুটিত। আমেরিকায় আমাদের আছে অদ্ভুত স্বাভাবিকতার পূরাণ, যেন সব কিছুই আনন্দের জন্য আর সাফল্যের, কিন্তু বাস্তবতা এরকম নয় মোটেও।
সাক্ষাৎকারী : আপনার সর্বশেষ বইটির নাম ‘গড'স সাইলেন্স’ কেন দিয়েছেন? ‘গড'স সাইলেন্স’ কথাটির অর্থ কি আপনার কাছে?
(চলবে..)
ছবি : ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:০৭