পনেরো টি কবিতার বইয়ের লেখক ফ্রাঞ্জ রাইট। জন্ম ১৯৫৩র মার্চে। আমেরিকার কবি তিনি। ইংরেজী কবিতায় ফ্রাঞ্জ রাইট এবং তাঁর বাবা জেমস রাইট এক অভূতপূর্ব উদাহরণ হয়ে আছেন। কারণ, বাবা আর ছেলে দু'জনই একই ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী হয়েছিলেন। কিশোর বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করেন ফ্রাঞ্জ। তখন তার বাবা আলাদা থাকতেন। তার প্রথম কবিতা পড়ে প্রতিউত্তরে বাবা চিঠিতে লেখেন, “তুমিও কবি হয়ে জন্মেছো। এসো, এই নরকে তোমাকে স্বাগতম।”
ভিয়েনায় জন্মেছিলেন এই কবি। বেড়ে ওঠেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। এমারসন কলেজ ও আরকানস বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। মেসাচুসেটস্ এ মানসিক স্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করেছেন সেন্টার ফর গ্রিভিং চিল্ড্রেন এ।
১৬ বছর বয়সে তার প্রথম ডিপ্রেশন দেখা দেয়। পরবর্তীতে মানসিক বিষণ্নতা প্রকট আকার ধারণ করে। বহু বছর এই সমস্যায় ভোগেন। নিজের ড্রাগ আশক্তি আর মদ্যপান এর বিরুদ্ধে বহুকাল লড়ে গেছেন তিনি।
২০১৫ সালের ১৪ই মে এই কবির মৃত্যু হয়।
তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে—
I11 Lit: New and Selected Poems (1998),
The Beforelife (2001),
Walking to Martha's Vineyard (2003),
God's Silence (2006)
এছাড়া অনুবাদ করেছেন René Char, Erica Pedretti আর Rainer Maria Rilke.২০০৪ সালে Walking to Martha's Vineyard কাব্য গ্রন্থের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পান।
কবিকে জানতে, আসুন আজ আমরা এই কবির একটি সাক্ষাৎকার পড়ি।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন যৌথভাবে আইলিয়া কামিনস্কি এবং ক্যাথরিন তাওলার।
বাংলা ভাষান্তর : ঋতো আহমেদ।
কবি ফ্রাঞ্জ রাইট-এর একটি সাক্ষাৎকার (১ম পর্ব)
কবি ফ্রাঞ্জ রাইট-এর একটি সাক্ষাৎকার (২য় পর্ব) #
সাক্ষাৎকারী : সাত বছর আগে আপনি ক্যাথলিক হয়েছেন। আমরা জানতে চাইছি কীসের প্রেরণায় খ্রীস্টান ধর্মে দীক্ষিত হলেন আপনি?
ফ্রাঞ্জ রাইট : খ্রিস্টান ধর্ম সমসময় আমার ভালো লাগতো—এর সুন্দর সুন্দর কথা, আচার অনুষ্ঠান, ইতিহাস এবং যীশুর প্রথম শিষ্যদের সেই মহত্ত্ব গাঁথা এইসব। বাস্তবতার মুখোমুখি তাদের সেই বিশ্বাস সংক্রান্ত অভাবনীয় ও দুঃসাহসিক ঘটনাগুলোকে সর্বদা প্রশংসা করেছি। তখনকার রোমান সাম্রাজ্যে বাস করা তো ছিল দারুণ ভয়াবহ। এখন এই বিংশ বা একবিংশ শতাব্দীর চেয়ে খারাপ অবস্থায়ও ওঁরা ছিলেন অসাধারণ। বাস্তবে অসম্ভব কোনো কিছুর উপর সেইসব মানুষের দারুণ, দৈব বিশ্বাস আমাকে —আমার বুদ্ধিমত্তায় ঈর্ষান্বিত করে। কলেজে পড়ার সময় এর উপর পড়াশোনা করেছি। তখন আগ্রহ জন্মায়। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর জার্মান প্রোটেস্ট্যান্টদের ওই ধর্মতত্ত্ব। যেখানে তারা নিউ টেস্টামেন্ট অধ্যয়ন করার অভিনব উপায় বের করেছিলেন। যীশুর বাণীর নির্দিষ্ট কোনো একটি বিষয়কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এর নির্যাস নির্ণয় করাই ছিল সেই অধ্যয়ন পদ্ধতি। তখনকার খ্রীষ্টিয় সম্প্রদায়ের প্রতি গভীর আগ্রহ বোধ করেছিলাম। যেখানেই বছর খানেক থেকেছি সেখানেই নিজেকে ক্যাথলিক চার্চের কাছে নিয়ে গেছি বারবার। আমার মা ছিলেন গ্রীক। আমাকে গ্রীক অর্থোডক্স সার্ভিসে নিয়ে যেতেন ছোট বেলায়। কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে, চলে যেতাম ক্যাথলিক চার্চে। ভীরের মধ্যে পেছনে বসে থেকে সেখান ওদের মাঝে গভীর আনন্দ পেতাম। ক্যাথলিক হওয়ার পর দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলাম। প্রায় আড়াই বছর। মনে হয়েছিল আমার সেই মনটা হারিয়ে গেছে এবং আমি আর লিখতে পারবো না। আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম।
এরপর কিছু একটা হলো আমার মধ্যে। পরিচয় হলো এক তরুণীর সাথে যাকে আমি বিয়ে করবো পরে। মদ খাওয়া ছেড়ে দিলাম। সুস্থ হতে থাকলাম আস্তে আস্তে। ওয়াল্থামে চলে এলাম যেখানে আমরা এখন বসবাস করছি। একদিন, যেমনটি সবসময় করি, একটা ক্যাথলিক চার্চ পেয়ে প্রার্থনায় বসে গেলাম। সেই সকালে, এটা হঠাৎই মনে এলো আমার। ভাবলাম, “যাদের এতো ভালো লাগে, কেন আমি তাদেরই একজন হয়ে যাচ্ছি না?” যদি কেউ বিশ্বাস করে এটা সম্ভব, কে-ই-বা সেটা অস্বীকার করবে। খ্রীষ্টান ধর্ম আমার ঐতিহ্য। বিভিন্ন রকম ধর্ম আছে যেমন বৌদ্ধধর্ম, ইহুদী ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, অথবা হিন্দু ধর্ম—আমি মনে করি এগুলো সব একই অভিজ্ঞতার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ—আর এগুলোর মধ্যে ক্যাথলিক ঐতিহ্যই হচ্ছে আমার আশ্রয় আমার আনন্দ। এর মানে হচ্ছে সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে বিশ্বাসের এই জীবনে বেঁচে ওঠার সবগুলো চেষ্টার একটি আশ্চর্য সমন্বয় এই আনন্দ। তাই ওই প্রার্থনা শেষে যাজকের কাছে যাই, জানতে চাই, “কীভাবে আমি ক্যাথলিক হতে পারি?” আমাকে খুবই কিম্ভূত দেখাতো তখন, যেন কেউ পিটিয়েছে খুব। পড়নের পোশাক থাকতো নোংরা। দাঁত মাজা হোতো না। ওজন ছিল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় ৬০ পাউন্ড। এরকম নিদারুণ দুর্দশাগ্রস্ত ছিলাম। যদিও যাজক আমাকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন প্রথমে, পরে জানিয়েছিলেন এটা, তবু তিনি আমাকে তার প্রাথমিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। সেইসব সভায় প্রায় এক বছর নিয়মিত অংশ গ্রহণ করি আর তারপর দীক্ষিত হই। তখন আমার বয়স ৪৭। খুব আনন্দের সময় সেগুলো।
হ্যাঁ, দীক্ষিত হওয়ার পরপরই যৌন নির্যাতনের ওইসব কুৎসা রটে। যেসব বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসিতামাশা শুরু করেছিলো ওরা আস্তে আস্তে থেমে যায়। নারী কেলেঙ্কারি, যৌন কেলেঙ্কারি, গে সমস্যা, সমস্ত রাজনৈতিক সমস্যা, অলৌকিক, প্রাচীন, চার্চের বাইজেন্টাইন রাজনীতি, পোপ, পোপের ধনদৌলত, মুকুট, কোনো কোনো যাজকের পৈশাচিকতা—কোনোকিছুই আর আমাকে স্পর্শ করছিল না। যদি জিজ্ঞেস করি, “কেন এই চার্চ, কী মনে হয় তোমার?” আসলে চার্চ মহাপুরুষদের জন্য নয়। চার্চ হচ্ছে অবিকল সেইসব মানুষের জন্য যারা শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং সচেতন থাকে। শয়তানের বাস্তবতায় সবাই দারুণ ভাবে সজাগ থাকে। দস্তয়ভস্কি যেমন লক্ষ্য করে দেখেছেন, অশুভের প্রতি আমাদের অবিশ্বাসের জন্যই সমানুপাতিক হারে শয়তানের শক্তির বৃদ্ধি হয়। এই বিশ্বাসের অর্থ হলো যখন আমরা এর বিষয়ে সচেতন হবো, এর ভেতর দিয়েই এর থেকে পরিত্রাণের কোনো না কোনো উপায় খুঁজে নিবো। মানুষ না বুঝেই শয়তানকে অস্বীকার করে আর এভাবেই ওর কাছে নতিস্বীকারের ভয়াবহ বিপদে পর্যুদস্ত হয়। চার্চ তাদের জন্য যারা স্পষ্টভাবেই নিজের ভেতরের শয়তান আর নিজস্ব অপারগতা সম্পর্কে সচেতন, যারা শয়তান হতে চান না, তবু বারবার নিজেকে সেরকমই দেখতে পেয়ে আতঙ্কিত হন। এজন্যই প্রার্থনা প্রয়োজন প্রতিদিন। এজন্যই প্রতিদিন তোমাকে ক্ষমা পেতে হবে, কেননা ওখান থেকে বেরুবার দু’ঘন্টা পরই আবারও শয়তান ভর করবে তোমার মধ্যে। ঐকান্তিকভাবে ক্ষমা পাওয়ার প্রয়োজন তোমারই। চার্চের ভেতরের রাজনীতি আমার বিষয় নয়। আমার মনে হয় মহিলারাও একসময় যাজক নিযুক্ত হবেন, এমনকি আমাদের জীবদ্দশায়ও হতে পারে এটা। আমি বিশ্বাস করি সবকিছু আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হবে। হয়তোবা, যৌন নির্যাতনের কেলেঙ্কারীজনক ঘটনা সমূহ একে তরান্বিত করবে।
চার্চে নিয়মিত অংশগ্রহনের মাধ্যমে ঔৎফুল্ল, গর্ব আর কৃতজ্ঞতা অনুভব করি আমি। আমার কাছে চার্চ মানেই হচ্ছে সাপ্তাহিক প্রার্থনায় নিয়োজিত একদল মানুষ, চার্চ মানেই হচ্ছে সেইসব কর্মময় মানুষের ছোট্ট পবিত্র স্থান। চার্চ মানে ভ্যাটিকান বা পোপ নন শুধু। সাইমন ওয়ায়েল এর মতে একটি শিক্ষনীয় বিষয় হলো, অন্যদের যেমন দেখায় অথবা তাদের সম্পর্কে আমাদের যা ধারণা তারা আসলে সেরকম নন। আমি নিজেকে যা ভাবি অথবা যা হতে চাই, সেরকম আমি নই। এই উপলব্ধিতে পৌঁছুতে আপনাকে প্রকৃত ক্ষমাশীল হতে হবে। আর ক্ষমাশীলতা ছাড়া, সবকিছুই অসাড়। ক্ষমাশীলতার ক্ষমতা না থাকলে, আপনি আসলে মৃত। তখন আপনি নিজেই ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য। এইটুকু বুঝতে পারার সাথে সম্পর্কিত আছে, নিজেকে ছাপিয়ে উঠতে চাওয়া মানুষের সেই সংগ্রাম। আমি মনে করি, মানুষের ভেতর ক্ষমাশীলতাকে দেখতে, এর মাধ্যমে মানুষকে অথবা নিজেকে জানতে চাওয়ার মধ্যেই রয়েছে জীবনের সামগ্রিক চাবিকাঠি।
সাক্ষাৎকারী : প্রার্থনায় আসা মানুষ আপনার কী কাজে আসে? কী করে আপনার জন্য তারা?
ফ্রাঞ্জ রাইট : প্রার্থনার ভিড় আমাকে আনন্দিত করে। যে দিন না যাই তার চেয়ে যে দিন যাই সেই দিনটি অন্যরকম হয়ে ওঠে যদি সকালে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে আসি। মনে হয় যেন জেগে আছি, বেঁচে আছি, বাড়িতেই আছি একরকম। যখন আমি এর জন্য প্রস্তুত হই সেই সময়, যখন প্রার্থনায় যাই, কালবিলম্ব না করে বসে পড়ি, তারপর সম্পূর্ণ কবিতাটি প্রস্ফুটিত হয়। ঠিক আমার সামনেই ওদেরকে দেখতে পাই, যেন লিখে ফেলা হয়েছে এইমাত্র। এরপর আমি যা করতে পারি তা হচ্ছে, চার্চ থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে লিখে ফেলি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি যদি শান্ত থাকি তবে, যতটা প্রয়োজন, সমস্তটাই স্মরণ করতে পারবো পরে। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয়। এর পূর্বে প্রায় তিন বছর কিছুই লিখতে পারি নি। একসময় এক বছর সময় ধরে যা কিছু লিখেছি, তার সবকিছু নিয়ে পরে একটি বই ‘দ্য বিফোর লাইফ’ হয়ে উঠেছে। বইটিতে যতগুলো কবিতা আছে তার তিন গুণ বেশি লিখেছিলাম। কিন্তু পরে বেছে বেছে পঞ্চাশটি কবিতা নিয়েছি। তারপর আমার পরবর্তী বই লিখতে শুরু করি, ‘ওয়াকিং টু মার্থাস ভিনিয়ার্ড’। এই বইয়ের অনেক কবিতাই আমি প্রার্থনায় যেতে যেতে, প্রার্থনায় রত অবস্থায়, অথবা ফিরে আসার সময় লিখেছি। বাসায় এসে কেবল টাইপ করেছি। এবং প্রায়শঃই, কোনো পরিবর্তন করিনি ওগুলোর।
সাক্ষাৎকারী : সত্যি আগ্রহ উদ্দীপক ব্যাপার, প্রার্থনা আপনাকে কবিতায় ফিরিয়ে এনেছে। আর একটু বিস্তারিত বলবেন কি, কীভাবে প্রার্থনায় যাওয়ার ওই বাস্তব অভিজ্ঞতা আপনাকে কবিতায় ফিরে আসতে সাহায্য করেছিল?
ফ্রাঞ্জ রাইট : আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি যা অন্যদের হয়ে থাকতে পারে বিশেষ করে যখন আমরা পরিবার পরিজন দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকি। মনে হয় যেন আমরা পরিপূর্ণ এবং অকুণ্ঠ ভালোবাসার মধ্যে আছি, মনে হয় নিরাপদ আছি, আছি আমাদের আপনার ঘরে। অন্য কোথাও এমনটা অনুভূত হয় নি কখনো। সমাবেশের এই আনুষ্ঠানিক আয়োজনকে আক্ষরিক অর্থে সামান্য মনে হলেও এটা কিন্তু মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তির এইখানে এসে কেন্দ্রীভূত হওয়াও হয়। মনুষ্য সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজেকে অনুভব করেছি আমি। যেন তোমাদের ভোজসভারই একজন আমি। পরিপার্শের সম্পূর্ণ অপরিচিত সবার জন্য ভালোবাসা অনুভব করেছি। আমি এই অনুভব নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে গেছি পৃথিবীর দিকে। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম বিগত জীবনে আমি সমাজ সংসার নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত ছিলাম। নিজেকে সবসময় আলাদা করে রাখতাম। কারো সাথে মিশতাম না তেমন। কোনো কাজ করতাম না। কিছু শিখতাম না, কেবল দু'একটা ছাড়া। অনেক নোংরা জায়গায়, বাজে পরিবেশে থেকেছি। কখনো কখনো বেঁচে থাকার জন্য বেআইনি কাজও করেছি আমি। কখনোবা ছিলাম আশ্রয়হীন। মানুষ এবং মানুষের পৃথিবীকে নিয়ে ভয় আর আতঙ্কে কেটেছে আমার দিনকাল। তারপর এই অনুভব, এই অকুণ্ঠ গ্রহন ও ভালোবাসা আমার জীবনের চলার সবচেয়ে গতিময় অভিজ্ঞতা বলবো এ-কে। এটাই আবার আমাকে লিখতে উৎসাহিত করেছে।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে বলতে চাই আমি, সে হচ্ছে আমার স্ত্রী, বেথ। আমার কাছে সে-ই হচ্ছে এই সমস্ত কিছুর সত্যিকার দুয়ার। বেথ আমার ছাত্রী ছিল কিছু বছর আগে। তারপর প্রায় সাত বছর যোগাযোগ ছিল না। গ্রাজুয়েশন শেষ করে সে কিছু দিন বার্লিন ছিল। শেষদিকে যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি তখন হঠাৎ তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। এক রাতে বেথ-কে চিঠি লিখি। প্রায় এক বছর পর সেদিন টাইপ রাইটার হাতে নিই। মাত্র দুই প্যারা চিঠি লিখতে সারা রাত লেগে যায় আমার। তার বাড়ির ঠিকানায় চিঠিটা পাঠিয়ে দিই। চিঠি পায় সে। এর দু'সপ্তাহ পর আমি উত্তর পাই। শহরে গিয়ে দেখা করতে শুরু করি আমরা। যে আমি এক বছর ধরে ঘর থেকে বের হই না, সেই আমাকে বাসে চেপে আর ট্রেনে চড়ে বোস্টন যেতে হয়। সে এক ভীতিকর অবস্থা ছিল আমার জন্য। এ নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম, নাম ছিল “থ্যাংকস প্রেয়ার অ্যাট দা কোভ”। ট্রেনে যেতে গিয়ে আমার দৃষ্টি আর মনস্তাত্ত্বিক হ্যালুসিনেশন নিয়ে লেখা। খুব দ্রুতই বেথ জানিয়ে দিয়েছিল সে আমার সাথে থাকতে চায় আর যদি আমার দেখাশোনা করতে হয়—অসমর্থ আমাকে 'টেক কেয়ার’ করতে হয় সেটাও করতে চায় সে। আমরা আসলে দীর্ঘদিন একে অপরকে ভালোবেসে যাচ্ছিলাম নিজেদের অজান্তেই। অপ্রকাশিত। তিরিশের গোড়ায় ও এক সুন্দরী, বিদূষী তরুণী আর আমি এই বয়স্ক, কুৎসিত, ঘেঁটো, নেশাগ্রস্ত পরাজিত এক মানুষ। পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিল সে আমার অবশিষ্ট জীবনের সঙ্গী হতে চায়, আমার দায়িত্ব নিতে চায়। এটাই আমাকে উজ্জীবিত করেছে। সুস্থ হয়ে উঠার আমার ইচ্ছেকে জাগিয়ে তুলেছে। আমাকে নতুন ভাবে প্রাণীত করেছে।
আমি বিশ্বাস করি, পরিপার্শের মানুষদের মাধ্যমেই ঈশ্বর তার কাজ করে থাকেন। মদ্যপান আর নেশাগ্রস্ততার থেকে নিরাময় পেতে পেতে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম আমি। আমরা সবাই উদ্যম আর ভালোবাসার উৎস—যা একে অপরের মাধ্যমে উৎসারিত হয়। মাঝেমধ্যে এর আকস্মিকতায়, বিষ্ময়কর আগমনে আমরা স্তম্ভিত হই, আর হঠাৎ-ই শুরু হয় আমাদের আমূল পরিবর্তন। আমার কাছে বেথ-এর সাথে থাকা মানে হচ্ছে এইরকম একটা জাগরণ, আমূল পরিবর্তন। ওর মধ্যে এমন কিছু একটা আছে, যাকে বলা যায় সত্যিকার পবিত্রতা। যখন আমরা প্রথম দেখা করি, ওকে দেখেই মনে হয়েছিল সে সত্যিই মানুষিকভাবে অসমর্থ কাউকে 'টেক কেয়ার’ করতে যাচ্ছে। বেশ কয়েক মাস ধরে গোসল করি নি, কাপড় বদলাইনি তখন। দিনের আঠারো ঘন্টাই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি। অসম্ভব নোংরা ছিলাম। এরপর বেথ যা করলো তা আমার জন্য ছিল সত্যি অপ্রত্যাশিত।
সাক্ষাৎকারী : এই পরিবর্তন আপনার লিখায় কেমন প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে আপনার স্বর ও ভঙ্গিতে?
(চলবে..)
ছবি : ইন্টারনেট।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:১৯