দোয়েল চত্বর হতে বাংলা একাডেমী যাওয়ার ফুটপাত ধরে একাকি হাঁটছিল নায়না। সকাল থেকে খুব অস্থির লাগছিলো। কিছুতেই মন বসছিল না বাসায়। কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আজ কদিন ধরেই এই রকম অস্বস্থিকর অবস্থায় সময় কাটছে তার। বিকেল হতেই বাসা থেকে বের হয়ে গেল উদ্দেশ্য, বই মেলায় যাওয়া। শিশু একাডেমীর গেটের কাছে নার্সারিতে নানা রকম গাছ গুলো দেখতে খুব ভালো লাগে নায়নার। যখনই এদিকে আসে তখন অনেকটা সময় এখানে থাকে সে। গাছগুলোর সাথে হরেক রকমের নক্সা করা মাটির তৈরি জিনিস পত্র গুলো দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেল আজ। বই মেলায় ঢুকার লাইন অনেক বড়। প্রায় দোয়েল চত্বর পর্যন্ত চলে এসেছে । এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছা করলো না তার। দাঁড়াতে গিয়েও আবার ফিরে এসেছে। তাই ফুট পথ ধরে হাঁটছে। অনেকটা আনমনা। শিহাবের কথা খুব মনে পড়ছে তার। ওর সাথে সম্পর্কটা ব্রেকআপ হয়েছে মাস ছয়েক হল। এর মাঝে একদিনও শিহাব খোঁজ করেনি নায়নার। শুধু মাত্র ভুল বোঝাবোঝির কারনে এতটা দুরত্ব। নায়নার মামাতো ভাই মারুফ কে নিয়েই শিহাবের যত ভুল বোঝাবোঝি । মারুফের সাথে তার বন্ধুত্বটাকে শিহাব অন্য দিকে টেনে নিয়েছে। ওর ধারনা মারুফের সাথে নায়নার ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও নায়না তাকে বোঝাতে পারেনি যে মারুফ শুধুই তার ভাই এবং একজন ভাল বন্ধু। কিন্তু শিহাব কিছুতেই এটা মানতে নারাজ। অথচ মারুফ খুব ভাল ছেলে। ও নায়না কে সবসময় বলে-
-নায়না আমার জীবনে সবচাইতে বড় প্রাপ্তি তুমি। তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু। আমি আমার সব দুঃখ কষ্ট গুলো তোমার সাথে শেয়ার করতে পারি। তোমার পরামর্শ নিতে আমার খুব ভালো লাগে। আমি তোমাকে কখনো হারাতে চাই না। আর শিহাব সত্যি অনেক ভালো ছেলে। ও তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি তাকে কখনও কষ্ট দিওনা।
কিন্তু এখন শিহাব শুধু মারুফের জন্যই তাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। মারুফ অনেক দিন জানতে চেয়েছে ওদের ব্রেকআপ হওয়ার কারন টা কি? নায়না কেমন করে মারুফ কে বলবে যে শুধু তার জন্যই আজ ওদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেছে। নায়না কখনোই মারুফের কাছে শিহাব কে এতটা ছোট করতে পারবে না। নায়না হাঁটছে আর এসব কথাগুলোই ভাবছে। হটাৎ অনেক পরিচিত, চিরচেনা একটা কণ্ঠ স্বরে চমকে উঠে সে। শিহাব তাকে তার নাম ধরে ডাকছে।
-আমি এতক্ষন ধরে তোমায় ডাকছি। তুমি শুনতে পাও না?
-না একধমই শুনতে পাই নি।
-কেমন আছ তুমি? এত আনমনা কেন বল তো?
-কই নাতো। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? তোমার রাগ পড়েছে তাহলে।
-কে বলল আমি তোমার সাথে রাগ করেছি?
-না হলে এত দিন আমার কোন খোঁজ নাও নি কেন? আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ভুলেই গেছ আর আমার সাথে যোগাযোগ রাখবেনা।
-না না সেরকম কিছু না। আসলে আমি হটাৎ করেই একটু বেশি ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি। অফিস এ প্রচুর কাজের চাপ যাচ্ছে। তাই হয়তো তোমার সাথে আগের মত যোগাযোগ রাখতে পারছি না।
কিন্তু তোমার কথা আমার সব সময় মনে হয় নায়না। তুমি জান না যে আমি তোমাকে কত টুকু ভালোবাসি। প্রতি মুহূর্ত তোমার কথা আমার মনে হয়।
-আমি সত্যি ভাবছিলাম তুমি আমাকে ভুলে গেছ। কত রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়েছি শুধু তোমায় ভেবে। কত দিন আমি একাকি কেঁদে বুক ভাসিয়েছি তা কেও জানেনা। আমি সত্যি বলছি শিহাব মারুফ কেবলি আমার বন্ধু। আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
-থাক এসব কথা। আমি এসে গেছি আর আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে। আমি মারুফকে নিয়ে তোমাকে আর কখনো কিছু বলবো না। আমি বুঝতে পেড়েছি সবই আমার ভুল ধারনা। মারুফ খুব ভালো ছেলে। আমি তোমাকে আর কখনো কষ্ট পেতে দেব না। এখন থেকে আমি সবসময় তোমার পাশেই থাকব। বলেই নায়নার একটা হাত ধরল শিহাব।
-আচ্ছা আমি যে এখানে এসেছি তুমি জান কিভাবে?
-আমি তোমার মোবাইলে কল করেছিলাম। তোমার মোবাইল বন্ধ। তারপর বাসায় ফোন দিলাম আনটি বলল তুমি এখানে এসেছ। ভাবলাম দেখি খুজে পাই কিনা। কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ কেন?
-না এমনি। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছিলো না তাই।
-মেলায় যাবে নাকি অন্য কোথাও গিয়ে বসবে?
-না এখন আর মেলায় ঢুকবো না। কতদিন পর তোমাকে পেলাম। তোমাকে একটুও কাছ ছাড়া করতে মন চাইছে না।
বই মেলায় না গিয়ে তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভীতর ঢুকল। শিখা চিরন্তনের পাশ দিয়ে হাঁটছে ওরা। বিকেলের হিমেল হাওয়ায় নায়নার চূলগুলো উড়ছে। শিহাব তাকিয়ে আছে নায়নার দিকে।
এলোমেলো চূলগুলো তার পুরো কপাল টা ঢেকে দিয়েছে। শিহাব আলতো করে নায়নার কপাল থেকে চূলগুলো সরিয়ে দিল। নায়না শক্ত করে শিহাবের হাত টা জড়িয়ে ধরে বলল-
-থাক আর সোহাগ করতে হবে না।
সামনেই একটা ছোট্ট খাওয়ার স্টল সেখানে এসে বসলো তারা। ফুচকা আর কফি খেলো। দুজন সামনা সামনি না বসে পাশা পাশি বসলো। যতক্ষন তারা সেখানে ছিল ততক্ষন শিহাব একবারের জন্য ও নায়নার হাতটা ছাড়েনি।
-ছাড় না হাত টা। মানুষ দেখছে। কি ভাবছে বল তো?
-না আমি ছাড়বো না। যার যা খুশী ভাবুক আমার তাতে কিছু যায় আসে না।
-আমি খেতে পাড়ছিনা। হাত টা ছাড় প্লিজ।
-কত দিন পর তোমাকে পেলাম। আমার এক মুহূর্তের জন্য ও তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না।
অনেক্ষন তারা এভাবেই ছিল। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। লোকজনের ভীর অনেকটাই কমে গেছে। তবু নায়না আর শিহাবের মত অনেকেই আছে যারা তাদের ভালোবাসার প্রাপ্যতা বুঝে নিতে ব্যাস্ত। ওরা হাঁটতে হাঁটতে কালি মন্দির টার পাশে চলে এল। এদিকটা অনেকটাই ফাঁকা। একটু এগিয়ে গিয়ে রেলিং টার পাশে বসলো ওরা। একটা ছোট্ট মেয়ের কাছ থেকে অনেক গুলো তাজা লাল গোলাপ কিনে নিলো শিহাব। ফুলগুলো নায়নার হাতে দিল। একটা ফুল পড়িয়ে দিল নায়নার চুলের গোছায়। শিহাব আরও কাছে টেনে নিল নায়নাকে। দুহাতে জড়িয়ে ধরল বুকের মাঝে। নায়ানা কিছুই বললো না।
-আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি নায়না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। আমার প্রতিটা মুহূর্ত কাটে কেবল তোমারই ভাবনায়। তুমি শুধু আমার। শিহাব আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল নায়নাকে। চুমু খেল নায়নার কপালে, গালে। কেঁপে উঠলো নায়নার ঠোঁট জোড়া।
-নায়না আরও কাছে চলে এল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শিহাব কে। শিহাবের বুকের মধ্যে চুমু খেল। শিহাবের ঘন তপ্ত নিঃশ্বাস ছুঁয়ে গেল নায়নার কপাল সহ সমস্ত শরীর। চারিদিকে মানুষ জনের চলাফেরা, ফেরিওয়ালাদের ডাক কিছুই কানে গেল না তাদের। গভীর আলিঙ্গনের ভেলায় চড়ে তারা যখন স্বর্গ সুখে বিভোর তখনই মায়ের ডাক। এক ঝলকে স্বর্গ রাজ্য থেকে ছিটকে পরে এই মাটির ধরায়।
-নায়না... নায়না... বলে ডাকতে ডাকতে মা এসে রুমে ঢুকলো।
-কিরে মা!! এত বেলা হল এখনো ঘুমাচ্ছিস যে? শরীর খারাপ করেনি তো? বলতে বলতে মা নায়নার কপালে হাত দিয়ে দেখল তার জ্বর টর আসলো কিনা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল “এতক্ষন ধরে ডাকছি শুনতেই পাচ্ছ না। কি ব্যাপার বলতো? উঠে পর অনেক বেলা হয়েছে। কলেজে যেতে হবে না”?
মায়ের হাতের স্পর্শে হটাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠলো নায়না। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিল না। চারিদিকে তাকাচ্ছে। শিহাবকে খুঁজছে নায়না। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। শুধু মা আর নায়না। জড়তা কাটতে অনেকটা সময় লাগলো তার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাত টা বাজে। আস্তে আস্তে নায়না বুঝতে পারলো এতক্ষন যা দেখছিল, যা ঘটছিলো তা বাস্তব নয় পুরোটাই একটা স্বপ্ন। নায়না ভাবতেই পারছে না স্বপ্ন এত জীবন্ত হয় কি করে? হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটা, একসাথে খাওয়া, চুলে ফুল গুজে দেয়া এই সবই ছিল একটা স্বপ্ন? শিহাবের সেই স্পর্শ, সেই আদর, সেই গায়ের গন্ধ, সবকিছু যেন এখনো গায়ে লেগে আছে। ভাবতেই কষ্ট লাগছে শিহাব তার উপর অভিমান করে ভুল বুঝে তার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। সে কি আর কোনদিন তার জীবনে ফিরে আসবে না? তাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা ভাবতেই পারছেনা নায়না। যে করেই হোক তার ভুল ভাঙ্গাতেই হবে। সব অভিমান ভুলে গিয়ে শিহাবের সাথে দেখা করে ওর ভুল ভাঙ্গানোর সিদ্ধান্ত নেয় নায়না। সেদিন আর কলেজে যাওয়া হোল না তার। স্বপ্নে পাওয়া শিহাবের ভালোবাসা টুকু গায়ে জড়িয়ে আবার শুয়ে পড়লো নায়না। শিহাবকে নিয়ে শেষ রাতের স্বপ্নের আবেশ টুকু তাকে ঘিরে রেখেছিলো সারা দিন.........।