(ক্রিকেট যখন থেকেই বুঝতে শুরু করেছি তখন থেকেই উপভোগ করেছি।প্রথম থেকেই নিজ দলের সমর্থনে ছিলাম।বাংলাদেশে ক্রিকেটের অভ্যুথ্থানের সময়টাতে সমর্থক হয়েছি বিধায় অনেক অনেক ভালো ম্যাচ দেখেছি।এর মাঝে কিছু ভালো,কিছু আরো ভালো আর কিছু একটু বেশিই ভালো।এতো শত ম্যাচের মধ্য থেকে আমার চোখে সর্বশ্রেস্ঠ কয়েকটি ম্যাচ, যেগুলোর কারণে শত হারের পরেও বাংলাদেশ দলের পাশে থাকার প্রেরণা পাই,সেইসব ম্যাচ নিয়ে আমার ধারাবাহিক লেখার প্রথম পর্ব আজ।)
সিরিজটি শুরু হয়েছিল কিছুটা চাপের মাঝে।কিছুদিন আগেই টাইগাররা টি২০ বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকেই বাদ পরেছে আবার ওয়েস্ট-ইন্ডিজ হয়েছে ঐ টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন।তবু টেস্টের পারফরমেন্স কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছিল।খুলনার প্রথম ম্যাচ জয় দিয়েই শুরু করল টাইগাররা।২য় ম্যাচেও হেসেখেলেই হারিয়ে দিলো ওদের।এরপর হঠাৎ বাঁধা।৩য় ম্যাচে হার।সিরিজটা নিশ্চিত হলোনা।৪র্থ ম্যাচে আবারো পরাজয়।শেষ ম্যাচটিই হবে অঘোষিত ফাইনাল।তীব্র দুশ্চিন্তা,কিছুটা ভয়,অনেকখানি বিশ্বাস আর বুকভরা ভালবাসা নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম শেষ ম্যাচের।
দিবারাত্রির খেলাটি শুরু হলো দুপুরে।টস্টা আমরাই পেলাম।অধিনায়কের পছন্দ ফিল্ডিং।খুশিই হলাম।কারণ আমার কাছে বরাবরই মনে হয় যে রান তাড়া করাটা তুলনামুলকভাবে সহজ।শুরু হলো লড়াই।
নতুন বলের নায়ক মাশরাফি দলে নেই।আবারো ইনজুরি।সদ্য আবিষ্কৃত গাজীর স্পিন দিয়ে সূচনা হলো খেলার।মাত্র তিনটি রান গেইলদের ব্যাট থেকে।কিন্তু ২য় ওভারেই মাশরাফির বদলি শফিউলের ওভারে দুটি চারের মারে রান হলো ১০!আবারো গাজীর হাতে বল।নিরাশ করেননি তিনি। ৩য় বলেই পওয়েলকে ফাঁদে ফেললেন আর উইকেটের পিছনে অধিনায়কও কোনো ভুল করেননি।ফলাফল,১১রানেই স্ট্যাম্পড পওয়েল!
এরপর দুটি মেডেনের পর শফিউলের বলে যখন স্যামুয়েলস দৌড়াচ্ছিল তখন রিয়াদের ডিরেক্ট থ্রোতে স্ট্যাম্প উড়ে গেল।ইন্ডিজদের অবস্থা তখন শোচনীয়।কিন্তু ডেন্জ্ঞারম্যান গেইলের ভয় তখনো আছে।৭ম ওভারেই নাসিরের দুর্দান্ত ক্যাচে গেইলকে সাজঘরে ফিরিয়ে দিলেন শফিউল।১৯টি বল খরচ করে মাত্র ২রান করা গেইল ফিরে যাবার পর ম্যাচের চালকের আসনে টাইগাররা।কিন্তু তখনই ক্রিজের দুই ব্যাটসম্যান ব্র্যাভো আর পোলার্ড শক্ত হাতে ইন্ডিজ ইনিংসের হাল ধরল।ব্র্যাভো শুধু সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছিল আর পোলার্ড ছোটাচ্ছিল চার-ছক্কার ফুলঝুরি।৩০ওভার পর ইন্ডিজদের রান ৩উইকেটে ১৪৫!দুজন সেটেলড ব্যাটসম্যান ক্রিজে,আরো বিশটি ওভার বাকি,বুঝতে পারছিলাম যে রানের পাহাড়ের নিচে চাপা পড়তে যাচ্ছে টাইগাররা।তখন ওকেশনার বোলার কিছুদিন আগেই অভিষেক হওয়া মুমিনুল হক সৌরভের হাতে বল তুলে দিলেন অধিনায়ক।আশ্চর্যভাবে তখনই বহু আকাঙ্খিত ব্রেক থ্রু এলো।সৌরভের বলটি ঘূর্ণির মত গিয়ে লন্ডভন্ড করে দিল পোলার্ডের স্ট্যাম্প!তবুও হিসাব করে দেখলাম রানরেট যা আছে তাতে ২৮০,এমনকি ৩০০ হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়।তখনই মাগরিবের আযান শুনলাম।তাই উঠে পড়লাম।দোয়া করলাম যেন কাকতালীয় কিছু ঘটে,যেন ওয়েষ্ট ইন্ডিজ ২৫০ও করতে না পারে।নামায শেষে এসে দেখি ম্যাচের মোড় পুরোপুরি ঘুরে গেছে।সৌরভ স্যামিকেও ফিরিয়ে দিয়েছে আর বড় কথা হলো ওদের রানের স্রোতে বাঁধ দিতে পেরেছে টাইগাররা।তারপর যেন কল্পনার মতোই দুর্দান্ত বোলিং আর অসাধারণ ফিল্ডিংয়ে মাত্র ২১৭তে অল-আউট ওয়েষ্ট ইন্ডিজ।
এবার ওদের বেঁধে দেয়া রানের সীমানা পার হতে হবে।১ম ওভারের শেষ বলে চার মেরে তামিম ভাল একটি শুরুর ইঙ্গিত দিলেও ৩য় ওভারের মধ্যে তিনি এবং বিজয় সাজঘরে ফিরে গেলেন।দলের রান মাত্র ৯!জহুরুল আর মুশফিক ক্রিজে।কিছুদিন আগেও টাইগারদের ব্যাটিং-এর প্রাণ ছিল ওপেনিং জুটি।মিডল অর্ডার থেকে ৫০রানের বেশি আশা করাটাই যেন অন্যায় ছিল।কিন্তু সাকিব আসার পর থেকে এই চিত্র পরিবর্তন হচ্ছিল।সেই সাকিব আজ ইনজুরির কারণে হবু-সহধর্মীনিকে নিয়ে দর্শকের সারিতে বসে আছেন।তবে কি আজ বাঘের দলকে উদ্ধার করার কেউ নেই?কিন্তু দলের প্রয়োজনে যেকোন কারো জ্বলে ওঠার ইতিহাস তো আমরা ভুলিনি।তাই বিশ্বাস হারাইনি।দোয়া করছিলাম এই জুটি যেন অন্তত ১৫টি ওভার খেলে ৭৫/৮০ রান যোগ করে।কিন্তু জহুরুল ২১বলে মাত্র ১০রান করে যথন কিপারের হাতে ক্যাচ তুলে দিলেন তখন রানরেট তিনের ঘরে।এবার নামলেন রিয়াদ।তখন শুরু হলো অধিনায়ক ও সহঅধিনায়কের হাল টেনে ধরার এক অনবদ্য অভিযান।
প্রায় জয়ের বন্দরে যখন পৌঁছেই যাচ্ছি তখন কালবৈশাখীর মতো ৪০ এর ঘরে মুশফিক ও রিয়াদ,দুজনই আউট!এই ঝড় আমাদের ছোট্ট তরীকে আবারো বিস্তৃত সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিল।নাসির আর সৌরভ দুজন বেশ কিছুক্ষণ ধীর গতিতে খেললেন।এবার আকস্মিকভাবে সৌরভ আউট!দলের রান ১৮৬। ১৫ওভারে মাত্র ৩২টি রান তুলতে হবে।কিন্তু ক্রিকেট যে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা।শেষবলের আগে কিছুই বলা যায়না।নতুন ব্যাটসম্যান গাজী যিনি আসলে বোলার ভালোভাবে নাসিরকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন।প্রতিটা বলের সাথে সাথে কোটি কোটি বাংলাদেশির হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল।স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীও গম্ভীর হয়ে গিয়েছেন।শাসরুদ্ধকর ম্যাচটি যখন প্রায় জিতেই গিয়েছি তখন গাজী আউট!মাত্র ৪টি রান প্রয়োজন।রাজ্জাক এলেন।এ ওভারের শেষ দুটি বল যদি তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন তবে আর ভয় নেই।নাসির স্ট্রাইকে আসলেই হবে।তখন বোলার নো বল করলেন।হাজারো কন্ঠের আনন্দধ্বনি শোনা গেল।পরের বলে এলবিডব্লিউর আবেদন এবং আম্পায়ার বিতর্কিতভাবে আঙুল তুলে দিলেন।তিনটি রান বাকি।এলেন ইলিয়াস সানি।শাসরুদ্ধকর পরিস্হিতি।ওভারটি শেষ হলো।
বার্ষিক পরীক্ষায় প্রশ্ন পাওয়ার আগে যেমন অনুভূত হয় আমার তেমন হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল হার্ট-এটাক হয়ে যাবে।ওভারের প্রথম বলে একটি রান নিলেন নাসির।স্বস্তির চেয়ে দুশ্চিন্তাই বরং বেড়ে গেল।সানি কি পারবেন ৫টি বল দাঁড়িয়ে থাকতে?২বল পরেই তিনি একটি রান নিলেন।১,৪৭,৫৭০বর্গমাইল জুড়ে স্বস্তির বাতাস বয়ে গেল,স্কোর লেভেল্ড।জয়সূচক শেষ রানটির জন্য ব্যাট হাতে প্রস্তুত নাসির,প্রেসিডেন্ট বক্স থেকে প্রধানমন্ত্রী পতাকা হাতে তাকিয়ে,২৩০০০ দর্শক গ্যালারীতে অপেক্ষমাণ,বাংলাদেশ দলের অন্যান্য সবাই বাউন্ডারী লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে,ইতিহাস সৃষ্টির জন্য একটি রান প্রয়োজন।শট মারলেন নাসির এবং রান!প্রধানমন্ত্রী পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে পড়লেন,পুরো দল আনন্দে দৌড়ে মাঠে প্রবেশ করেছে,কিন্তু.....কিছু একটা সমস্যা মনে হলো।ইন্ডিজ টিম আম্পায়ারের সাথে কিছু নিয়ে আলোচনা করছে।কি?স্ক্রিনে রিপ্লে দেখানো হলো।নাসির রান সম্পূর্ণ করলেও অপরপ্রান্তে সানি হয়তো ভেবেছিলেন বলটি বাউন্ডারিতে পৌঁছেছে।তাই তিনি ঐপ্রান্তে ব্যাট স্পর্শ করে রান সম্পূর্ণ করেননি।তাই এ রানটি গ্রহণযোগ্য হবেনা।নাটকীয় পরিস্হিতি!আবারো সেই একরানের জন্য বল মোকাবেলা করবেন নাসির।এবার আর কোনো ভুল নেই।একদম চার।আবারো জয়ের আনন্দ।পৃথিবীর আর কোনো দল কি পারে তাদের সমর্থকদের একই ম্যাচে দুইবার জয়ের আনন্দ দিতে?
টাইগারদের উদযাপনটাও ছিল বৈচিত্র্যময়।তারা বহুল আলোচিত "গ্যাংনাম স্টাইল"এর নাচ নেচে জয় উদযাপন করেছিল।স্টেডিয়ামের সাউন্ড বক্স থেকে গানটি বাজানো হয়েছিল,রিয়াদের নেতৃত্বে সবাই নেচেছিল।আমার মনে হচ্ছিল এসবই বোধহয় স্বপ্ন থেকে তুলে নিয়ে আসা কোনো দৃশ্য।বাস্তব কি কথনো এতটা আনন্দময় হতে পারে?
পুরষ্কার বিতরণীতে সহ অধিনায়ক রিয়াদ ম্যান অব দ্য ম্যাচ আর অধিনায়ক মুশফিক ম্যান অব দ্য সিরিজ ঘোষিত হয়েছিলেন।মুশফিক বিজয় দিবসকে সামনে রেখে দৃপ্ত কন্ঠে এই সিরিজ-জয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন।আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ও ভাগ্যবতী আমি।অনেক আনন্দে কেন যে চোখ থেকে অশ্রু গড়ায়!ভেজা চোখেও সেদিন আমি হাসছিলাম পরিতৃপ্তির হাসি।প্রতিটা ম্যাচের মতো সেদিন-ও আবার নতুনভাবে উপলদ্ধি করেছিলাম,কতটা ভালবাসি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে....
(সমাপ্ত)