মুখের সামনে উড়তে থাকা ওড়নাটা বার বার সরে যাচ্ছিলো। বা’হাত বোরখার আড়াল থেকে বের করে মিতা চোখের নীচে টেনে নামিয়ে দিলো কাপড়টা ।ব্যাপারটা সামনে বসা ক্যামেরা ম্যানের নজর এড়ালো না, এরি মধ্যেই সে ক্লিক করে একটা ফটো নিয়ে নিলো। ঘর ভর্তি অনেক লোক,কিছুক্ষন পর পর এই লোকটা ক্যামেরা হাতে একবার বা’পাশ আবার ডান পাশ থেকে ঘুরে ঘুরে ছবি নিচ্ছে।মিতার স্পষ্ট মনে আছে-ঈদের দিন সালামীর টাকা তুলেই বান্ধবীদের নিয়ে চলে যেতো হাটে ,উদ্দেশ্য স্টুডিওতে সেজে গুজে ছবি তোলা।
এখন তো আর ব্যাপারটা তা না।তার মুখের প্রায় অর্ধেকের বেশীই পুড়ে গেছে।লিপ স্টিক দেবে বা কাজল এমন একটু জায়গাওতো খালি নেই।এই লো্কটা এতো আগ্রহ নিয়ে ছবি তোলে কেনো তাহলে?
হাসপাতালের বেডে কতো দিন সে শুয়ে ছিলো,তার সঠিক হিসেব তার কাছে নাই। খালি মনে আছে,একটা সুন্দর মতোন আপা বার বার তার রুমে আসতো। যদিও এক চোখে একেবারেই দেখা যায় না,অন্য চোখ খুলে সে অবাক বিস্বয়ে দেখতো-মায়াভরা দুটি চোখ কদাকার মুখটার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে।পরে জেনেছে-ইনি নীলা আপা।এই এন জি ওতে কাজ করেন।
চিকিতসা শেষ হবার পর আপা এখানে ওকে নিয়ে আসেন ।আপার মুখ থেকেই মিতা জেনেছে এটা একটি এন জি ও, অসহায় মেয়েদের এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়। সামনে বসা লোকটি হাতে কাগজ কলম নিয়ে বসে আছে। মিতাকে তার অনেক প্রশ্ন করা প্রয়োজন বোঝাই যাচ্ছে ।।কিন্তু নীলা আপা কিছুতেই দিচ্ছে না,বলছে-সব এসিড দগ্ধ মেয়েদের গল্পইতো এক।এতো প্রশ্ন করতে হবে না,যা মনে আসে লিখে দেন।
লোকটা কোন পত্রিকা থেকে এসেছে মনে হলো ।ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় মিতাদের স্কুলেও এমন অনেক সাংবাদিক এসেছিলো।তারা সরকারের খরচে ঠিক মতোন পড়া শোনা করছে কিনা তা খোঁজ নিতেই এসেছিলো। এই লোকটা তার খোঁজ নিচ্ছে ,নাকি এসিডে মুখ ঝলসে যাবাও টক মিষ্টি কোন গল্প খুঁজছে তা বোঝা মুশকিল।
-আপনি না করলেইতো আর হবে না,এই মেয়েটার নিউজ করা আমার ডিউটি।আমার কাজ আমাকে করতে দিন, আর ফটোগ্রাফারকে ছবি তুলতে দিন।
-এই ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে কি হবে শুনি, যে ওকে এমন দশা করলো তাকে ফাঁসীতে ঝোলাতে পারবেন,বলেন?
-দেখুন,আপনি খুব ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছেন। আমাদের কাজ কেবল নিউজ করা , আর কিছু না।
রাগে নীলা আপার চোখে মুখে পানি এসে গেলো, ডান হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে উনি বের হয়ে গেলেন।মিতার কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে বসলেন -তারপর,কোন পর্যন্ত পড়েছো যেন তুমি?
মিতা কিছুক্ষন মাথা নীচু করে বসে রইলো। তার চোখের সামনে দুলতে শুরু করলো- স্কুল,খেলার মাঠ,বাড়ীর পেছনের পেয়াড়া গাছ,সাদা কালো রঙের বাছুর।ইচ্ছে করলেই সে আর ছুটে যেতে পারবেনা প্রিয় সে গ্রামে।খুব নীচু স্বরে উত্তর করলো-আমি এবার এস এস সি দিসি ।
-ও তাহলেতো খুব ভাল,তুমিতো শিক্ষিত একটা মেয়ে।তাহলে কারা এমন করলো তুমিতো সবার নামো বলতে পারবে।ওরা কি তোমাকে আর কিছু করেছিলো?
এই আর কিছুর মানে মিতা বোঝে। ক্লাশ এইটে পড়ার সময় মা বিনা চিকিতসায় মারা যায়।প্রায় প্রতি রাতে বাবা ফিরতো মাতাল হয়ে,মায়ের জন্যে যে এক বোতল ঔষধ আনবে তা তার কোন দিনো মনে থাকতো না।
মা শুয়ে শুয়েই মৃদু স্বরে এলোমেলো কথা বলতো, জোরে কতাহ বলার সাহস সে পায়নি । মাতাল স্বামীর অকর্মের সমস্ত হিসেব তার কাছে আছে, কিন্তু সেটা উঁচু স্বরে বললেই পিঠের চামরা আর পিঠে থাকবেনা।
গাড়ী চালিয়ে বাবা যতোটুকু আয় করতো, তার বেশির ভাগি যেতো মদ খেতে। তারপর বাবার সাথে সম্পর্ক হয় বাজারেরি কোন এক মহিলার সাথে, সেই মহিলাই তাকে রাতে নিজের কাছে রেখে দিতো। মায়ের মুখে বহুবার শুনেছে বাপের রঙ্গ লীলার গল্প ,এটাকেই এই সাংবাদিক আর কিছু বলে বোঝানোর চেষ্টা করছে।এ বোঝা তার বোঝা হয়ে গেছে সেই কিশোরী বেলাতেই। মা দুম করে গেলো মরে,বাবা একদিন মধ্যরাতে সেই মহিলারে নিয়ে হাজির। মিতা আর ওর ছোট ভাই ঘুম থেকে চমকে উঠে চোখ কচলাতে থাকলো ।বাবা কাছে এসে মিতাকে বললো-তোর ভাইরে লইয়া একটু ওই মুরা যাইয়া শোগা। দেখোস না তোগ নতুন মা আনসি।
-কই শুমু আব্বা ?ঘরতো একটাই ।
-কেন?হাইশাল পার গিয়া শো।
-কি কউ,ভাদ্র মাস ।যদি বৃষ্টি আহে।ভিজা যামু গাতো।
বাপের শরীর তখন আদিমতার নেশায় মত্ত্ব।
-তরে যা কইসি তাই কর। খালি মুখে মুখে তক্ক।
ঘর থেকে বের হবার পর মিতার চোখ গিয়ে পড়লো ওই মহিলার শরীরে। ব্লাউজের সামনের গলাটা এতোটাই নামানো যে বুকের অনেক খানি জায়গা দিব্যি চেয়ে আছে। তার গলায় ঝুলছে মায়ের সেই হার যা বাবা চিকিতসার নাম করে মার কাছ থেকে এক রকম জবরদস্তি করেই নিয়ে গিয়েছিলো।
-কি ব্যাপার বললে না, ওরা তোমাকে কি করলো?
মিতার মনে মনে বেশ হাসিই পেলো-লোকটা ধরেই নিয়েছে যে কোন ছেলে তার শরীরে হাত দিয়েছে।এই গল্পটাকে কি ভাবে য়ার রসালো করা যায় তারি পায়তারা চলছে।গল্প যতো রসের –খবরের মজা ততো বেশী।
মিতার নীরবতা সাংবাদিক কে আরো অস্থির করে তোলে-বলোনা,কি ভাবে হলো তোমার এমন অবস্থা?ছেলেটার সাথে কি তোমার সম্পর্ক ছিলো?
মিতা একটু মাথা উঁচু করে-কারো সাথেই আমার কোন সম্পর্ক ছিলো না।আর আমাকে কে এসিড দিয়েছে তা শুনতেও আপনার ভালো লাগবে না।
-ব্যাপারটা ভালো লাগার না, আমাদেরকে সত্য ঘটনা লিখতে হবে।
মিতা পুনরায় চুপ করে থাকে।ওর ভাবনার আকাশে এখন অনেক রঙ খেলা করছে।মাতাল বাবার অসহনীয় আচরন,সত মায়ের অশ্লীল ভরা ভাষা সব কিছু চোখের সামনে কেমন ঢেউএর মতোন খেলা করছে ।ভাইটা কোন দিনো স্কুলে যাবার সময় খেতে পেতো না,খাবার চাইলেই ওই মহিলা বাশি ভাত দিতো সামনে ,না খেয়ে ছেলেটা বের হয়ে যেতো।পলিথিন মুড়িয়ে দুই ভাই বোন বৃষ্টির রাত কাটিয়েছে রান্না ঘরে।
এক বছর পার না হতেই মহিলার শরীরে যেনো একটু টান পড়লো –বাবা আবার শেষ রাতে ঘরে ফেরা শুরু করলো। তারপর শুরু হলো দুইজনে অকথ্য ভাষায় চিতকার। তারমধ্যে মিতার নামটাও ঢুকে যেত খুব স্বাবলীল ভঙ্গীতেই ।মহিলার গলা খুব পরিষ্কার শোনা যেতো-রাইত বিরাইতে কুন মাগীর কাছে গেসিলি তাতে ভরে নাই,যা তোর মাইয়ের কাছে যা।ওইটা আর বাকী থুইবি ক্যান?
রাগে চিৎকার করতো বাবা। মাঝে মাঝে দরাম দরাম পরতো মহিলার পিঠে।কিন্তু পরদিন সকালেই তার ঝাল মেটাতো দুই ভাই বোন কে দিয়ে পুরো বাড়ির কাজ করিয়ে ।আগে বাবা যাও মাঝে সাঝে আসতো কাছে,সে রাতের পর থেকে আর আসেনি।
ছোট ভাইটাকে স্কুল ছাড়িয়ে গ্যারেজের কাজে লাগানো হলো। কিন্তু মিতাকে পার করবে কি করে, এই নিয়ে সৎ মার নতুন ফন্দি আরম্ভ হলো। একেক দিন একেক জন ওকে দেখতে আসতো, কিন্তু সবি অশিক্ষিত। অশিক্ষিত নিয়ে নতুন মার কোন মাথা ব্যাথা নাই,তারা যা দাবী করছে সেটা দিতেই তার খুব সমস্যা। ছেলে যতো অসুন্দর বা অশিক্ষিতই হোক, যৌতুক ছাড়া বিয়ে কেউ রাজি না।
বাবার সাথে প্রতি রাতে পরামর্শ করতো-কিভাবে একদম বিনা খরচায় মেয়েকে বিদায় করা যায়।বাবা চুপ চাপ নীরবে শুনে যেতো।ভাদ্র মাসের তুমুল বৃষ্টিতে তরতাজা মেয়ে ভিজে যাচ্ছে আর বানের জলে মেয়েটা ভেসে গেলে এমন কি ক্ষতি।
বছর ঘুরতেই সৎ মায়ের পেটে বাচ্চা,এস এস সি পরীক্ষা কেবল শেষ হয়েছে।বহু কষ্টে মিতা সব গুলো পরীক্ষাই দিয়েছে ।সৎ মায়ের পেট যতো ফোলে তার চেয়ে বেশী ফোলে তার নজর।সারাক্ষন চোখ থাকে মিতার শরীরের উপর-ই মাগী,গতরে ওড়না থাকে না।বাপ যখন মাতাল হয়া গায়ে হাত দেয় তখন খুব আরাম লাগে না?
মিতা চিৎকার করে উঠে-মুখে যা আসে তাই কইবানা কইলাম।
-ইশ,কি করবি তুই আমারে?মায়তো মইরা বাঁচছে। যা না ,তুইও গলায় রশি দিয়া মর।
-হুম তাইলেতো তুমি বাঁচই। বিয়া দেওনের ঝামেলা নাই, কোন যৌতুক দেওন লাগবোনা।
-সবিতো বুঝস ,তাইলে এক খান ব্যাটার লগে ঝুইল্যা পড়স না কেন?
-হ,সবাইতো তোমার মতন বাজারের মাগী না।
কথাটা পুরো শেষ করেছি কি করেনি।হঠৎ এক দলা বৃষ্টির মতোন পানি এসে ওর মুখে পড়লো। মিতা কিছু বোঝার আগেই সহসা পুড়ে গেলো তার মুখ আর গলা।তার বীভৎস চিতকারে গ্রামের লোক ছুটে এলো। তারপর যখন হাসপাতালে , সে বোঝার চেষ্টা করেছে-কোথা থেকে এসিড এলো তাদের বাড়িতে ,কিছুই বুঝতে পারেনি।কেবল অবাক হয়ে দেখলো-এতো মাস পরেও বাবা একদিনো তাকে দেখতে আসেনি। তাহলে কি বাবাই এসিড এনে রেখে দিয়েছিলো আগে থেকে?
আর কিছু ভাবতে পারেনা মিতা।বাবাকে সে মাতাল দেখেছে,লম্পট দেখেছে,নিজের বাবার আর কোন কুতসিত চেহারা সে দেখতে চায় না।এবার বেশ স্পষ্ট করেই মিতা বলে-ভাই,আপনি লেখেন-আমারে স্কুলে যাওয়ার সময় এলাকার বখাটে পুলাপান বিরক্ত করতো। তাদের কু-প্রস্তাবে সাড়া দেই নাই বইলা এসিড মারসে। এর চেয়ে বেশি আমি আর কিছু কইতে পারুম না।
-তোমরা যদি আমাদের কো-ওপারেট না করো তাহলে বিচার পাবে কি করে, আমার রিপোর্টেও পুলিশ ইনভেস্টিগেশন করতে পারে।তুমি শিক্ষিত মেয়ে হয়ে চাও না অপরাধী শাস্তি পাক।
মিতা এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বার বার মায়ের করুন চোখটা তাকে তারা করছে। মা গহনা পড়তে বেশ ভালোবাসতো।প্রায়ি তার হাতে চিকন দুটি সোনার চুড়ি থাকতো, চুড়ির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যেত মিতার।মাকে বলতো-মাগো,তুমি যে এত গয়না পইড়া কাম করো তুমার যুইত লাগে?
-হাতের চুড়ি না থাকলে জামাইয়ের অমঙ্গল হয়।এখন বুঝবিনা।যখন বিয়া হইবো তখন বুঝবি।
মায়ের সেই মিটিমিটি হাসিতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতো স্বামীর জন্যে তার ভালোবাসার তৃষ্ণা। সেই তৃষ্ণা নিয়েই তাকে মরতে হয়েছিলো, বলা চলে তাকে খুন করা হয়েছিলো। মায়ের সেই ভালোবাসার মানুষটির এভাবে শাস্তি হোক কিভাবে তা মেনে নেবে মিতা। মা না হয় বেঁচে নেই , তবু বেঁচে থাক তার স্বপ্ন।
(গল্পটা একটা প্রতিযোগিতার জন্যে লেখা।সামু ব্লগে শেয়ার করলাম প্রিয় লেখকদের মতামত পাবার জন্য।
আমাকে না জানিয়ে কেউ গল্পটা কপি করলে নিজের কাছে নিজেই অপরাধী হয়ে থাকবেন।সবাইকে মহালয়ার শুভেচ্ছা।)