দ্যা লাঞ্চেন
লেখকঃ উইলিয়াম সামারসেট মম্
আমি তাঁকে থিয়েটারে দেখেছিলাম এবং তার অঙ্গুলিনির্দেশের উত্তরে বিরতির সময় তাঁর পাশে গিয়ে বসেছিলাম । অনেক অনেক দিন আগে তার সাথে শেষবার দেখা হয়েছিল এবং কেউ যদি তার নাম উল্লেখ না করতো তবে তাঁকে চিনতে পারা আমার পক্ষে কষ্ট হতো।
” কি খবর!! অনেক দিন পরে তোমার সাথে দেখা । কিভাবে সময়গুলো বয়ে চলে যায়!! আমরা দু’জনে কেউই আর যুবা নই। তোমার কি মনে আছে , যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো ? তুমি মধ্যাহ্নভোজে আমাকে ডেকেছিলে।‘
” আমার কি এখনো মনে আছে??
এটা ছিল বিশ বছর আগে যখন আমি প্যারিসে থাকতাম । ল্যাটিন কোয়ার্টারে কবরস্থানের মত দেখতে আমার একটি ছোট্ট এপার্টমেন্ট ছিল। বেঁচে থাকার মতন যথেষ্ট টাকা আয় করতাম । তিনি আমার একটি বই পড়েছিলেন এবং এটি সম্পর্কে আমাকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন । আমি উত্তরে তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। তারপরে তাঁর কাছ থেকে আরেকটি চিঠি পাই । চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, তিনি প্যারিস দিয়ে যাচ্ছেন আর তাই তিনি আমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছুক । কিন্তু তার সময় ছিল সীমিত আর কেবলমাত্র বৃহস্পতিবার সকালেই তার হাতে সময় রয়েছে। তাই আমি কি ঐদিন দুপুরে ফয়োটে মধ্যাহ্নভোজে আসতে পারবো কি না । ফয়োট ছিল একটি রেস্টুরেন্ট যেখানে ফ্রান্সের সিনেটররা খাওয়া দাওয়া করেন , আর তা আমার সাধ্যের এত বাইরে ছিল যে সেখানে যাওয়ার কথা আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। একদিকে আমি ছিলাম অভিভূত, অন্যদিকে কোন মহিলাকে সরাসরি ‘না’ বলার মতো যথেষ্ট অপরিপক্কও ছিলাম । পুরো মাস চলার জন্য আমার কাছে আশিটি ফ্রাংক ছিল আর আমি মনে করেছিলাম একটি পরিমিত মধ্যাহ্নভোজের খরচ পনের ফ্রাঙ্কের বেশি হওয়া উচিত নয় । যদি দুই সপ্তাহের জন্য কফি খাওয়া বন্ধ করে দিই, তাহলে আমি ভালো ভাবেই কাটিয়ে দিতে পারবো ।
আমি তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলাম বৃহস্পতিবার সাড়ে বারোটার সময় ফয়োটসে আমরা দেখা করছি। আমি যতটা আশা করেছিলাম তিনি ততটা তরুণী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বছর চল্লিশের এক মহিলা(আকর্ষণীয়, তবে প্রথম দেখায় প্রেমে পরার মতো নয়)। আমাকে দেখেই তিনি তার বড় এবং সাদা সবগুলো দাঁত বের করে একটি উদ্দেশ্যমূলক হাসি দিলেন । তিনি ছিলেন বাচাল, অনেক কথাই বলছিলেন, কিন্তু যখন তিনি আমার সম্মন্ধে কথা বলতে শুরু করলেন , আমি তা শুনার জন্য আরও মনোযোগী শ্রোতা হয়ে উঠলাম ।
যখন মেন্যুটা নিয়ে আসা হলো , আমি কিছুটা আঁতকে উঠলাম, দাম আমি যতোটা না বেশি ভেবেছিলাম তাঁর চেয়েও বেশি। কিন্তু তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন।
‘আমি মধ্যাহ্নভোজে কখনই কিছু খাই না’- তিনি বললেন।
‘ওহো, এইভাবে বলবেন না ”- আমি উদার ভাবে বললাম ।
“আমি একটার বেশি কখনই খাই না। আমার মনে হয় মানুষ আজকাল বেশিই খায়। একটি ছোট স্যামন মাছ, এতেই আমার হবে, যদি তাদের থেকে থাকে।
ভালো কথা, তখন স্যামনের মৌসুম ছিল না, রেস্তোরার মেন্যুতেও ছিলো না কিন্তু আমি ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলাম, তা আছে কি না ।- হ্যাঁ , একটি সুন্দর স্যামন, মাত্র এসেছে, এবং এটিই প্রথম স্যামন যেটি তারা পেয়েছে । আমি আমার অতিথির জন্য এটি অর্ডার করে দিলাম । ওয়েটার জিজ্ঞেস করলো এটি রান্না হতে হতে আর কিছু খাবেন কি না ।
“না” তিনি উত্তর দিলেন । “আমি কোনদিন একটির বেশি কিছুই খাই না, যদি না সামান্য একটু ক্যাভিয়ার থাকে। আমার ক্যাভিয়ার খুব পছন্দের”।
আমার হৃদয়টা শুকিয়ে যেতে শুরু করল । আমি জানি ক্যাভিয়ার আমার সাধ্যর বাইরে কিন্তু তাঁকে একথা বলাও আমার সাধ্যর বাইরে। আমি ওয়েটারকে বললাম যেকোনো উপায়ে ক্যাভিয়ার নিয়ে আসতে । আমার জন্য মেন্যু থেকে সবচেয়ে কম দামি খাবার পছন্দ করলাম আর এটা ছিল একটি মাটন চপ ।
“আমার মনে হয় আপনার মাংস খাওয়া ঠিক নয়’- সে বললো ।‘মাটন চপের মতন এত ভারি খাবার খাওয়ার পরে আপনি কিভাবে কাজ করবেন? আমি পেট পুরে খাওয়াটা আমি পছন্দ করি না।'
এখন পানীয়ের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা ।
“আমি মধ্যাহ্নভোজে কিছুই পান করি না”- সে বললো ।
‘আমিও না’ -আমি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে দিলাম ।
“শুধু হোয়াইট ওয়াইন’- তিনি এমনভাবে বললেন যেন আমি কিছুই বলিনি।‘এই ফ্রেঞ্চ ওয়াইনগুলো অনেক হাল্কা, হজমের জন্য দারুন।‘
‘আপনি এখন কি নিবেন’- আমি অতিথিপরায়ণতার সাথে জিজ্ঞেস করলাম ।
তিনি আমাকে ঝকঝকে বন্ধুতপূর্ণ একটি হাসি দিলেন ।
“আমার ডাক্তার আমাকে শ্যাম্পেন ছাড়া কিছুই খেতে নিষেধ করেছে’
আমি অভিনব ভাবে কিছুটা ম্লান হয়ে গেলাম । আমি অর্ধেক বোতল অর্ডার দিলাম । আমি আকস্মিকভাবেই বললাম যে আমার ডাক্তার আমাকে শ্যাম্পেইন খেতে শক্তভাবে বারণ করেছেন।
‘তাহলে আপনি কি পান করবেন?’
‘পানি’
তারপর তিনি ক্যাভিয়ার এবং পরে স্যামন খেতে শুরু করলেন । তিনি আনন্দের সাথে শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে কথা বলছিলেন । আর আমি চিন্তা করছিলাম বিল কত আসবে । যখন আমার মাটন চপ আসলো তখন তিনি গম্ভীরভাবে আমাকে ভৎসনা করতে শুরু করলেন।
‘ আমি দেখছি আপনার ভারি মধ্যাহ্নভোজ করার অভ্যাস আছে। আমি নিশ্চিত এটা ভুল। আপনি কেন আমার মতন মধ্যাহ্নভোজে শুধুমাত্র একটি খাবার গ্রহণের অভ্যাস অনুসরণ করছেন না? আমি নিশ্চিত আপনার ভালো লাগবে।‘
‘আমি শুধুমাত্র একটি আইটেমই খেতে যাচ্ছি’-আমি বললাম যখন ওয়েটার আবার মেন্যু নিয়ে আসছিলেন তখন। তিনি ইশারায় তাঁকে একপাশে সরিয়ে দিলেন।
“না, না, আমি মধ্যাহ্নভোজে কিছুই খাই না। সামান্যই খাই, আমি এর চেয়ে বেশি কিছু চাই ও না, তা ও শুধুমাত্র কথাবার্তা বলার জন্যই ওই সামান্যটুকুই খাই। আমি এর চেয়ে বেশি কিছু খেতে পারবো না যদি না তাদের ওই বিশাল বিশাল অ্যাস্পেরাগাসগুলো থাকে । ওগুলো না খেয়ে প্যারিস ছেড়ে চলে যেতে হলে আমার খারাপ লাগবে।
আমি আবার নিরাশ হলাম । আমি ওগুলো দোকানে দেখেছিলাম এবং আমি জানতাম ওগুলোর দাম ভয়াবহ রকমের বেশি।
আমি ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করলাম –‘ম্যাডাম জানতে চাইছেন, আপনাদের কি কোন বড় অ্যাস্পেরাগাস রয়েছে? ‘
আমি সর্ব সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম সে যাতে ‘না’ বলে। কিন্তু আমার কথা শুনে তার নিস্পাপ মুখে আনন্দময় উজ্জল হাসি ছড়িয়ে পড়ল এবং সে আমাকে আশ্বস্ত করলো এই বলে যে, তাদের কাছে এত বড়, এত চমৎকার ও এত কোমল অ্যাস্পেরাগাস রয়েছে যেটা অবিশ্বাস্য।
“আমার এক চিলতে ক্ষুধা নেই”- আমার অতিথি এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বললো । “কিন্তু আপনি যদি জোর করেন তাহলে কিছু অ্যাস্পেরাগাস খেতে আমার সমস্যা নেই।‘
আমি অর্ডার দিলাম।
‘আপনি নিবেন না ?’- তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
‘না, আমি কোনদিন অ্যাস্পারেগাস খাই নি।‘-আমি উত্তর দিলাম।
‘আমি জানি কিছু মানুষ অ্যাস্পেরাগাস পছন্দ করেন না । আর এখন মাংস খাবার কারণে আপনার ক্ষুধাবোধ নস্ট হয়ে গিয়েছে।‘
আমরা অ্যাস্পেরাগাস রান্না শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম । আমাকে আতংক গ্রাস করলো। এখন এটা প্রশ্ন নয় যে কত টাকা বাকি থাকলে আমি বাকি মাস চালাতে পারবো, বরং প্রশ্ন এটাই যে আমি ঠিকমত বিল দিতে পারবো কিনা । যদি সামান্য দশ ফ্রাঙ্কের ঘাটতি পরে এবং তা যদি তখন আমার অতিথির কাছ থেকে ধার করতে হয় তবে তা অপমানজনক হবে আমার জন্য। আমি তা করতে পারতাম না। আমি জানতাম আমার কাছে কতো রয়েছে। তাই ঠিক করে রেখেছিলাম- যদি বিল বেশি আসে তবে আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে নাটকীয়ভাবে চিৎকার করে উঠবো- আমার পকেটমার হয়ে গিয়েছে!!! আর যদি আমার অথিতির কাছে ও বিল পরিশোধ করার মত পর্যাপ্ত অর্থ না থাকে তাহলে খুব বিশ্রী ব্যাপার হবে। তখন শুধু আমার একটাই পথ খোলা থাকবে আর তা হলো বিল বাবদ আমার ঘড়িটি বন্ধক রেখে যাব আর বলব- আমি পরে এসে বিল পরিশোধ করে দিব।
অ্যাস্পেরাগাস চলে এলো। এইগুলো ছিল অনেক বড়, রসালো আর ক্ষুধা উদ্রেককারী। আমি সবিনয়ে বলকানের নাটকের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম আর শুধু দেখছিলাম সেই অসংযমী মহিলা কিভাবে সেই বড় বড় অ্যাস্পেরাগাস গুলো তার বিশাল মুখে ঢুকিয়ে গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করছে। অবশেষে তার খাওয়া শেষ হলো ।
‘কফি?’- আমি জিজ্ঞাসা করলাম ।
“হ্যাঁ। শুধু একটি আইসক্রিম, আর কফি।- তিনি উত্তর দিলেন।
আমার এখন অতো চিন্তা নেই তাই আমি আমার জন্য কফি আর তাঁর জন্য কফি ও আইসক্রিম অর্ডার দিলাম। “আপনি জানেন, আমি একটি জিনিষ খুব বিশ্বাস করি।‘- তিনি আইসক্রিম খেতে খেতে বললেন – ‘পেটে অল্প জায়গা থাকতেই খাওয়া শেষ করে দেয়া উচিত।‘
‘আপনি কি এখনো ক্ষুধার্ত?’- আমি স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলাম।
‘ওহ,না, আমি ক্ষুধার্ত নই। আপনি তো দেখেছেন আমি দুপুরে কিছুই খাই না । সকাল বেলায় এক কাপ কফি, তারপর রাতের আহার। কিন্তু দুপুরে একটির বেশি কিছুই খাই না। আমি শুধু আপনার জন্যই বলছিলাম।‘
‘ওহ! আচ্ছা।‘- আমি বললাম।
তারপরেই সেই ভয়ানক ব্যাপারটা ঘটলো । আমরা যখন কফির জন্য অপেক্ষা করছিলাম,তখন ওয়েটার তোষামোদি ভঙ্গিতে মুখে হাসি নিয়ে বড় বড় পীচফল ভর্তি একটি ঝুড়ি নিয়ে আসলেন। সেই ফলগুলোর রঙ ছিল কোন নিস্পাপ বালিকা মুখের আভার মতই সুন্দর কিন্তু নিঃসন্দেহে তখন পীচফলের মৌসুম ছিল না। তাহলে? ঈশরই জানেন তাদের কি দাম!!
“দেখেছেন, আপনি মাংস খেয়ে পুরো পেট ভরিয়ে রেখেছেন।‘– আহা, আমার হতভাগ্য ছোট্ট একটা চপ!! – আপনি আর খেতে পারবেন না, কিন্তু আমি সামান্য খাবার খেয়েছি আর এখন আমি একটা পীচফল উপভোগ করবো।”
বিলটা এলো আর আমি পরিশোধ করে দেখলাম বাড়তি আমার হাতে যা রয়েছে তা কেবলমাত্র অপর্যাপ্ত বখশিশ প্রদানের জন্য যথেষ্ট। ওয়েটারের বখশিশের জন্য রাখা তিন ফ্রাঙ্কের দিকে আমার অতিথির একবার চোখ পড়ল আর আমি জানি তিনি আমাকে কৃপণ ভাবছিলেন। কিন্তু আমি যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম, তখন আমার সামনে পুরো মাস পড়ে রয়েছে আর আমার পকেটে কোনো টাকাই নেই ।
‘আমার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করুন’- হাত মেলাতে মেলাতে তিনি বলছিলেন।‘আর কখনো মধ্যাহ্নভোজে একটির বেশি খাবার খাবেন না।‘
‘আমি এর চেয়েও ভাল কিছু করব’-আমি জবাব দিলাম।‘আমি আজ রাতে কিছুই খাবো না।‘
‘রসিক!!’ গাড়িতে উঠতে উঠতে তিনি সাহ্লাদে বলে উঠলেন। ‘আপনি পুরোপুরিই রসিক!!’
অবশেষে আমি প্রতিশোধ নিতে পেরেছি। আমি বিশ্বাস করি না যে আমি একজন প্রতিহিংসাপরায়ন ব্যাক্তি, কিন্তু সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যখন কোন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন তখন তার ফলাফল প্রসন্নচিত্তে লক্ষ্য করা মার্জনীয়। আজকে তার ওজন ১৩০ কেজি!!!
***************************** ************************************** *******************************
সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতিঃ
উইলিয়াম সামারসেট মম্ একজন প্রখ্যাত নাট্যকার, ছোট গল্পকার এবং উপন্যাসিক। জন্ম ২৫ শে জানুয়ারি, ১৮৭৪, মৃত্যু ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৬৫। তার যুগে তিনি ছিলেন একজন অন্যতম সেরা এবং সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রাপ্ত লেখক।
তার উল্লেখযোগ্য রচনাঃ Of Human Bondage, The Moon and Sixpence, Cakes and Ale, The Razor’s Edge প্রমুখ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১১:৪৩