১৩.০২.২০১৮ সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিট।
অফিস থেকে ফিরেই সাজু ল্যাপটপ নিয়ে বসে যায়। ইন্টারনেটের কানেকশন দিতে দিতে এক কাপ গরম কফি বানিয়ে নেয়। তারপর এসির টেমপেরাচার একটু কমিয়ে দিয়ে নরম গদিতে হেলান দিয়ে বসে। গরম কফির কাপে একটু একটু চুমুক দিয়ে নিস্তেজ শরীর টাকে একটু একটু করে চাঙ্গা করে তোলে। সেই সাথে ল্যাপটপের পর্দায় বিভিন্ন অনলাইন শপ গুলোতে ঢু মারতে থাকে। কাল ভ্যালেন্টাইন দিবস। তার সাথে দেখা করতে হবে। সেই সাথে তার আবার জন্মদিন ও। বিভিন্ন অনলাইন শপগুলোতে ঢু মারতে থাকে কিন্তু কোন কিছুই পছন্দ হচ্ছে না। দূর ছাই!! কি যে প্রয়োজন তা ও তো সাজু বুঝতে পারছে না। কফিটাও ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।
সাজু উঠে গিয়ে আরেক কাপ গরম কফি নিয়ে আসে। এরপর আবার অনলাইনে ঘোরাঘুরি করতে থাকে। একটা শাড়ি দিব? লাল টকটকে শাড়ি? উহু! লাল শাড়ি তিনি তো পরবেন না আবার। যত্তসব!! তাহলে কি দেয়া যায়?? কানের দুল? একটি আংটি?? উহু। অনেক দাম!! পছন্দ হচ্ছে না। তাহলে কি দেয়া যায়!! কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না। এমন কিছু দিতে হবে যাতে তিনি চমকে যান। আচ্ছা, এক তোড়া লাল টকটকে গোলাপ দিলে কেমন হয়? একেবারে ফ্রেশ লাল টকটকে ১৪ টি গোলাপের তোড়া হাতে তুলে দিব। সেই সাথে শুভেচ্ছা জানাব- হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে এন্ড হ্যাপি বার্থডে। সাথে একটা চুমু দিব। এইতো উপহার!! আইডিয়া পাওয়া গিয়েছে। উনার কাছে একটা চুমুর অনেক দাম। তাহলে শুধু শুধু পয়সা খরচ করে লাভ কি!! একটা চুমুর জায়গায় দুটো দেয়া যাবে। তাহলে উনিও খুশি আর পকেট ও খুশি।
ভাবতেই সাজু শিষ দিয়ে উঠে। এবার ফ্রেস হওয়া দরকার। ল্যাপটপে কয়েকটি মৃদু লয়ের ইংরেজি গান ছেড়ে দিয়ে বাথরুমের দিকে রওনা হয়।
১৪.০২.২০১৮ সকাল ৮ টা।
বসকে গতকালই বলে আজকের দিনটা ছুটি নিয়ে রেখেছিল সাজু। অবশ্য খালি হাতে বসের রুমে যায়নি। একটা হালকা বেগুনি রঙের দামি টাই নিয়ে গিয়েছিল। সে তো জানেই কাকে কি দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়। আজ ছুটি তাই একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠল সাজু। বাথরুমে ঢুকে শেভ করে গোসল সেরে নিল। একদম ফ্রেস লাগছে এখন। ইতালি থেকে আনা আফটার শেভ লোসনের গন্ধটাই আলাদা। ঘ্রানেই শরীর টা মনে হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আলমারি খুলে কালো চকচকে প্যান্ট আর হালকা আকাশী রঙের শার্ট বের করে সাজু। এই রঙের শার্টটি উনার খুব পছন্দ তাই বেছে বেছে এটাই পরল। শার্টের হাতের হিরা বসানো কাফলিং গুলো লাগাতে লাগাতে সাজু আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগল। নাহ! চমৎকার লাগছে নিজেকে। বিশেষ করে চিবুকের ভাঁজ টা। উনি সবসময় এই চিবুকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে। তখন উনার চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করতে থাকে। আনমনে হেসে সাজু নিজের চিবুকের ভাঁজটা আলতো ছুঁয়ে দেখে।
১৪.০২.২০১৮ সকাল ৯ টা।
নাস্তা করা শেষ। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সাজু আবার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। প্যারিসের নামকরা কোম্পানির পারফিউম মেখে শেষবারের মতো নিজেকে একবার দেখে নেয়। তারপর গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে যায়।
১৪.০২.২০১৮ সকাল ১০ টা।
ফুলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সাজু ফুল পছন্দ করতে থাকে। দোকানী কে বলে বড়বড় ১৪ টি লাল টকটকে গোলাপ সাজু নিজ হাতে বেঁছে নেয়। দোকানী সেই গোলাপগুলো একটি সুন্দর স্বচ্ছ র্যাপপিং পেপার দিয়ে মুড়িয়ে দিয়েছে। সাজু আরেকবার দেখে নেয়। হুম!! খুব তাজা ফুলগুলো। ঘ্রাণেই মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছে। উনি অনেক অনেক পছন্দ করবেন। ভাবতেই স্মিত হেসে উঠে সাজু।
১৪.০২.২০১৮ সময় ১১ টা।
সাজু গাড়ি পার্ক করে দাঁড়িয়ে আছে। এটাই সেই বাড়ি। বাইরে থেকে দেখতে অনেক সুন্দর। ধবধবে সাদা রঙ করা। প্রধান দরজা পার হলেই একটি পায়ে হাটার চমৎকার রাস্তা চলে গিয়েছে মূল বাড়ি পর্যন্ত। দুপাশে চমৎকার ফুলের বাগান। বাড়ির নামটিও সুন্দর। ‘আনন্দবাড়ি’। পরিষ্কার পায়ে হাঁটা পথ ধরে সাজু এগুতে থাকে। সদ্য কেনা কালো চকচকে জুতাটা মচমচ শব্দ করছে। দুপাশে ফুলের বাহার দেখতে দেখতে সাজু এগুচ্ছে। তার নিজের হাতের ফুলের তোড়ার মতন এত বড় ফুল বাগানে একটি ও নেই। আহ! ভাবতেই ভালো লাগছে। ফুলের তোড়াটি হাতে তুলে দিলে উনি যে কত খুশি হবেন তা ভাবতেই সাজুর শিহরন জাগছে।
কয়েক পা এগুতেই সাজুর চোখে পড়ে। ওইতো উনি। আর কিছুটা এগুলেই পৌঁছে যাবে সাজু। দূর থেকেই বুঝতে পারছে উনার আনন্দ। যতবারই সাজু এখানে এসেছে, কিভাবে যেন উনি আগের থেকে ঠিকই টের পেয়ে যান। অবাক হয় সাজু। এরই নাম কি ভালোবাসা!!
১৪.০২.২০১৮ সময় ১১.১০ মিনিট।
উনি তাকিয়ে আছেন। চোখের কোণায় আনন্দের জল চিকচিক করছে। সাজু হাঁটু গেঁড়ে ফুলের তোড়াটি এগিয়ে দিল। তারপর শুভেচ্ছা- হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে, মা। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। তারপর সেই দামী উপহার। মা কে পরপর দুটো চুমু দিল। মা শক্ত করে সাজুর হাত ধরে আছেন। চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে। দু হাতের মুঠো দিয়ে শক্ত করে তিনি সাজুর হাত ধরে আছেন। কয়েক ফোঁটা অশ্রু তার ও সাজুর মুঠোবন্দী হাতের উপর ও টপটপ করে ঝরে পড়ল। শক্ত, খুব শক্ত করে ধরে রেখেছেন তিনি। এ যেন নাড়ি ছেড়া ধন কে চিরতরে শক্ত করে ধরে রাখার প্রচেষ্টা। বেশ কয়েক বছর মা কথা বলতে পারেন না। কিন্তু তিনি যা বলতে চাইছেন, কয়েক ফোঁটা অশ্রু যেন তার সবটুকুই বলে দিল। সাজু তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের ঘোলাটে চশমার মাঝ দিয়ে উজ্জ্বল চোখে যেন কিসের আকুতি। সাজু বুঝেও বুঝতে পারে না। হুইল চেয়ারে বসা মায়ের দিকে সাজু ভাল করে আরেক বার তাকায়। সাদা সুতির শাড়িতে মা কে কি অপূর্বই না লাগছে। মা শক্ত করে, খুব শক্ত করে সাজুর হাত ধরে আছেন। সাদা শাড়ির জমিনে লাল গোলাপের একটি পাপড়ি পড়ে রয়েছে। মুখ তুলে সাজু আরেকটি বার মায়ের দিকে তাকায়। সকালের উজ্জ্বল রোদে মায়ের সাদা শাড়িটি আরো উজ্জ্বল লাগছে। শুধু মায়ের মুখে অল্প একটু ছায়া। ‘আনন্দবাড়ি বৃদ্ধাশ্রম’ লিখা সাইনবোর্ডের ছায়া।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১:০২