যবে থেকে হলের বাইরে থাকা শুরু করেছি তবে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় লোকাল বাসে চড়ে যাই। তবে ক্যাম্পাস থেকে ফেরার সময় কখনো চৈতালি, কখনো বৈশাখী বা কখনো হেমন্ত বাসে চড়ে বসি। আমার মত মূল্যহীন মানুষদের কাছে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠলে নিজেকে বেশ দামি-দামি মনে হয়। আর ঢাকা শহরে যে যানজট তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসই আরামদায়ক ভ্রমণের একমাত্র নিয়ামক। এতে সময়ের তেমন ফিরিস্তি দিতে হয়না।
রাতজাগা সকালটা আড়মোড় ভাঙতেই বেশ বেলা হয়ে যায়। প্রতিদিন ভাবি সক্কাল সকাল উঠে বাস ধরবোই ধরবো কিন্তু ঘুমের সাথে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠি না। আবার সেই লোকাল বাসের জন্য অপেক্ষা, আবার সেই যানজট, আবার ভিড়ের মধ্যে সিটের জন্য ঠ্যালাগুতা, কনট্রাক্টরের সাথে স্টুডেন্ট ভাড়া দেওয়া নিয়ে খিস্তিখেউড়। নাহ আর ভালো লাগেনা। বাবাকে বহুবার একটা পুরাতন বাইকের জন্য বলেছি বটে কিন্তু বাবার ওই এক কথাঃ- (ধমক দিয়ে)
- দেশের ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নিজের খরচ নিজে চালায়, বাড়িতে টাকা পাঠায় আর তুই এতো বড় অকর্মা প্রতি মাসে আমার থেকে টাকা নিয়ে চলিস! আবার এখন বলিস বাইক চাই? আমি কি টাকার গাছ নাকি রে? নিজে কিছু করে টাকা রোজগার কর তারপর গাড়ি চাই ঘোড়া চাই নিজে কিনে নিস।
- আরে ঘোড়া দিয়ে আমি কি করবো? ঢাকা শহরে কি ঘোড়ার পিঠে কেউ চলে নাকি?
- কেউ ঘোড়ায় না চড়ে তুই ছড়বি। ঘোড়া চালাইতে তো তেল খরচ নাই। তুই গাড়ি কিনে তো চালাতে পারবি না তেল খরচের অভাবে। তোর জন্য ঘোড়াই দরকার।
- তুমি কি জানো ঘোড়ার ভরণ-পোষণে কত টাকা লাগে?
- আবার মুখে মুখে তর্ক করিস? বেয়াদব!
একবছর যাবত বাবার এই জাতীয় ধমক শুনতে শুনতে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। এখন আশা ছেড়ে দিয়ে লোকাল বাসকে একমাত্র অবলম্বন মনে করি। যাকগে সে কথা এখন মূল গল্পে আসি-
কল্যাণপুর বাস স্টপেজ থেকে খুব ঠেলাঠেলি করে ভাঙ্গাড়ি মার্কা বাস ডি লিংকে উঠেছি। যেমন ভিড় তেমন গরম; ঘেমে ঘুমে একাকার অবস্থা। চাতকের মত অপেক্ষা করছি কখন একটা সিট খালি হবে আর আমি পুচুৎ করে বসে পড়ব। ভাগ্য আমার এতো ভাল ছিল যা লিখে বোঝানো অসম্ভব। দেখি শ্যামলী স্কয়ারের সামনে যেতেই আমার কাছের সিটটি ফাঁকা হয়েছে। জানালার পাশে উদাস মনে বসে ছিল এক সুন্দরী ললনা। আরব্য রজনীতে মরুভূমির বুকে চাঁদকে যেমন অপরূপ সুন্দর দেখায় রমণী তার থেকে অধিক সুন্দর। মনে প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্যেও তার গায়ে ঘেঁসে বসতে পারিনি আমি। কিন্তু অদ্ভুত একটা টান অনুভব করেছিলাম। চুম্বক- লোহার যে আকর্ষণ তার থেকেও প্রবল আকর্ষণ আমার মধ্যে তখন।
নাহ! এটা তোমার নৈতিকতার স্খলন। কোনভাবেই যেন ললনার শরীরের সাথে তোমার শরীর না লাগে। এই কথা ভেবে মনকে বুঝ দিলাম আর হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা টা দুজনের মাঝখানে দিয়ে বসে আছি। জানিনা ললনা আমার দিকে একবারের জন্য ফিরেও চেয়েছিল কি না; অবশ্য আমি প্রথমে দু-একবার যে তার দিকে চাইনি এমনটা না।
কি করবো! পাশের সিটে সুন্দরী ললনাগন জোর করে বসতে চাইলেও মনের সিট যে ফাঁকা পড়ে আছে গত চব্বিশ-পঁচিশ বছর। ললনা দেখলে শুধু হাহাকার করে ওঠে।
মনের মধ্যে কত রকম কল্পনা বাসা বেঁধেছে তখন; যেন সেই রাজ্যে আমি রাজা আর রানী বসে আমার পাশের সিটে।
- মামা ভাড়া দেন। (মাঝবয়সী কনট্রাক্টরের কণ্ঠস্বর)।
দুঃখজনকভাবে আমি বুক পকেট থেকে ১ টাকার ২ টি কয়েন হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভাবলাম ভিক্ষুককে স্বর্ণের মোহর দিছি। কারণ তখন তো আমি নিজেকে রাজা কল্পনায় ডুবে আছি। কনট্রাক্টর ঝেংটি মেরে কয়েন দুটো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে-
- ২ টাকা ভাড়া নাই কথাও।
ইতোমধ্যে সম্বিত ফিরে পেয়ে হতবম্ব আমি তাড়াতাড়ি করে ৫ টাকা দিয়ে-
- ওই মিয়াঁ দেখেন না স্টুডেন্ট? (আমার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ দেখে সে আর কোন কথা না বলে কেটে পড়েছে ততক্ষণে।)
বাস ইতোমধ্যে ল্যাব এইড- সিটি কলেজের বিশাল জ্যামে আটকে গেছে। মিনিট-ঘন্টা কখন চলে গেছে জ্যাম আর ছোটে না। বসেই থাকলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছি; সিগনাল শেষ হয়না।
দিনের শেষ। সন্ধ্যা হয়েছে কেবল। জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখি একজোড়া কপোত-কপোতী রিক্সার মধ্যে পরম ভালোবাসার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে মিশে যেতে চাইছে একে অন্যের শিরার-উপশিরায়। আমার পার্শ্বস্থ ললনাকে তখনই কেবল আমার চোখের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসতে দেখেছিলাম। মুক্ত ঝরেছিল সে হাসিতে। আমি অপলক তার ঠোঁটের দিকে চেয়ে আছি। তার চোখে চেয়ে দেখি কি যেন খুঁজছে আমার বদনে।
তাহলে কি মেয়েটি আমায় ভালবেসেছে?
ধুর! কি সব ভাবছি আমি! কথাই হলনা এখনো পর্যন্ত আর ভালোবাসার চিন্তা করে ফেলেছি আমি। আমি কত বোকা!
প্রেমিকরা হয়তো একটু বোকাসোকা হয়।
আমি মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটিও একটানা আমার চোখের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে।
বঙ্কিম বাবু বালক বালিকার চোখে চোখ রাখা দেখে বলেছিলেন, "জানিনা তাহাদের চোখে চোখে কোন কথা হইয়াছিল কিনা তবে আমার মনে হয় তাহাদিগের মাঝে কিছু কথা হইলেও হইতে পারে।"
বঙ্কিম বাবুকে আমি নিশ্চিত করতে চাই যে, চোখে চোখে অনেক কথা হয়। আমি মেয়েটির উষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে তার মনের কথা বুঝে নিয়েছিলাম। সে কেবল আমায় বলেছিল, "তোমায় ভালবেসেছি হে যুবক।"
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:৪৭