এবার কোরবানির ঈদে বিশেষ কারনে গ্রামের বাড়িতে যেতে পারিনি বা যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ভেবেছিলাম নতুন অভিজ্ঞতা হবে এবারের ঈদে কারন আমার জীবনে প্রথম কোন ঈদ পরিবার পরিজন ছেড়ে করেছি। অবশ্য অভিজ্ঞতা যে একেবারে হয়নি তা কিন্তু না। তবে এই অভিজ্ঞতার ফল মোটেই মিষ্ট ছিল না। ছিল তিক্ততা আর বিষাদে ভরা।
প্রথমে গ্রাম্য ঈদের বর্ণনা দিয়ে শুরু করি। প্রতি ঈদের দিন সকালে বাবা-মা ঘন্টাখানেক চেঁচামেচি করে ঘুম ভাঙ্গায় আমার। তারপর শুরু হয় আমাদের বাড়ির যৌথ টিউবওয়েলে গোসল করার প্রতিযোগিতা। একসাথে ৬/৭ জন মিলে গোসল করতে যে মজা তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। একজনের গোসল শেষ, তো সেখানে ফাঁক-ফোঁকড় দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে অন্যজন। আমি টিউবওয়েলের পার্শ্ববর্তী রাস্তায় বসে সকলের এই মজার গোসলের চিত্র অবলোকন করি আর সিরিয়াল ভাঙ্গার চেষ্টা করি কিন্তু আমি সবার শেষে এসে সিরিয়াল এন্ট্রি করি সেজন্য ছোটভাই-বোনগুলো কোনভাবেই আমাকে সিরিয়াল ভেঙ্গে সামনে অগ্রসর হতে দেয় না। ঘুষ (ঈদ সেলামি) দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ছোটবোন গুলোকে বুঝাতে পারলেও বাঁধ সাধে পিচ্চি পোলাগুলো। কারণ টা একেবারে ফেলে দেওয়ার মত না। অনেকবার ঈদে ওদের সেলামি দিতে চেয়েও দেইনি তাই এখন ওরা আমাকে বিশ্বাস করে না। আমি আর কি করব? পেছনের লাঙ্গলের মত সবাই যাওয়ার পর আস্তে-আস্তে গোসল সেরে নেই সবার শেষে।
গোসল করে এসে দেখি মা আলমারি থেকে নতুন পাঞ্জাবী-পাজামা আর টুপি বের করে রেখেছে। বাবা কিন্তু অনবরত বকাবকি করেই চলেছে আমার ঢিলেমুসির জন্যে। তড়িঘড়ি করে পাঞ্জাবী-পাজামা পরে সেলামির আশায় তৃষ্ণার্ত কাকের মত বসে থাকি। মা ইতিমধ্যে পায়েসের একটা প্লেট এনে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। গোগ্রাসে খেয়ে ফেলি গরম গরম সেমাই। মন শুধু সেলামি কই, সেলামি কই করতে থাকে। অবশেষে বাবা বকাবকি বন্ধ করে ১০০ টাকার ১ টা নোট হাতে গুঁজে দেয়।
“এতক্ষন বসিয়ে রেখে মাত্র ১০০? ধুর এইটা নিমু না। লাগবো না তোমার টেকা! ধরো!!!” বলে টাকা টা বাবার পাঞ্জাবীর পকেটে জোর করে গুঁজে দিয়ে বলি ঈদ পড়তে যাবনা। বাবা নিরুপায় হয়ে পকেট থেকে কয়েকটা ৫০০ টাকা কয়েকটা ১০০ টাকা আর ভাংতি ১০/২০ টাকার কয়েকটা নোট বের করে হিসেব মিলাতে থাকে যে কত দেবে। বাবার হিসেব করা দেখে মনে হয় ১০০ টাকার সাথে ১০ অথবা ২০ টাকা দিয়ে বলবে, “এই নে!” এর ফাঁকে আমি বাবার বাঁ-হাতে থাকা ৫০০ টাকার নোটের উপর হামলা করে বসি। হ্যাঁচকা টানে সবগুলো নিয়ে নেই। তারপর একটি আমার পাঞ্জাবীর পকেটে ভরে সবগুলো সুবোধ বালকের মত ফিরিয়ে দেই। বাবা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে থাকে কিন্তু কিছুই বলতে পারে না। দরজার এপাশে বারান্দায় দাড়িয়ে মা আমার আর বাবার কান্ড-কারখানা দেখে আর নতুন শাড়ীর আঁচলে হাসি ঢাকে। আমি ইদ্গাহের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার সময় মা কখনো ২০ টাকা কখনো ৫০ টাকা সেলামি দেয়। আমি হাসিমুখে গ্রহণ করি। মাকে অত্যাচার করা হয়নি কখনো। কারণ আমি জানি মা এই ২০ টাকা বা ৫০ টাকা মুরগীর ডিম বা হাসের ডিম বক্রি করে আমাদের ৩ ভাইবোনের সেলামি দেওয়ার জন্য গুছিয়ে রেখেছে অনেকদিন থেকে। (মায়ের কথা লিখতে গিয়ে এখন চোখে জল টলটল করছে)
ইতিমধ্যে বড় চাচা হারুন, হারুন বলে ডাকা শুরু করেছে। তড়িঘড়ি করে কাছে যাই বড় চাচার। পকেট থেকে ১০০০ টাকার একটা কচকচে নোট বের করেছে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “ধর! এত দেরি করিস কেন তোরা? দেশের লোক সব ইদ্গাহে চলে গেছে।” আমি টাকা টা নিয়ে ভোঁ দৌড়। আমার দৌড় দেখে রাস্তার আশেপাশে থাকা চাচি গণ ভাবে হয়তো ধানেক্ষেতে গরু পড়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই।
ইদ্গাহের মাঠে গিয়ে দাদা সম্পর্কীয় মুরুব্বীদের পাশে বসি। বসে একটু গুতাগুতি, পাঞ্জাবী ধরে টানাটানি এসব চলতে থাকে। ইমাম সাহেব তখন জ্ঞানমূলক কথা বলছেন। মাঝে মাঝে কোন এক দাদা চুপিচুপি বলে ওঠেন, "হেই চুপ কর। হুজুর কি কয় তা শোন।" কিছুক্ষণের জন্য নীরব থেকে আবার পূর্বের মত পরিবেশ।
ঈদের নামাজ শেষ হলে মনোযোগের সহিত খুতবা শুনি সবাই (যদিও আরবি ভাষা বুঝি না)। তারপর মুনাজাত শেষে কোলাকোলির ধুম পড়ে যায়। কে আগে কার সাথে কোলাকুলি করতে পারে এই প্রতিযোগিতা চলে। একে একে সবার সাথে কোলাকুলি করে বন্ধুদের ঈদের মাঠ থেকে এক প্রকার জোর করে ধরে নিয়ে আসি বাড়িতে।
আমাদের বাড়ি থেকে শুরু হয় সেমাই কাওয়ার পর্ব। সব বন্ধুরা মিলে একসাথে সব বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেমাই খেয়ে আসি। সবাই খুব খুশি হয় আমাদের এই কর্মকান্ড দেখে।
সেমাই পর্ব শেষে শুরু হয় পশু কোরবানি। আমি বাড়ির বড় ছেলে হওয়ায় কোরবানির স্পটে আমার থাকা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে আমার বাবা আর চাচারা মিলে। পশু কোরবানি শেষে আমাকে পশুর চামড়া ছেলার কাজে লাগিয়ে দেয় দাদা-চাচারা। বাধ্যতামূলক এই কাজ সম্পন্ন করে আমার ছুটি।
এরপর ধান্ধায় থাকি বাইকের চাবির জন্য। কোন রকমে চাচাত ভাই ফাহিম'কে (বয়স ৭ বছর) ১০ টা টাকা দিয়ে চাবি নেওয়ার ব্যাবস্থা করি। চাবি নিয়ে এক মুহূর্ত বাড়িতে থাকার যো নেই। কে আবার কোনদিক দিয়ে কাজে লাগায় তার ঠিক নেই। বাইকে কিক মেরেই পংখিরাজের গতিতে চলে আসি গ্রামের পার্শ্ববর্তী বাজারে। আকাশ ভাই, শাহিন ভাই, হাফিজ ভাই সহ অনেকে অপেক্ষমান থাকে সেখানে। এইবার তো হয় মজা। বাইক নিয়ে বের হয়ে যাই সাতক্ষীরার অলি-গলিতে। সারাদিন ঘুরে রাতে বাসায় ফিরে আসি। মা তখন কোরবানির গরুর মাংস নিয়ে মূর্তিমান হয় সম্মুখে। বাধ্যতামূলক কড়া নজরদারির মধ্যে থেকে এক প্লেট মাংস খেতেই হয় মায়ের সামনে বসে।
গ্রামে এভাবে আনন্দ আর মজার মদ্ধ দিয়ে কাটে আমার প্রতিটা ঈদ। আমার গ্রাম আমার জগত, আমার অহংকার। ভালোবাসি হিজলিয়া গ্রাম টা, ভালোবাসি গ্রামবাসী সকলকে, অনুভব করি প্রতিটি ক্ষণে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এবার আসি শহুরে ঈদের বর্ণনায়। সকাল ৬ টা বেজে ১৩ মিনিট। বাবার ফোনে ঘুম ভাঙল। পাশের বেডে বখতিয়ার (আমার ছোটভাই) আর কবির ভাই (মামাতো ভাই) তখনো ঘুমাচ্ছে। ইস রে! আজকে ঈদের দিন আর এই দিনে এখনো কোরবানির পশু কেনা হয়নি আমাদের। বাদ-বাকি যা বাজার-সদাই সব গতকাল সন্ধ্যার মাদ্ধে কিনে ফেলেছি।
কোন রকমে পোশাক পরিবর্তন করে দৌড়ে গেলাম আজিমপুরের ছাপড়া মসজিদের পার্শ্ববর্তী বাজারে। গিয়ে দেখি কয়েকটা কাঁচা তরকারীর দোকান ছাড়া তেমন কোন দোকান খোলা নেই। এক তরকারী বিক্রেতা মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, "মামা আজ কি মুরগীর দোকানগুলো খুলবে না?" মামার নেতিবাচক উত্তরে এক-বুক হতাশা নিয়ে ফিরে এলাম।
ইতিমধ্যে খালা (কাজের বুয়া) এসে সেমাই, নুডলস ভাত সব রান্না করে গেছে।
ঈদের নামাজ শেষ। চারদিক সবাই যখন কোরবানির পশু জবেহ দেওয়ার কাজে ব্যাস্ত তখন আমি বাসায় অপেক্ষমাণ। কখন বন্ধুরা আসবে? কাল রাতে প্রায় সবাইকে বলেছি আসার জন্য।
বেলা ১১ টার দিকে আমার বন্ধু লিটন ওর এক বন্ধুকে নিয়ে বাসায় আসলো। বেশ কিছুক্ষণ ওদের সাথে গল্প-গুজব করে খাওয়া-দাওয়া পর্ব সেরে নিয়েছি। রিঙ্কু আর অনিন্দ তখনো এসে পৌঁছেনি। লিটন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রিঙ্কু/অনিন্দ এসেছে। আমি তখন শিউলি আপা আর সুপ্তিকে নিতে যাচ্ছি। ওদের বসিয়ে নিচ থেকে শিউলি আপা আর সুপ্তিকে নিয়ে এলাম। এরপর একসাথে সবাই মিলে আড্ডা দিয়েছি ঘন্টা খানেকের মত।
একে একে সবাই চলে যেতে থাকলো। ক্রমে আমার বাসাটি বিচ্ছিন্ন হতে থাকে পৃথিবী নামক সুন্দর এই গ্রহ থেকে। অবশেষে বখতিয়ার আর কবির ভাই যখন হলে (মাস্টারদা' সূর্যসেন হল) চলে গেল তখন মনে হল সৃষ্টিকর্তা আমায় ভুলক্রমে এমন একটা গ্রহে পাঠিয়েছে যেখানে প্রাণী বলতে কেবল আমি আর কিছু সংখ্যক ছারপোকা ছাড়া কিচ্ছু মিলবে না।
ল্যাপটপ টা অন করে শুয়ে-বসে কাঁটিয়ে দিয়েছি পরবর্তী সময়টা।
যখন রুমে একা সময়গুলো পার করে চলেছি তখন বার বার মা-বাবা আর ছোট বোনটির কথা খুব মনে হয়েছে। আজ যখন মায়ের সাথে ফোনে কথা বলেছি তখন বুঝেছি ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে মা আমাকে ২০ কিংবা ৫০ টাকা সেলামি দিতে পারেনি তাই তার মন বিষণ্ণ। কেঁদেও ফেলেছে হয়তো। আমার মায়ের চোখের জল আমার গলা আটকে দেয়। ঠিক যেমন এখন মায়ের কথা লিখতে গলাটা ধরে এসেছে। চোখেও লোনা জলের আনাগোনা।
বাবা হয়তো আমাকে সকালে সরাসরি বকাবকি করে ঘুম ভাঙ্গাতে পারেনি তাই ফোন করে বকা-বকি করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।
প্রতি বছরের ন্যায় গরু কোরবানি দেওয়ার সময় দাদা-চাচারা আমাকে সামনে দেখতে চেয়েছিল আর গরুর চামড়া আমাকে দিয়ে ছেলানোর পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সেটা হয়নি।
বিকেলে সিনিয়র ভাই-বন্ধুর সাথে বাইকে ঘুরে সমস্ত সাতক্ষীরাবাসী কে জানানো হয়নি আমরা আসছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:০১